নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়ন করতে বিশিষ্ট নাগরিকদের বিবৃতি

ডেস্ক রিপোর্ট

নির্বাচন কমিশন

আগামী ফেব্রুয়ারিতে শেষ হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ। এই সময়ের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান অনুযায়ী কমিশন গঠনের জন্য আগের মতোই সার্চ কমিটি হবে।বিরোধী দলগুলোর দাবি, কমিশন গঠনের জন্য আগে আইন প্রণয়ন করে তারপরসার্চ কমিটি করতে হবে। এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ৫৩ জন বিশিষ্ট নাগরিক। তারাও পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনে এখনই আইন প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন।

বিবৃতিদাতারা বলছেন, সার্চ কমিটির মাধ্যমে বিগত দুটি নির্বাচন কমিশন গঠন হলেও কমিশনের ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ আচরণের কারণে নির্বাচনী ব্যবস্থায় মানুষের আস্থার অভাব দেখা দিয়েছে। তারা বলেন, সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে ‘আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে’ নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের নির্দেশনা থাকলেও গত ৫০ বছরে কোনো সরকারই এমন একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়নি।বিবৃতিদাতাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামচৌধুরী, সিনিয়র আইনজীবী আমীরুল ইসলাম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান, ড. আকবর আলি খান, সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেনসহ শীর্ষ পেশাজীবীরা রয়েছেন।

শনিবার বিশিষ্ট নাগরিকদের তরফে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, অ্যাডহক ভিত্তিতে সৃষ্ট আগের দুটি অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশে গঠিত রকিবউদ্দিন কমিশন ও নূরুল হুদা কমিশন তাদের চরম পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করেছে। যার ফলে জনগণের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের ওপর ব্যাপক অনাস্থা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে তীব্র শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান নূরুল হুদা কমিশনের মেয়াদ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেষ হবে। তাই নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের উদ্যোগ এখনই শুরু করতে হবে, যার প্রাথমিক পদক্ষেপ হবে সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়ন করা।

বিবৃতিদাতারা বলেন, এমন আইন প্রণয়ন করতে হবে, যাতে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে ও সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত থেকে নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে সব ধরনের আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। একই সঙ্গে নির্বাচনকালে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাতে নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে দায়িত্ব পালন করতে পারে। বিবৃতিতে বলা হয়, প্রস্তাবিত আইনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য কমিশনারদের যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ করতে ও একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের বিধান রাখতে হবে। এই অনুসন্ধান কমিটি দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হতে হবে, যাতে সব নির্বাচনী অংশীদারদের কাছে এটি গ্রহণযোগ্যতা পায়।গঠিত অনুসন্ধান কমিটির দায়িত্ব হবে, স্বচ্ছতার ভিত্তিতে আইনে বিধৃত যোগ্যতারমানদণ্ডের আলোকে কিছু সৎ, নির্দলীয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের একটি প্যানেল নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা।স্বচ্ছতার অংশ হিসেবে এমনকোন কোন ব্যক্তিকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য অনুসন্ধান কমিটি প্রাথমিকভাবে বিবেচনা করছে, তাদের নাম প্রকাশ ও গণশুনানির আয়োজন করা।কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের জন্য সেসব নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে, তার একটি প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশ করার বিধান আইনে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিবৃতিদাতারা।সরকারের আইন মন্ত্রণালয় দ্রুতই এমন একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেবে এমন আশা প্রকাশ করে মতামত প্রদানের মাধ্যমে এতে প্রয়োজনীয় সহায়তার দেয়ার আশ্বাসও দেয়া হয় বিবৃতিতে।

বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে আছেন, মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মহিউদ্দিন আহমদ, অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর পারভীন হাসান, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের(টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড.ইফতেখারুজ্জামান,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ, অর্থনীতিবিদ ড. আহসান মনসুর, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না ও ড. শাহদীন মালিক, ফেমার সাবেক সভাপতি মুনিরা খান, নারীপক্ষের সদস্য শিরিন হক, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সারা হোসেন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, একশনএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, আলোকচিত্র শিল্পী শহিদুল আলম, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সি আর আবরার, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, লেখক অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আকমল হোসেন, সোয়াস ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের গবেষক অধ্যাপক স্বপন আদনান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, জ্যেষ্ঠসাংবাদিক আবু সাঈদ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস ও শাহনাজ হুদা, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক গোলাম মনোয়ার কামাল, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের ক্লিনিক্যাল নিউরোসায়েন্স সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক নায়লা জামান খান, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, আর্টিকেল ১৯-এর আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সাল, ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সিনিয়র ডিরেক্টর আবদুল আলিম ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন।

উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইতোমধ্যে বিতর্ক শুরু হয়েছে।বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্য দলগুলো কমিশন গঠনের বিষয়ে নিজেদের দাবি তুলে ধরতে শুরু করেছে।যদিও আওয়ামী লীগ বলছে, আগের নিয়মে সার্চ কমিটির মাধ্যমে কমিশন গঠন হবে। এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। জেষ্ঠ্য নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।তিনি মনে করেন, ভোটারদের নির্বাচন বিমুখতা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত।এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সার্বিকভাবে নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে না।রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়।

শেয়ার করুন