কভিড চিকিৎসায় নিঃস্ব হাজারো পরিবার

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনা চিকিৎসায় স্টেম সেল থেরাপি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের চাচি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর ধাপে ধাপে তাঁকে প্রায় এক মাস রাখতে হয় হাসপাতালে। প্রথমে ১৫ দিন ছিলেন ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালের আইসিইউতে। সেখানে খরচ চালাতে গিয়ে জমা টাকা, সম্পত্তি বিক্রি ও ধার করেও কুলাতে না পেরে নিয়ে যান একটি সরকারি হাসপাতালে। সেখানে অনেক কিছু ফ্রি থাকলেও চিকিৎসার প্রয়োজনে খুব দামি কিছু ইনজেকশন দিতে হয় প্রতিদিন, যা সরকারি ওই হাসপাতালেই নেই। এক পর্যায়ে সেখানেও হিমশিম খেয়ে বাধ্য হয়ে তাঁর সন্তানরা হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পথেই মারা যান ওই নারী। এর মাঝেই ওই পরিবারের ২০ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়ে যায়। পরিবারটি রীতিমতো এখন প্রায় নিঃস্ব।

রাজধানীর পান্থপথ এলাকার একটি হাসপাতালে কভিড আক্রান্ত ষাটোর্ধ্ব এক রোগীকে হঠাৎ ওই হাসপাতালের চিকিৎসকরা পরামর্শ দিলেন এক্টিমেরা ৪০০ এমজি (টোসিলিজুমব) আইভি ইনজেকশন দিতে, যা ওই হাসপাতালের ফার্মেসিতে নেই। রোগীর স্বজনরা বাইরে হন্যে হয়ে খুঁজে না পেয়ে আবার যখন ওই হাসপাতালের নার্সদের জানায়, তখন তাঁরা ওই ইনজেকশন সরবরাহকারী একজনের মোবাইল নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলেন। রোগীর স্বজনরা ওই নম্বরে ফোন করলে প্রথমে জানানো হয় ওই ওষুধ নেই। সংগ্রহ করে দিতে সময় লাগবে। ওই স্বজন কান্নাকাটি ও অনুনয়-বিনয় করার পর ইনজেকশন দিতে রাজি হলেও দাম চাওয়া হয় প্রতি ডোজের জন্য এক লাখ ১০ হাজার টাকা। পরে কমিয়ে তা নামানো হয় ৯০ হাজারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই লোক ওষুধ দিয়ে টাকা নিয়ে যান। দেশে কভিড চিকিৎসায় কোনো কোনো হাসপাতালে জটিল পরিস্থিতিতে থাকা রোগীদের দেওয়া এটাই সর্বোচ্চ দামের কোনো ওষুধ।

তবে এ ছাড়া কভিড রোগীদের উপসর্গ থেকে শুরু করে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং সুস্থ হওয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিকবার কভিড টেস্ট, এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, রক্ত পরীক্ষার কমন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয় রোগীর অবস্থা নির্ণয়ের জন্য। আছে অ্যাম্বুল্যান্স। মাঝে প্রয়োজনমতো আট থেকে ১০টি ওষুধও থাকে প্রায় সব রোগীর। এ ছাড়া অবস্থা অনুসারে চলে সিলিন্ডার অক্সিজেন, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা কিংবা আইসিইউতে ভেন্টিলেটর থেরাপি। গড়ে কমপক্ষে ১০ দিন থেকে এক-দেড় মাসও হাসপাতালে থাকতে হয় কোনো রোগীকে। সঙ্গে অক্সিমিটার আর ডায়াবেটিস রোগীদের ব্লাড সুগার পরিমাপ যন্ত্র, ব্লাড প্রেসার মাপার যন্ত্রও যেন কমন হয়ে আছে। এর বাইরে রোগীর পথ্য, বেড, কেবিনের ব্যবস্থাপনাও যুক্ত থাকে রোগীর অবস্থা অনুসারে।

এ ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে কভিড রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ পেলে অনেক কিছুই মেলে বিনামূল্যে। সরকারের ঘোষণা অনুসারে হাসপাতালে কভিড রোগীদের সব কিছুই ফ্রি। এমনকি সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ ফ্রি। তবে কোনো কোনো ওষুধ এবং বিশেষ পরীক্ষার প্রয়োজন হলে ক্ষেত্রবিশেষে তা হাসপাতালের বাইরে থেকে মাঝেমধ্যে করতে হয়। তবে এর ঠিক উল্টো চিত্র বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে।

কভিড চিকিৎসা যেন বেসরকারি হাসপাতালে বড় ব্যবসার মওকা হয়ে উঠেছে। বড় হাসপাতালগুলোতে আইসিইউতে থাকা রোগীদের জন্য গড়ে দিনে প্রায় এক লাখ টাকা গুনতে হয়, যা মাঝারি বা নিম্ন ক্যাটাগরির হাসপাতালগুলোতে নেমে আসে ২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকায়। কোনো কোনো হাসপাতালে আইসিইউয়ের প্যাকেজের মধ্যে ওষুধ-পরীক্ষা থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আইসিইউ ভাড়া আর ওষুধ-পরীক্ষার বিল আলাদা নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে রোগীর স্বজনরা কেবিন নিলে সেই ভাড়াও থাকে আলাদা। এ ক্ষেত্রে ওষুধ ও পরীক্ষার ফি বেশির ভাগ হাসপাতালেই আলাদা দিতে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতির অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ গণমাধ্যমকে বলেন, প্রাইভেট হাসপাতালে আইসিইউতে থাকা রোগীদের পেছনে পরিবারের প্রতিদিন গড়ে এক লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। কারণ প্রাইভেট হাসপাতালের শতভাগ সার্ভিস-ওষুধ-পরীক্ষা—সবটাই টাকার বিনিময়ে নিতে হয়। সরকারি হাসপাতালে সার্ভিস, পরীক্ষা, বেশির ভাগ ওষুধ ফ্রি থাকলেও বিভিন্ন কারণে দিনে প্রায় চার-পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায় রোগীর স্বজনদের। তবে এখন প্রাইভেট হাসপাতালের বাণিজ্য গত বছরের তুলনায় আরো বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের জায়গা থেকে নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে রোগীর চাপের কারণে। প্রাইভেট হাসপাতালগুলোকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সেবা কিংবা খরচ সবটাই চলে তাদের ইচ্ছা-মর্জি মতো। ফলে বহু কভিড রোগীর পরিবার এখন পথে বসেছে। যারা মারা গেছে, তারা নিজেরাও গেছে, পরিবারও নিঃস্ব হয়েছে। ফলে অনেকে এখন উপসর্গ দেখা দেওয়ার পরও খরচের ভয়ে হাসপাতালে যেতে চায় না। শেষ সময় পর্যন্ত তারা বাসায় থাকতে চায়। এতে অনেক রোগী যেমন বাসায় মারা যাচ্ছে আবার অনেককে শেষ সময়ে হাসপাতালে নিয়েও লাভ হচ্ছে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. ফরিদ উদ্দিন মিয়া বলেন, প্রাইভেট হাসপাতালে কিছু পরীক্ষা ও ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সবাইকে জানানো আছে নির্ধারিত ফির বেশি নেওয়া যাবে না। এখন যা অবস্থা তাতে সব হাসপাতালে সার্বক্ষণিক মনিটর করাও কঠিন। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘প্রাইভেট হাসপাতালের জন্য সিটি স্ক্যান ছয় হাজার টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। অক্সিজেনও প্রতিটি মিনিট-ঘণ্টা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে।’

বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, ‘কভিড রোগীদের নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে এক শ্রেণির প্রাইভেট হাসপাতালে বাণিজ্য হচ্ছে। রোগী পেলেই ইচ্ছামতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধ দেওয়া শুরু করে। এতে অনেক রোগীর অবস্থা ভালোর পরিবর্তে যেমন খারাপ হয়, তেমনি অযথাই অনেক পরিবার সর্বস্বান্ত হচ্ছে।’ তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘যে হারে টোসিলিজুমব দেওয়া হচ্ছে, তা রীতিমতো উদ্বেগের ব্যাপার। যেকোনো চিকিৎসকই কি এটা দিতে পারেন? এ ধরনের ওষুধ দিতে হলে যে মানের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ দরকার, সব হাসপাতালে কি সেই মানের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ আছেন? নাকি শুধু টাকা কামাইয়ের জন্য এই এত দামি ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, সেটা দেখা দরকার।’

এদিকে প্রাইভেটে যখন এমন বাণিজ্যের প্রশ্ন তুলছেন খোদ চিকিৎসক নেতারাই, তখন সরকারি হাসপাতালে সরকারের তরফ থেকে কী খরচ করছে সেই হিসাব বের করার চেষ্টা করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ। এই বিভাগের মহাপরিচালক ড. মো. শাহাদৎ হোসেন মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা কভিড রোগীদের পেছনে খরচ নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছি। সমীক্ষায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, মুগদা জেনারেল, কুর্মিটোলা জেনারেল ও কুয়েত মৈত্রী—এই চার সরকারি হাসপাতালের গত বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর মেয়াদকালের তথ্য উঠে এসেছে। হাসপাতালগুলোতে এই সময়ে কভিড আক্রান্ত ৩৬ হাজার ২৪৯ জন আউটডোর সেবা এবং ৩১ হাজার ২০৪ জন ভর্তি হয়ে সেবা নিয়েছে, যাদের মধ্যে দুই হাজার সাতজনের আইসিইউ দরকার হয়েছিল। কভিড আক্রান্ত আউটডোরের রোগীদের পেছনে গড়ে দুই হাজার ৭৯৭ টাকা হিসাবে মোট প্রায় ১০ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।

অন্যদিকে যে ২৯ হাজার ১৯৭ জন রোগী ভর্তি ছিল কিন্তু আইসিইউ লাগেনি, তাদের জন্য মাথাপিছু গড়ে প্রতিদিন ১২ হাজার ৮১১ টাকা খরচ হয়েছে। প্রতিজন রোগী যত দিন হাসপাতালে ছিল, সব মিলিয়ে মোট গড়ে মাথাপিছু এক লাখ ২৮ হাজার ১০৯ টাকা হিসাবে খরচ হয়। মোট খরচ দাঁড়ায় ৩৭৪ কোটি চার লাখ টাকা।

আর আইসিইউতে থাকা দুই হাজার সাতজন রোগীর মাথাপিছু প্রতিদিন খরচ হয়েছে গড়ে ৫১ হাজার ছয় টাকা। একজন রোগী যত দিন ভর্তি ছিল, সেই হিসাবে মোট মাথাপিছু খরচ চার লাখ আট হাজার ৪৫ টাকা হিসাবে মোট ব্যয় প্রায় ৮১ কোটি সাড়ে ৮৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ সরকারি এই চার হাসপাতালে গত বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৭ হাজার ৪৫৩ জন করোনা রোগীর জন্য সরকারের মোট খরচ হয়েছে ৪৬৬ কোটি সাত লাখ টাকারও বেশি।

শেয়ার করুন