প্রমত্তা পদ্মার কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৯টি জেলার সঙ্গে সড়কপথে রাজধানী থেকে সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। সড়কপথে যোগাযোগের এই দুরবস্থা লাঘবে ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ’ প্রকল্পের প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই করেছিল। এরপর ২০০৩ থেকে ২০০৫ সালে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) মাধ্যমে এর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়।
সেই সম্ভাব্যতার ওপর ভিত্তি করে ২০০৭ সালে পদ্মা বহুমুখী সেতুর মূল উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রণয়ন করা হয়। তখন ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা খরচে ২০০৭-২৮ থেকে ২০১৪-২০১৫ মেয়াদে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব অনুমোদন হয়।
প্রথম সংশোধিত ডিপিপি পর্যন্ত মোট প্রকল্প ব্যয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকার মধ্যে ১৬ হাজার ২৪৯ কোটি ৫২ লাখ (৭৯ দশমিক ২৪ শতাংশ) টাকা বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) দেয়ার কথা ছিল। সেই লক্ষ্যে ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক, একই বছরের ১৮ মে জাইকা, ২৪ মে আইডিবি এবং ৬ জুন এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
কিন্তু সহযোগী এই আন্তর্জাতিক বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানই একসময় পদ্মা সেতুর মূল প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ঘটনার সূত্রপাত ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে। ওই মাসে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ প্রক্রিয়া চলাকালীন কানাডীয় কোম্পানি ‘এসএনসি-লাভালিন’ এবং সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। পাশাপাশি পদ্মা সেতুতে এসব বিদেশি ঋণদাতা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানও অর্থ প্রদান স্থগিত করে। বিশ্বব্যাংক অর্থ প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করলে ২০১২ সালের ৯ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জনগণের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তের কথা জানান। সেই সিদ্ধান্তে দেশের মানুষের ব্যাপক সমর্থনও পান প্রধানমন্ত্রী।
অবশ্য বিশ্বব্যাংক আরোপিত দুর্নীতির অভিযোগের কলঙ্ক বেশিদিন বইতে হয়নি বাংলাদেশকে। ২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি কানাডার টরেন্টোর একটি আদালতে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের দুর্নীতির এ অভিযোগ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়।
কানাডার আদালতের রায়ে বলা হয়, ‘এই মামলায় যেসব তথ্য দেয়া হয়েছে, তা অনুমানভিত্তিক, গালগল্প এবং গুজবের বেশি কিছু নয়।’
এর আগে ২০১৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুই দফা অনুসন্ধান করেও বিশ্বব্যাংকের ওই অভিযোগের কোনো সত্যতা পায়নি।
আন্তর্জাতিক ও জাতীয় রায়গুলো অনেক আগেই মিথ্যা কলঙ্কের অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছিল। তবে প্রতাপশালী আন্তর্জাতিক বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ ছাড়াও যে বাংলাদেশ পদ্মা সেতুর মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে পারে, সেই আর্থিক ও মানসিক সক্ষমতার বাস্তব প্রমাণ হয়েছে বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) পদ্মা সেতুতে সর্বশেষ স্প্যান স্থাপনের মাধ্যমে। এই জয় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের অযথা বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের।
এ প্রকল্পের প্রধান কাজগুলো হলো- ভূমি অধিগ্রহণ, ১২ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ, সার্ভিস এরিয়া-২ নির্মাণ, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সড়ক-রেল সেতু নির্মাণ, ১৪ কিলোমিটার নদী শাসন, ইঞ্জিনিয়ারিং সাপোর্ট এবং সেফটি, কন্সট্রাকশন সুপারভিশন, পুনর্বাসন, পরিবেশগত কার্যক্রম ও ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র বলছে, ২০০৭ সালে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল ডিপিপি প্রণয়নের পর প্রথম সংশোধন আনা হয় ২০১১ সালে। প্রথম সংশোধনে ব্যয় দ্বিগুণ করে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি করা হয়। মেয়াদকাল ধরা হয় ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এরপর ২০১২ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করলে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে প্রাপ্ত সর্বনিম্ন দর অনুযায়ী প্রকল্পটির ডিপিপি ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য ২০১৬ সালে দ্বিতীয়বার সংশোধন আনা হয়।
এছাড়া ২০১৮ সালে মেয়াদ বৃদ্ধি ছাড়া বিশেষ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রকল্পের ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায় বৃদ্ধি এবং ২০১৯ সালে ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া বিশেষ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
জাজিরা সংযোগ সড়কের কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর এবং শেষ হয় ২০১৮ সালের ২ জুন। এতে খরচ হয়েছে এক হাজার ২৭১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। মাওয়া সংযোগ সড়কের কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ২৭ জানুয়ারি এবং শেষ হয় ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই। এতে খরচ হয় ১৯৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। সার্ভিস এরিয়া-২ এর কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি এবং শেষ হয় ২০১৬ সালের ১১ জুলাই। এতে খরচ হয়েছে ১৯৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে মোট ২ হাজার ৬৯৩ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা ছিল। যার জন্য বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৬৯৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। তার মধ্যে চলতি বছরের মে পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৪৩৪ দশমিক ৫৭ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে এবং দখল বুঝে নেয়া হয়েছে ১ হাজার ৪৫৩ দশমিক ০৫ হেক্টর ভূমির। ভূমি অধিগ্রহণে মোট ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৪৯৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
প্রকল্পের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য সাতটি পুনর্বাসন এলাকায় ২ হাজার ৯০৬টি প্লটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার মধ্যে ২ হাজার ৬২৪টি প্লট হস্তান্তর করা হয়েছে। পুনর্বাসন বাবদ চলতি বছরের মে পর্যন্ত ৯৫৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে।