নির্মোহ সত্য উদঘাটন করতে হবে

মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)

মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)
মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)। ফাইল ছবি

২৭ আগস্ট কালের কণ্ঠ’র খবর অনুযায়ী শোকের মাসে আওয়ামী লীগের এক আলোচনাসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গে পঁচাত্তরে আওয়ামী লীগসহ অনেকেরই ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। পৃথিবীর সব রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বেলায় দেখা গেছে, এনিমি উইদিনের বিশ্বাসঘাতকতাই সবচেয়ে বেশি বড় ভূমিকা রেখেছে। শত্রুপক্ষ তো আছেই, কিন্তু আত্মপক্ষের সুরক্ষা ব্যবস্থা যদি ঠিক থাকে, এনিমি উইদিন হিসেবে যদি কেউ বিশ্বাসঘাতকতা না করে, তাহলে শত্রুপক্ষ কখনোই সফল হতে পারে না, এটা ইতিহাসের সত্য। পঁচাত্তরের ঘটনায় দায়িত্বশীল অনেকে নানা অজুহাতে ব্যর্থতার কথা বলেন, সেটা আপাতদৃষ্টিতে সঠিক মনে হলেও সত্যানুসন্ধানী বিশ্লেষণে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এক দিনে হঠাৎ করে হয়নি। এর দীর্ঘ প্রেক্ষাপট রয়েছে। তারপর প্রেক্ষাপট তৈরির উপাদানগুলো দিনের মতো পরিষ্কার থাকা সত্ত্বেও কেউ কিছু বুঝলেন না, জানলেন না, জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল। এসব বালখিল্য, হাস্যকর কথাবার্তা কোনো চিন্তাশীল সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো পঁচাত্তরের ক্ষত আর কত দিন আমাদের যন্ত্রণা দেবে, আর কতকাল পিছু টানবে। এ প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি, আবার জানি না। জানি এইভাবে, পঁচাত্তরে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পথ ধরে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে যেসব অপশক্তি, অপচিন্তা, অপমতাদর্শ এবং পশ্চাৎপদতার আবির্ভাব ঘটেছে সেগুলো এখন সবার জানা। তাই এগুলো সব জায়গা থেকে অপসারিত হলেই সেই দুঃস্বপ্ন থেকে আমরা মুক্ত হতে পারি। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর জানি না বলছি এই কারণে, এসব অপ থেকে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজ কবে নাগাদ মুক্ত হতে পারে তার কোনো নিশানা চোখে ধরা পড়ছে না। ইতিহাসের স্বতঃসিদ্ধ এই প্রচলিত গতানুগতিক পথ, পন্থা ও কৌশলে সেসব থেকে মুক্ত হওয়া প্রায় অসম্ভব। কিছু একটা আউট অব দ্য বক্স ও ইনোভেটিভ কৌশলের পথ ধরে একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন, যদি রক্তপাতহীনভাবে তা করতে চাই। ফাউন্ডিং ফাদারস কর্তৃক নির্ধারিত মৌলিক রাষ্ট্রচিন্তা প্রতিষ্ঠায় আমেরিকাকে স্বাধীনতা অর্জনের ৭৮ বছর পর ১৮৬১-১৮৬৫তে আরেকটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ করতে হয়েছে। তার পরই শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুসংহত হয়েছে।

আমরা কোনোভাবেই একটা গৃহযুদ্ধের কথা ভাবতে পারি না। সুতরাং নিয়মতান্ত্রিক পথই আমাদের একমাত্র পথ। দানবীয় অপশক্তি যখন মানবসমাজ ও জাতি-রাষ্ট্রকে পেয়ে বসে তখন তার থেকে মুক্ত হওয়ার একটা পথ দেখিয়েছেন আধুনিক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ প্রান্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে বার্ট্রান্ড রাসেল মন্তব্য করেন, আজ যে মহাদানবের সৃষ্টি হলো তার সুবিধাভোগী গোষ্ঠী কখনো দানবকে ত্যাগ করবে না, এর থেকে বিশ্ব মানবসমাজকে বাঁচতে হলে সারা বিশ্বের শান্তিকামী জনমানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পঁচাত্তরের রক্তাক্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজের সব কর্তৃত্ব দখল করে নেয় দানবীয় শক্তি। তারা দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে সব অঙ্গনে জাল বিস্তার করে নিজেদের শক্তিকে সুসংহত করতে পেরেছে। গত ১২ বছর তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় নেই। তাতে আমরা কি বলতে পারছি রাষ্ট্র ও রাজনীতির অঙ্গনে তাদের লোকসংখ্যা কার্যকরভাবে হ্রাস পেয়েছে, তাদের ছড়ানো জাল সংকুচিত হয়েছে? পঁচাত্তরের চেয়ে এনিমি উইদিন এখন আরো সক্রিয়। পরীক্ষিত নয়, তোষামোদি, চাটুকারিতা আর সর্বক্ষণ চারপাশে ঘুরঘুরকারীদের দৌরাত্ম্য সব জায়গায় প্রাধান্য পাচ্ছে। এটা শুভ লক্ষণ নয়। সুতরাং সব ষড়যন্ত্রকারী ও অপশক্তির কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে বৃহত্তর জনমানুষকে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে সংগ্রামে শামিল করার জন্য এবং আগামী শত-হাজার বছর বাংলাদেশকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য, ইতিহাসের কঠিন সত্য প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত উন্মোচিত হওয়া জরুরি। সত্য এবং শুধু সব সত্য বের হলেই তরুণ প্রজন্মকে সঙ্গে পাওয়া যাবে, কোনো অর্ধ সত্য বা আংশিক সত্য বের করলে তাতে কোনো কাজ হবে না। সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার অথবা বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসাবশত কাজের দ্বারা কখনো কোনো মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হয়নি।

ঘাতক-বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি দেওয়া এক কথা, আর ইতিহাসের সত্য প্রতিষ্ঠা অন্য কথা। অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আইনি প্রক্রিয়াই যথেষ্ট এবং সেই পথেই যাওয়া উচিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার বৃহত্তর প্রেক্ষাপট ও তার পরিণতির ভয়াবহতা বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরতে পারলে নতুন প্রজন্ম ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্র ও রাজনীতির অঙ্গন থেকে সব অপশক্তিকে বিদায় করার সংগ্রামে যোগ দেবে, সেটাই বড় লক্ষ্য হওয়া উচিত। প্রথমত, হত্যাকাণ্ডের যে বিশাল প্রেক্ষাপট রয়েছে তার সব কিছু যেমন আসতে হবে, তেমনি আসতে হবে কী কী রাজনৈতিক উপাদান এই প্রেক্ষাপট তৈরিতে কাজ করেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের মধ্যে তৈরি হওয়া দ্বন্দ্বের সব কিছু আসতে হবে এবং পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের ওপর তার বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আমলে আনলে এনিমি উইদিনের স্বরূপ পাওয়া যাবে। বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্র, সব সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ পদে ও নীতিনির্ধারণী জায়গায় ছিলেন এমন কর্মকর্তারা, যাঁরা একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকাসহ বাংলাদেশের সর্বত্র পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগী ছিলেন। সব যুগের ইতিহাসে দেখা যায়, কাপুরুষরা বাহ্যিকভাবে নতজানু থাকলেও মনেপ্রাণে বিজয়ী বীরদের প্রতি প্রচণ্ড ঈর্ষাপরায়ণ থাকে এবং সুযোগ পেলেই সেই বিজয়কে নস্যাৎ করতে উদ্যত হয়। সেনাবাহিনীর ভেতরের কথায় আসি। বঙ্গবন্ধুর দুই প্রধান খুনি ফারুক ও রশিদ একাত্তরে যুদ্ধের শেষ প্রান্তে, অর্থাৎ বিজয় যখন নিশ্চিত হয়ে যায় তখন পাকিস্তান থেকে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাসের সূত্রে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তাঁরা দুজনই পাকিস্তানের প্লান্টেড এজেন্ট হিসেবে আসেন। তখনই তদন্ত করলে সব বের হয়ে যেত। তারপর ১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে দুজনই ঢাকা সেনানিবাসের দুটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তিশালী ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে আসেন। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়। তখন জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনা সদর দপ্তরে উপসেনাপ্রধান। সেনা সদরের মিলিটারি সেক্রেটারি শাখা অফিসারদের পোস্টিং পদায়ন করেন। মেজর পদবির অফিসার পর্যন্ত মিলিটারি সেক্রেটারি শাখার এই কাজের অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ অফিসার ছিলেন জেনারেল জিয়া উপসেনাপ্রধান হিসেবে। খুনি আবদুর রশিদের ইন্টারভিউ থেকে জানা যায়, ১৫ই আগস্টের অনেক আগেই ফারুক-রশিদ ১৫ই আগস্ট সংঘটিত বিষয় নিয়ে জেনারেল জিয়ার সঙ্গে আলাপ করেন। প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার কয়েক দিনের মাথায় ২৪ আগস্ট সেনাপ্রধান হয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান ফারুক ও রশিদকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি দেন। আরেকটি অন্ধকার দিক, বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সেরিমোনিয়াল ও নিরাপত্তার জন্য কুমিল্লা থেকে সেনাবাহিনীর প্রথম ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির সেনাদল আনা হয়, সেখানে কর্মরত ছিলেন বজলুল হুদা ও আজিজ পাশা।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর জন্য ঢাকার বাইরে থেকে সেনাদল আনা প্রচলিত বিধি-বিধানের বাইরে। প্রয়াত মেজর জেনারেল মঈনুল হোসেন চৌধুরী বীর-বিক্রম কর্তৃক লিখিত ‘দ্য সাইলেন্ট উইটনেস বাই আ জেনারেল’ গ্রন্থ থেকে দু-একটি মন্তব্য তুলে ধরি। বইয়ের ৭৭ পৃষ্ঠায় তিনি যথার্থভাবে সেনা আইনের কথা উল্লেখ করেছেন। লিখেছেন, বিদ্রোহী-হত্যাকারী ও যাঁরা ওই সময়ে উপস্থিত থেকে জেনে-দেখে বিদ্রোহ দমনে উদ্যাগ নেননি, দুই পক্ষই সেনা আইনের ৩১ ধারা অনুযায়ী গুরুদণ্ড পাওয়ার শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। তখনকার সেনাপ্রধান, সিজিএস, ব্রিগেড কমান্ডার এবং উপসেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান সবারই সেনা বিধানের ৩১ ধারা মতে বিচার হতে পারে। উপরোক্ত বইয়ের ৭৯ পৃষ্ঠায় জেনারেল মঈন আরো লিখেছেন, কোনো অজুহাতেই নিষ্ক্রিয় থাকার সুযোগ নেই। রাষ্ট্রপতি নিহত হওয়ার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর টপ চেইন অব কমান্ডের সবার দায়িত্ব ছিল সর্বশক্তি নিয়োগ করে বিদ্রোহ দমন করা, সেই চেষ্টা তাঁরা কেউই করেননি। আরেকটি ঘটনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে জার্মানির রাষ্ট্রদূত হিসেবে পোস্টিং দেওয়া হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বঙ্গবন্ধুর কাছে তদবির করে সেই পোস্টিং আদেশ বাতিল করেন। সুতরাং এনিমি উইদিনের বিষয়টি সর্বক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে, যার উল্লেখ করা গেল না। কমিশন গঠিত হলে সেটা হতে হবে জাতীয় কমিশন, সরকারি কমিশন নয়। কমিশনের কর্মপরিধি নির্দিষ্ট টার্ম অব রেফারেন্স দিয়ে সীমাবদ্ধ করা যাবে না, এটা ওয়াইড অ্যান্ড ওপেন থাকতে হবে। অধিকতর গ্রহণযোগ্যতার জন্য এর আইনি ব্যাকআপ থাকা আবশ্যক। কমিশন যাঁদের নিয়ে গঠিত হবে তাঁরা অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পরীক্ষিত মানুষ হবেন এবং তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর কী হলো, কারা ক্ষমতা দখল করল; পরবর্তী সময়ে সেনাশাসকরা রাষ্ট্র ও রাজনীতির অঙ্গনে কী করলেন, তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কী সম্পর্ক এবং তার পরিণতিতে বাংলাদেশের কী ক্ষতি হলো ইত্যাদি বিষয় বিস্তারিত এলে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে মৌলিক সমস্যাগুলো কোথায়। এ কাজগুলো করা গেলে ট্র্যাজেডির দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে ইতিহাসের নির্মোহ সত্যের উদঘাটন হবে এবং সেটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে সঠিক পথ দেখাবে।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

sikder52@gmail.com

শেয়ার করুন