সমীকরণ সহজ ছিল; নাজমুল একাদশের জয় তাদের এগিয়ে দেবে ফাইনালের পথে আর হেরে গেলে বিদায় প্রায় নিশ্চিত হবে তামিম একাদশের। কিন্তু এর বিপরীতটা হলেই জমে উঠবে টুর্নামেন্ট। আসরের অর্ধেক শেষে সমতায় থাকবে তিন দল। বৃহস্পতিবারের ম্যাচটিতে হলোও ঠিক তাই। জিতল তামিম একাদশ, প্রথম তিন ম্যাচ শেষে সমতায় থাকল সব দল।
তবে ম্যাচের শুরুটা পুরোপুরি ছিল নাজমুল একাদশের অনুকূলে। প্রথমে ব্যাট হাতে তামিম একাদশকে আশা দেখান মেহেদি হাসান, খেলেন ৫৭ বলে ৮২ রানের ইনিংস, দলকে এনে দেন লড়াই করার মতো পুঁজি। পরে বল হাতে জাদু দেখান মোস্তাফিজ, কিপটে বোলিংয়ে মাত্র ১৫ রান খরচায় তুলে নেন সেঞ্চুরিয়ান মুশফিকুর রহিমসহ ৩টি উইকেট।
মেহেদি-মোস্তাফিজের উজ্জ্বল পারফরম্যান্সের কল্যাণে নাজমুল একাদশকে ৪২ রানে হারিয়ে বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপে প্রথম জয় পেয়েছে তামিম একাদশ। আগে ব্যাট করে তারা করেছিল ২২১ রান, নাজমুল একাদশ অলআউট হয়েছে ১৭৯ রানে। যেখানে মুশফিকের একারই অবদান ১০৩ রান, আসরের প্রথম সেঞ্চুরি করেও পরাজিত দলেই থাকতে হলো দেশের অন্যতম সেরা এ ব্যাটসম্যানকে।
তামিম একাদশের এ জয়ের ফলে জমে উঠল প্রেসিডেন্টস কাপ। সব দল খেলে ফেলেছে ২টি করে ম্যাচ এবং জিতেছে সমান ১টি করে ম্যাচ। ফলে আগামী ২৩ অক্টোবরের ফাইনালে কোন দুই দল মুখোমুখি হবে তা নির্ধারিত হবে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় অর্ধেই। যা শুরু হবে শনিবার (১৭ অক্টোবর); লড়বে মাহমুউদউল্লাহ একাদশ ও নাজমুল একাদশ।
বৃহস্পতিবার রানতাড়া করতে নেমে মোস্তাফিজ-সাইফের আঁটসাঁট বোলিংয়ের সামনে হাঁসফাঁস করতে থাকেন নাজমুল একাদশের টপঅর্ডার ব্যাটসম্যানরা। বিশেষ করে মারকুটে ওপেনার সৌম্য সরকার রান করারই সুযোগ খুঁজে পাচ্ছিলেন না, খেলে গেছেন একের পর এক ডট। প্রথম দশ ওভারে আসে মাত্র ১৬ রান। দলীয় ফিফটি পূরণ করতে চলে যায় ২০ ওভার।
ততক্ষণে আবার সাজঘরে তিন ব্যাটসম্যান। ইনিংসের সপ্তম ওভারে ১০ মাথায় ফেরেন সাইফ হাসান (২১ বলে ৭), অধিনায়ক শান্ত ৬ বলে ১ রান করে আউট হন নবম ওভারে; দুজনের উইকেটই নেন মোস্তাফিজ। নিজের প্রথম পাঁচ ওভার শেষে মোস্তাফিজের বোলিং ফিগার ছিল ৫–২-৫-২; যেখানে ডট বলই ছিল ২৭টি।
ইনিংসের ১৫তম ওভারে সাইফউদ্দিনের বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়ে আউট হন মোস্তাফিজের বিপক্ষে ডটের পর ডট খেলা সৌম্য। রানের খোঁজে হাপিত্যেশ করতে থাকা সৌম্যর ব্যাট থেকে আসে ৪৭ বলে ৯ রানের ইনিংস। মাত্র ৩০ রানের ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যায় নাজমুল একাদশ। বিপদ আরও বাড়ে আফিফ হোসেন ধ্রুব ২৭ বলে ১৫ ও আগের ম্যাচের নায়ক তৌহিদ হৃদয় ৪ বলে ৪ রান করে ফিরে গেলে।
নাজমুল একাদশের সংগ্রহ তখন ২৪.২ ওভারে ৫ উইকেটে ৭৪ রান, শেষের ৫ উইকেটে করতে হতো আরও ১৪৮, বল হাতে ছিল ১৫৪টি। আশা-ভরসার পাত্র হয়ে একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন মিস্টার ডিপেন্ডেবল মুশফিক। তাকে সঙ্গ দিতে আসেন প্রথম ম্যাচে জয়ের আরেক নায়ক ইরফান শুক্কুর। দুজনের জুটিতে তামিম একাদশের মুঠোয় থাকা ম্যাচ ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হতে শুরু করে।
মুশফিক-ইরফান মিলে ষষ্ঠ উইকেটে যোগ করেন ৫৯ রান। মনে হচ্ছিল এ দুজনের জুটিতে ম্যাচ জমিয়ে তুলছিল নাজমুল একাদশ। তখনই অনাকাঙ্ক্ষিত এক রানআউটে ভাঙে জুটি। থার্ডম্যান থেকে দুই রান নেয়ার চেষ্টায় ছিলেন মুশফিক-ইরফান। কিন্তু দ্বিতীয় রান নেয়ার সময় মাঝপথে সাইফউদিনের বাধায় পড়েন মুশফিক, ততক্ষণে ইরফান আবার চলে আসেন অনেকদূর। দ্রুত বল ধরে উইকেটরক্ষক আকবরের গ্লাভসে পাঠান শরীফুল, সেই বল ধরে স্টাম্প ভাঙতে দেরি করেননি আকবর। যার সুবাদে শেষ হয় ইরফানের ৪০ বলে ২৪ রানের ইনিংস।
স্বীকৃত ব্যাটসম্যানদের সবাইকে হারিয়েও দমে যাননি মুশফিক। দলীয় ১৩৩ রানে ইরফান আউট হওয়ার সময় মুশফিক খেলছিলেন ৬৫ রানে। এরপর পুরো দায়িত্ব নিজের কাধেই তুলে নেন তিনি, হাঁকান প্রেসিডেন্টস কাপের প্রথম সেঞ্চুরি। ব্যক্তিগত ফিফটি করে ৬১ বল খেলা মুশফিক পরের পঞ্চাশ রান করেন মাত্র ৪২ বল থেকে।
মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের ওভারে পরপর দুই বলে দুই চার মেরে ১০৩ বলে সেঞ্চুরি পূরণ করেন মুশফিক। প্রথম পঞ্চাশে মাত্র ৩টি চার মারলেও, পরের পঞ্চাশ করতে আরও ৬টি চারের সঙ্গে ১টি ছক্কা হাঁকান তিনি। তবে সেঞ্চুরি পূরণ করার পর আর বেশিদূর যেতে পারেননি তিনি। পুরো ম্যাচে দুর্দান্ত বোলিং করতে থাকা মোস্তাফিজের করা ৪৫তম ওভারের দ্বিতীয় বলে রিভার্স স্কুপ করতে গিয়ে পয়েন্টে ধরা পড়েন মেহেদি হাসানের হাতে, থেমে যায় মুশফিকের ১০৩ রানের লড়াকু ইনিংস।
নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে মুশফিক ফিরে যাওয়ার পর তামিম একাদশে জয়ের আনুষ্ঠানিকতাই শুধু বাকি ছিল। যা সারেন সাইফউদ্দিন। তামিম একাদশের পক্ষে বল হাতে সর্বোচ্চ ৪ উইকেট নেন বাঁহাতি পেসার শরীফুল ইসলাম, ৮ ওভারে মাত্র ১৫ রান খরচায় ৩ উইকেট নেন মোস্তাফিজ। এছাড়া সাইফউদ্দিন নেন বাকি ২ উইকেট।
এর আগে টস জিতে আগে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন নাজমুল একাদশের অধিনায়ক। পরপর দুই ম্যাচে টস হেরে ব্যাট করতে নামতে হয় তামিম একাদশকে। ইনিংসের প্রথম ওভারে তামিম ইকবালের ব্যাট থেকে আসে এক চার, পরের ওভারে তানজিদ হাসান তামিম মারেন আরও দুইটি।
কিন্তু অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক ব্যাটিং থেকে নিজেকে সংবরণ করতে পারেননি জুনিয়র তামিম। জোড়া চার হাঁকানোর পর দ্বিতীয় ওভারেই আলআমিন হোসেনের বলে পুল করতে গিয়ে ধরা পড়েন মিডঅনে, ইনিংসের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র পাঁচ বলের।
জুনিয়র হতাশ করলেও, আগের ম্যাচের ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠার প্রত্যয় ছিল সিনিয়র তামিমের ব্যাটে। উইকেটের চারপাশে শট খেলতে থাকেন তিনি। তিন নম্বরে নামা এনামুল হক বিজয়কে নিয়ে বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই রান তুলতে থাকে তামিম একাদশ। খেলার ধারার বিপরীতে সপ্তম ওভারে নিজের উইকেট দিয়ে আসেন এনামুল। অফস্ট্যাম্পের বাইরের বলে খোঁচা লাগিয়ে ধরা পড়েন স্লিপে দাঁড়ানো সৌম্য সরকারের হাতে।
বিজয় (১৩ বলে ১২) আউট হওয়ার পরই যেনো মোড়ক লাগে তামিম একাদশের ইনিংস। অধিনায়ক তামিম ফিরে যান ৪৫ বলে ৩৩ রান করে, উইকেটে মানিয়ে নিতে না পারা মিঠুন আউট হন ২১ বলে ৪ রান করে। রক্ষণাত্মক অ্যাপ্রোচে চাপ সামাল দেয়ার চেষ্টা করেন শাহাদাত হোসেন দীপু ও মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। কিন্তু তাদের ব্যাটিং হয়ে যায় বেশিই রক্ষণাত্মক। ফলে থেমে যায় রানের চাকা।
দুজন মিলে প্রায় ১৫ ওভার খেলে পঞ্চম উইকেটে যোগ করেন ৪০ রান। দলীয় শতক পূরণ করে ফিরে যান দুজনই। বিশ্বজয়ী যুব দলের সদস্য শাহাদাত করেন ৫২ বলে ৩১ রান, সহ-অধিনায়ক সৈকত ১২ রান করতে খেলেন ৪৬টি বল। এরপর আকবর আলি (৫ বলে ২) ও সাইফউদ্দিন (১১ বলে ৩) হতাশার পরিচয় দিলে ৩৫ ওভারের আগেই ১২৫ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে ফেলে তামিম একাদশ।
তখন মনে হচ্ছিল অলআউট হওয়া স্রেফ সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু সবার ধারণা ভুল প্রমাণ করে পালটা জবাব দিতে থাকেন মেহেদি হাসান, অপরপ্রান্তে তাকে নির্ভরতা দেন তাইজুল ইসলাম। মাঝে বৃষ্টির জন্য খেলা বন্ধ থাকে ৬৭ মিনিট। তার আগেই দুজনের জুটিতে আসে ৩৪ বলে ২৯ রান। বৃষ্টিতে এক ঘণ্টার বেশি সময় খেলা বন্ধ থাকলেও কোনো ওভার কাঁটা যায়নি।
যা একপ্রকার সুবিধাই করে দেয় তামিম একাদশের। বৃষ্টি থামার পর খেলতে নেমে আরও আক্রমণাত্মক মেহেদির ব্যাট। মাত্র ৪৪ বলে ৬ চার ও ১ ছয়ের মারে পূরণ করেন নিজের ফিফটি। এরপর মাত্র ১২ বলে করেন আরও ৩২ রান, তিনটি চারের সঙ্গে হাঁকান দৃষ্টিনন্দন দুটি ছয়। যা তামিম একাদশকে পাইয়ে দেয় ২০০ রানের সংগ্রহ।
ইনিংসের শেষ ওভারে মুকিদুল ইসলাম মুগ্ধর বলে স্কুপ করতে গিয়ে সরাসরি বোল্ড হয়ে যান মেহেদি। ততক্ষণে তার নামের পাশে জ্বলজ্বল করছিল ৫৭ বলে ৯ চার ও ৩ ছয়ের ৮২ রানের বীরোচিত ইনিংস। নবম উইকেট জুটিতে মেহেদি ও তাইজুল মাত্র ৮৯ বলে যোগ করেন ৯৫ রান। যেখানে তাইজুলের অবদান ৪৩ বলে ২০ রান।
নাজমুল একাদশের পক্ষে বল হাতে ৩ উইকেট নিয়েছেন আল-আমিন হোসেন। এছাড়া নাইম হাসান ও রিশাদ আহমেদ নিয়েছেন ২টি করে উইকেট। অন্য দুই পেসার তাসকিন আহমেদ ও মুকিদুল ইসলামের ঝুলিতে জমা পড়েছে ১টি করে উইকেট।