সকালে ঘুম থেকে উঠে ঢাকায় বন্ধুকে টেলিফোন করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো ঢাকায় পৌঁছে গেছেন। এরপর তাঁর সংবাদ সম্মেলন। এ ছাড়া রাজধানীর আর বড় খবর কী? বন্ধু বললেন, রোহিঙ্গা নেতার হত্যাকাণ্ডের খবর তো পেয়েই গেছ। গ্রেপ্তার চলছে। এ ছাড়া আর বড় খবর কী আছে? বন্ধু একটু হেসে, একটু সময় নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, একটি বড় খবর আছে। খেলাফত মজলিস নামে দেশে একটি মৌলবাদী দল আছে। তারা বলেছে, বিএনপির সঙ্গে কোনো মৈত্রী অথবা জোট গঠনে যাবে না। কারণ হিসেবে তারা বলেছে, বিএনপি-রাজনীতির সঙ্গে তারা কোনো সংগতি খুঁজে পাচ্ছে না।
বন্ধুর মুখে খেলাফতের খবর শুনে হাসতে হলো। খেলাফত একটি দল? তাকে নিয়ে আবার বড় খবর! টেলিফোনে আমার হাসির ঝংকার শুনে বন্ধু বলল, খেলাফতের নাম শুনে হেসো না। হেফাজতের নাম শুনে তো একদা হেসেছিলে। তারা কী করে গোটা দেশের জন্য কত বড় আতঙ্ক হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে খেলাফতও তদ্রূপ বড় আতঙ্ক হয়ে উঠতে পারে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
বন্ধুর কাছ থেকে খেলাফত দলের বিএনপির জোটে না থাকার আর কোনো ব্যাখ্যা পেলাম না। তবে আমার ধারণা, বিএনপি হাসিনা সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না এই ঘোষণা বারবার দেওয়ায় খেলাফত নির্বাচনে যাবে—এই সম্ভাবনা সামনে রেখে বিএনপির সঙ্গে জোট গঠন বাতিল করে দিয়েছে। এটা আমার ধারণা। বাংলাদেশে খেলাফত মজলিস যত ছোট দল হোক, একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে। এই যে নির্বাচনে যাব না যাব না বলে ক্রমাগত বিএনপি নেতাদের একটি একতরফা চিৎকার, এই চিৎকারের দেয়ালে খেলাফত একটি ফাটল সৃষ্টি করেছে। ফাটলটি নির্বাচনে যাওয়া বা না যাওয়ার প্রশ্নে নয়। জোটে থাকা, না থাকার প্রশ্নে। খেলাফতের সিদ্ধান্ত কি আভাস দেয় সব মৌলবাদীই বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধবে না। তারা আলাদা জোট বাঁধতে পারে।
বিএনপি এখন রোজই আস্ফাালন করছে। তাদের এক দাবি, সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। এটা অবৈধ সরকার ইত্যাদি ইত্যাদি। এই আস্ফাালন দেখে মনে হয়, তাদের বাহুতে যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় হয়েছে। তারা সরকারের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। এই যুদ্ধের নাকাড়া বাজানোর জন্য এবার তারা বৃদ্ধ ডা. জাফরুল্লাহকে হায়ার করেছে। এ ছাড়া মির্জা ফখরুল, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর রায় প্রমুখ তো আছেনই। তারেক রহমান লন্ডনে আছেন। দেশের বাইরে বসে তিনি এখন হাওয়াই গদা ঘোরাচ্ছেন।
এবার সাধারণ নির্বাচন বর্তমান সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে হোক না হোক, যুদ্ধটা হবে দুটি গণতান্ত্রিক দলের মধ্যে নয়, যুদ্ধটা হবে দেশের সেক্যুলার শক্তির সঙ্গে মৌলবাদী শক্তির। দেশ কি বঙ্গবন্ধুর কাঙ্ক্ষিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ থাকবে, না তালেবানের দ্বারা প্রভাবিত একটি মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হবে—দুই বছর পরের নির্বাচনের ফল তার আভাস দেবে।
ভারত যদি একটি ঐক্যবদ্ধ বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারত, তাহলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর গণতন্ত্র নিরাপত্তার ছাতা পেত। কিন্তু মোদির হিন্দুত্ববাদ ভারতের গণতান্ত্রিক ঐক্য অটুট রাখতে পারেনি। আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থান এরই মধ্যে কাশ্মীরে গোলমালের সূত্রপাত করেছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরাট নির্বাচন জয় মোদি সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
সাম্প্রদায়িকতাকে ঐক্যবদ্ধভাবে রোখার প্রয়াস ভারতে এখনো লক্ষ করা যাচ্ছে না। আগামী সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি তার পুরনো হিন্দুত্ববাদের কার্ড খেলবে। এবার নরেন্দ্র মোদি নন, আরো কট্টর আদিত্যনাথ বিজেপির প্রাণপুরুষ। আঞ্চলিক দলগুলো নির্বাচনে প্রাধান্য পাবে। সেক্যুলার কংগ্রেস রাহুল গান্ধীর আমলে ধর্মাশ্রয়ী হয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। শিবের মন্দিরে ধরনা দিয়েও রাহুল ও সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেসকে বাঁচাতে পারেননি। কংগ্রেস এখন ঝড়ে ভাঙা মধ্যযুগের কেল্লা। আগামী নির্বাচনে উঠে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা কম।
কংগ্রেস যদি সামনে না থাকে, তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক ছোট দলগুলোকে একটি ছাতার নিচে এনে ঐক্যবদ্ধ করার আর দল কই? সিপিবি ও সিপিএম—দুটি কমিউনিস্ট পার্টিই দেশের মানুষের কাছে ক্রেডিবিলিটি হারিয়েছে। এ ক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেস যদি সর্বভারতীয় দল হয়ে উঠতে পারে, তাহলে শুধু ভারতের জন্য নয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্যও আশার কথা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভুললে চলবে না যে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় থাকার জন্য তৃণমূল সুপ্রিমো বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে পলাতক বিহারি ও জামায়াতিদের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে। শেখ হাসিনার দিকে মৈত্রীর সংশয়মুক্ত হাত বাড়াতে এখানেই তার বাধা।
এক ভারতীয় সাংবাদিক তাঁর জার্নালে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়েছেন তাঁর রাজনৈতিক যুক্তির সত্যতা প্রমাণের জন্য। ‘কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যা রবি—/শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।/মাটির প্রদীপ ছিল; সে কহিল, স্বামী,/আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি’ কবিতাটির উদ্ধৃতি দানের পর ভারতীয় সাংবাদিক লিখেছেন, ‘যে ভারত সারা এশিয়ায় গণতন্ত্রের আলো ছড়াত, সে ভারত আজ নেই। নেই তার গণতন্ত্রের আলো। এই আলো নিভে যাওয়ার পর জ্বলে উঠেছে ছোট নক্ষত্র বাংলাদেশের আকাশে। এই নক্ষত্র শেখ হাসিনা। মোমের বাতির মতো জ্বলছেন। একটি মোম না নিভতেই আরেকটি মোমবাতি জ্বলে উঠছে। তাঁর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার লোক এই মুহূর্তে উপমহাদেশে নেই। উপমহাদেশে অবশ্যই নরেন্দ্র মোদি ভারতের নির্বাচিত প্রতিনিধি। কিন্তু গণতান্ত্রিক ভারতের প্রতিনিধি নন। এই ব্যাপারে এখন সারা দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্রের শ্বেতশুভ্র একমাত্র তারকা হচ্ছেন শেখ হাসিনা।’
ভারতীয় সাংবাদিকের জার্নালের এই লেখা পড়ার পর আমার মনে হয়েছে, শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা উপমহাদেশে সেক্যুলার ডেমোক্রেসি রক্ষার একটা বড় দায়িত্ব পড়েছে শেখ হাসিনার কাঁধে। এককালে যে দায়িত্বটি ছিল নেহরু, ইন্দিরা, সোনিয়ার মতো নেতাদের কাঁধে, আজ তা সময়ের আবর্তনে বঙ্গবন্ধুকন্যার কাঁধে এসে বর্তেছে। বাংলাদেশে ধর্মান্ধ শক্তির কাছে পরাজয়বরণের অর্থই হবে দক্ষিণ এশিয়ার আকাশে গণতন্ত্রের শেষ তারকাটি নিভে যাওয়া। তাহলে সারা দক্ষিণ এশিয়ায় এক অদ্ভুত সর্বগ্রাসী আঁধার নেমে আসবে।
একই কথা বলেছেন, পাকিস্তানের খাইবার টাইমস পত্রিকায় সিন্ধু ইউনিভার্সিটির এক অধ্যাপক। তিনি লিখেছেন, ‘পাকিস্তান তার প্রতিষ্ঠার পর থেকে গণতন্ত্রের মুখ দেখেনি। জিন্নাহ পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্যুরোক্রেটিক ডিকটেটরশিপ। পরে সেটা পরিবর্তিত হয় মিলিটারি ডিকটেটরশিপে। শেখ মুজিব পাকিস্তানের রাজনীতিতে না এলে বাংলাদেশ যেমন স্বাধীন হতো না, তেমনি পাকিস্তানের অপর অংশগুলোও গণতান্ত্রিক শাসনের স্বাদ পেত না। এখন আবার মিলিটারি ব্যুরোক্রেসি পাকিস্তানে গণ-অধিকার হরণ করে বসে আছে। ব্যবসা-বাণিজ্য সব কিছুর তারা মালিক।
কিন্তু বাংলাদেশে এমনটা ঘটেনি। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যা কন্যা শেখ হাসিনা এখনো গণতন্ত্রের মূল ইস্যুগুলো দাঁত আঁকড়ে ধরে আছেন। তাঁকে হত্যায় দশ দশটি চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশে তাঁর সেক্যুলার শাসন আগামী নির্বাচনে যূথবদ্ধ ধর্মান্ধ শক্তির চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। যদি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে, তাহলে আগামী দশকে দক্ষিণ এশিয়ার অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র জোট গঠনে শেখ হাসিনা নেতৃত্ব দিতে পারবেন, তাতে পাকিস্তানের মানুষও শৃঙ্খলমুক্ত হবে।’
আগামী দুই বছর পর বিশ্বপরিস্থিতি অথবা দেশের অবস্থা কেমন হবে কেউ বলতে পারে না। কিন্তু শ্রীলঙ্কার এক রাজনৈতিক নেতা বলেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির মতো টেকসই গণতন্ত্রের জন্যও দেশটির দিকে চেয়ে আছি। আমরা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত হতে চাই। বাংলাদেশ নিজে উন্নয়নশীল দেশ হয়েও আমাদের অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়েছে। আমরাও চাই গণতন্ত্র নিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের এক্সপেরিমেন্টে শরিক হতে।’
বস্তুত বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন দুটি মতাদর্শের মধ্যে। একই গণতান্ত্রিক লক্ষ্যের দুটি দলের মধ্যে নয়। দেশকে পুনর্গঠনের স্পষ্ট কর্মসূচি আছে শেখ হাসিনার। বিএনপির কোনো কর্মসূচি নেই। তারা বলছে, দেশে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা তারা চায়। এই গণতন্ত্রের কোনো সংজ্ঞা তারা দেশবাসীকে দিতে পারছে না। ২৪ বছর যে পাকিস্তানি অপশাসনে দেশটা পীড়িত হয়েছে, সেই অপশাসনে ফিরে যাওয়াকে তারা বলছে গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়া। বিএনপির শাসনামলে এই গণতন্ত্রের স্বাদ দেশের মানুষ গ্রহণ করেছে। আবার গ্রহণ করতে চাইবে কি?
দেশে বিএনপির রাজনৈতিক শক্তির যে কোনো ভিত্তি নেই, তা তাদের ব্যর্থ বাহুবল চর্চাই প্রমাণ। বিএনপির সাইনবোর্ডের আড়ালে যে দলটি, তা আসলে জামায়াত ও হেফাজত। বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে হবে। এলে দেখা যাবে, বিএনপি এই পরিচয়ের আড়ালে জামায়াত ও হেফাজতের প্রার্থীরাই নমিনেশন পেয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণার সময়ই এই সত্যটি বেরিয়ে আসবে। শাক দিয়ে তো আর মাছ ঢাকা যায় না। যদি তা আবার হয় পচা মাছ! এবার এই পচা মাছের ডেরা কাঁধে নিতে সুধীসমাজ কি রাজি হবে?
লন্ডন, রবিবার, ৪ অক্টোবর ২০২১