শিক্ষা, বস্ত্র ও বাসস্থানের ন্যায় চিকিৎসাও মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। তবে বিশাল বাংলার সর্বত্র এখনো পুরোপুরি স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দিতে না পারলেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের স্বাস্থ্য সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে কমিউনিটি ক্লিনিক। গ্রামীণ নারী ও শিশুদের চিকিৎসাসেবার ভরসাস্থল হয়ে উঠেছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে ওঠা কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো। সর্দি-কাশি থেকে শুরু করে ডায়রিয়া কিংবা অন্যান্য অসুখ হলেও এসব ক্লিনিকে ছুটে যান তারা। তবে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে পর্যাপ্ত ওষুধ ও সরঞ্জামাদি না থাকায় ‘উন্নত’ চিকিৎসা দিতে পারছেন না স্বাস্থ্যসেবা সহকারীরা। এরপরও গরিবের হাসপাতাল হিসেবে বেশ নাম কুড়িয়েছে এই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো। হয়ে উঠেছে স্বাস্থ্য সেবার নির্ভরতার প্রতীক।
সম্প্রতি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
জানা যায়, গ্রামীণ জনপদে গড়ে ওঠা এসব ক্লিনিক পরিচালনায় স্থানীয় জনগণের প্রতিনিধিরাও অংশ নিচ্ছেন। বর্তমানে দেশে ১৩ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে।
এসব ক্লিনিকের মাধ্যমে গর্ভবতী মায়েদের প্রসব পূর্ব ও পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা, প্রজননস্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, টিকাদান কর্মসূচি, পুষ্টি, স্বাস্থ্যশিক্ষা, পরামর্শসহ বিভিন্ন সেবা দেওয়া হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে স্থানীয় পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে শিশুস্বাস্থ্য উন্নয়নে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও কাজ করছে সহযোগী হিসেবে।
নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা থানার রায়পুর ইউনিয়নের পাইকপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যসেবা সহকারী (কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার) মোফাজ্জল হোসাইল জানান, গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই দরিদ্র। তাদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ-সুবিধা একেবারে কম। আমাদের ক্লিনিকে এসব মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়।
তিনি জানান, ‘ক্লিনিকে ৩০ প্রকার ওষুধ বিনামূল্যে প্রয়োজন অনুযায়ী দেওয়া হয়। গর্ভবর্তী নারী ও শিশুদের বিভিন্ন রোগের টিকা ছাড়াও সর্দি-কাশির মতো রোগের ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়।’
তবে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যসেবাকর্মীর পদ থাকলেও ওই ক্লিনিকটিতে বর্তমানে কেউ নেই বলে জানালেন স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মোফাজ্জল।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারও পাতলা পায়খানা, শিশু সন্তান অসুস্থ হলে বাড়ির পাশের এই কমিউনিটি ক্লিনিকে ছুটে যান তারা। আর বড় ধরনের কোনো অসুখ হলে প্রথমে কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণকেন্দ্রে যান।
সেখান থেকে তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা সদর হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। পাইকপাড়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব আক্কাস আলী বলেন, ‘জ্বর, মাথাব্যাথা কিংবা চুলকানির মতো অসুখ অইলেই আমরা কমিউনিটি ক্লিনিকে যাই। আর মারাত্মক কিছু অইলে তারা (স্বাস্থসেবা সহকারী) সদর হাসপাতালে যাওয়ার কথা বলেন।’
কমিউনিটি ক্লিনিক প্রসেঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ড. নাজনীন আকতার বলেন, কিছু কিছু কমিউনিটি ক্লিনিক গ্রামের একেবারে উপায়হীন একজন নারীকে সন্তান প্রসবের জন্য প্রচুর ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশের বিপদ ও অদক্ষ দাইয়ের হাত থেকে রক্ষা করছে। যা খুবই ভালো দিক। কেননা মা সুস্থ থাকলে, সন্তান সুস্থ হবে। মা ও সন্তান সুস্থ থাকলে সুস্থ সমাজ হবে।
কমিউনিটি ক্লিনিকের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে প্রকল্পটির পরিচালক (বর্তমানে প্রধান সমন্বয়কারী) ডা. মাখদুমা নার্গিস বলেন, উন্নয়নশীল কোনো দেশে আমাদের মতো কমিউনিটি ক্লিনিক দেখিনি। সরকারের যুগান্তকারী এ পদক্ষেপে কমপক্ষে ১৮টি উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় কাজ করেছে ওয়ার্ল্ড ভিশন, বাংলাদেশ। সংস্থাটির আঞ্চলিক স্বাস্থ্য সমন্বয়ক জয়ন্ত নাথ জানান, স্থানীয়দের মধ্যে অনেকেই এখনও সেবা নিতে কমিউনিটি ক্লিনিকে যাচ্ছে না। আবার অনেকে সেবা নিতে গিয়ে মানসম্পন্ন সেবা পাচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘এ অবস্থায় প্রতি ৩০০ পরিবারের জন্য আমরা একজন পুষ্টি পরামর্শক নিয়োগ দিয়েছি। যারা এসব পরিবারের মা ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর পুষ্টির বিষয়ে সচেতন করছেন। সবাই বিষয়টি ভালোভাবে গ্রহণ করেছে।’
এছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনায় দায়িত্ব-কর্তব্য জানিয়ে বিভিন্ন কমিউনিটি গ্রুপ ও কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপকেও সচেতন করা হয়েছে বলে জানান জয়ন্ত নাথ।
তিনি আরো বলেন, ‘কেননা এ ক্লিনিকের রক্ষণাবেক্ষণ তাদেরই করতে হবে। এখন তারা বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন এবং কার্যকরভাবে হাসপাতালকে পরিচালনা করছেন। প্রতিনিয়ত সভা করে বিদ্যমান ছোটখাটো সব সমস্যা সমাধানেরও উদ্যোগ নিয়েছেন তারা।’
এদিকে কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবার মান আরও উন্নত ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং প্রশিক্ষিত জনবলের উপস্থিতি নিশ্চিতের বিষয়ে জোর দিতে বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক আবদুল খালেক।
তিনি বলেন, এখনও নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এরপরও কমিউনিটি ক্লিনিক চলছে। তবে ক্লিনিকের সেবাদানকারীদের তিন মাসের প্রশিক্ষণ যথেষ্ট নয়। যা তারা নিজেরাও বলেছেন। তাই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, লোকবল বাড়ানো দরকার কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে।
বঞ্চিত গ্রামীণ মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে ‘রিভাইটালাইজেশন অব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইনিশিয়েটিভস ইন বাংলাদেশ (কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প)’ শীর্ষক ৫ বছর মেয়াদী (২০০৯ জুলাই থেকে ২০১৪ জুন) প্রকল্প চালু করে সরকার।
চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাতের উন্নয়ন কর্মসূচির অপারেশনাল পরিকল্পনায় রয়েছে কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার (কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প) প্রকল্প। বর্তমানে এ প্রকল্পের কার্যপরিধি ও অবকাঠামো আরও বাড়ছে বলে জানান প্রকল্পের প্রধান সমন্বয়ক ডা. মাখদুমা নার্গিস।
তিনি জানান, কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা গ্রহীতা ও সেবার মান বেড়েই চলেছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বিশ্বের মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি। যার সুফল সুফল ভোগ করছে সাধারণ মানুষ।
ডা. মাখদুমা নার্গিস। আরো বলেন, ‘বর্তমানে ৯ শতাধিক কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা চালু হয়েছে। গঠন করা হয়েছে শক্তিশালী মনিটরিং টিম। মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে এটা থখুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
এদিকে গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যসেবাদানকারীদের সময় মতো অফিসে আসা-যাওয়ার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ারের (সিবিএইচসি) লাইন ডিরেক্টর (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. ইউসুফ।
তিনি বলেন, যারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করবে না তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সবার আগে গ্রামীণ মানুষের সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/ফই/স্বব/০৯২৫/আহো/-ওজি
উন্নয়নকথা