শিক্ষা সব সময় আলোর পথ দেখায়। সঠিক শিক্ষা পদ্ধতি বঞ্চিত জনসাধারণকে আধুনিক জাতি হিসেবে গড়ে তোলে। পিছিয়ে পড়া গোত্রকে যুগোপযোগী করে তোলে শিক্ষা। জাতি, বর্ণ, গোত্রের ভেদাভেদ দূর করে সবাইকে এক কাতারে শামিল করতে পারে একমাত্র আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থাই। তবে ভাবনার বিষয় হলো- কেমন হওয়া দরকার দেশের শিক্ষার পদ্ধতি। পঠন-পাঠনের প্রক্রিয়াই নিশ্চিত করতে পারবে শিক্ষার সঠিক মানদণ্ড। বাংলাদেশের শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে- শিক্ষাবিদরা একেকজন একেক রকম পদ্ধতি দাঁড় করানোর কথা বলে আসছেন দীর্ঘদিন থেকে। প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা, সমন্বিত পরীক্ষা পদ্ধতি, সৃজনশীল, মননশীল, মাতৃভাষাভিত্তিক নানা ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক ভাসাভাসি করছে নানা মহলে। তাৎক্ষণিক সংকট (প্রশ্নপত্র ফাঁস) মাথায় নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। চলছে হরেক রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিরা ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে জটিল প্রক্রিয়াগুলো নিয়ে। সমস্যার মূল খোঁজার চেষ্টা থেকে বিরত থাকছেন তারা। যে কোনো ভালো সিদ্ধান্তের পেছনে সঠিক পরিকল্পনা থাকাটা অত্যাবশ্যক। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দরকার পর্যাপ্ত অর্থ। শুধু অর্থ থাকলেই সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। পরিকল্পনা যদি জনবান্ধব না হয়, শিক্ষাব্যবস্থার পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ঢাললেও, জনগণের কোনো উপকার হবে না। তাই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শিক্ষা খাতের প্রস্তাবিত বাজেট এ পরিস্থিতিতে আলোচনার দাবি রাখে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে ৫৩ হাজার ৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এটি এই অর্থবছরে প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে নানা খাতভিত্তিক দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ। তবে প্রস্তাবিত বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়, কারিগরি বিদ্যালয় ও কলেজ নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর ওপর গুরুত্ব বেশি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও অর্থমন্ত্রী বলেছেন উপবৃত্তি, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, স্কুল ফিডিং কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানো হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক (ছেলেমেয়ে) রুমসহ ৭ হাজার বিদ্যালয় নির্মাণ, ৬৫ হাজার শ্রেণিকক্ষ, ১০ হাজার ৫০০টি শিক্ষক কক্ষ, ৫ হাজার বিদ্যালয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হবে। আগের মতোই বিদ্যালয়বিহীন এলাকাগুলোতে এক হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা, সব ইউনিয়ন ও কয়েকটি শহরে আইসিটিভিত্তিক কমিউনিটি লার্নিং সেন্টার স্থাপন করা হবে। ৬৪ জেলায় ৬৪টি জীবিকায়ন ও জীবনব্যাপী শিখন কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনাও আছে। (সূত্র : প্রথম আলো, ৯ জুন, ২০১৮)
শিক্ষা খাত নিয়ে এ বছরে অর্থমন্ত্রীর পরিকল্পনাগুলো খুবই ভালো। কিন্তু ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটের অধিকাংশ অর্থ অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে। শিক্ষার জন্য অবকাঠামো থাকা আবশ্যক, আবার অবকাঠামোর পাশাপাশি শিক্ষা প্রক্রিয়ার পেছনেও অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনা থাকাটাও অধিক আবশ্যক। বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা গোল্ডেন এ প্লাস নির্ভর হয়ে উঠেছে। যে বিদ্যালয় থেকে এ প্লাস বেশি পাবে, সেই বিদ্যালয়টি সবচেয়ে ভালো। অভিভাবকদের পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থার নীতিনির্ধারণী ব্যক্তিরাও এমন ধারণা পোষণ করছে। এর কারণে প্রতি বছর পরীক্ষার ফলের হিসেবে, কোয়ালিটির চেয়ে কোয়ান্টিটির দিকে ঝুঁকছে অভিভাবক ও শিক্ষকরা। ভালো ফল অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীরা মুখস্থনির্ভর হয়ে পড়ছে। শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটির কারণে দিন দিন মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত হচ্ছি আমরা। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী? এর সমাধান আমাদেরই বের করতে হবে।
প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সর্বস্তরে রয়েছে নানা ধরনের গলদ। ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নেই শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও গবেষণানির্ভর পঠন-পাঠন না করে, চলছে মুখস্থনির্ভর প্রক্রিয়া। এমন চিত্র পাবলিক ও প্রাইভেট উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই লক্ষণীয়। শিক্ষা উন্নয়নের নামে কম্পিউটার ল্যাব, এসি ক্লাসরুম, নতুন চেয়ার-টেবিল নির্মাণ, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম নির্মাণের মহোৎসব চলছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। সৃজনশীল, গবেষণাধর্মী ও আধুনিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বর্তমান প্রজš§। শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে বেশি। এ কারণে শিক্ষার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে পারছে না দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা বিদেশে ডিগ্রি করার উদ্দেশ্যে গিয়ে, শুধু অর্থ উপার্জন করছে। নানা সংকট হাতছানি দিচ্ছে এ ক্ষেত্রে।
শিক্ষা খাতের বরাদ্দকৃত বাজেটের অর্থ দুই স্তরে ব্যয় হয়। একটি হলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, অপরটি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা। প্রস্তাবিত বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মোট বরাদ্দ ২২ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। পক্ষান্তরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অধীনে ২৪ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশের শিক্ষা উন্নয়নের জন্য এ অর্থ খুবই কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে প্রস্তাবিত বাজেটে গবেষণার জন্য সুনির্দিষ্ট অর্থ বরাদ্দ নেই। প্রস্তাবিত অর্থ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। শিক্ষার ভিত্তিমূল হলো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর। প্রাথমিক শিক্ষার গোড়া মজবুত না হলে, পরবর্তী স্তরের শিক্ষা জাতির জন্য তেমনটা কাজে আসে না। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের হাজার হাজার শিক্ষক এমপিওভুক্তির দাবিতে দীর্ঘদিন রাস্তায় আন্দোলন সংগ্রাম করল। তারা দিনের পর দিন খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করেছে। মানবেতর এ সব শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির আশ্বাসও দিয়েছে সরকার। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে নতুন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির ব্যাপারে অর্থ বরাদ্দের সুনির্দিষ্ট কথা আসেনি। শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। কিন্তু শিক্ষকদের পেটে দুবেলা দুমুঠো ভাত না জুটলে মানসম্পন্ন মেধাবী শিক্ষার্থী বের হবে না। এ বাজেট ঘোষণায় নন এমপিও শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত আশায় গুড়ে বালি পড়ল। এর প্রভাব বেসরকারি ওইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ওপর পড়বে নিশ্চিতভাবে।
নানা ত্রুটি দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। শিক্ষকরা সরাসরি কোচিং ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে। কোচিংয়ের আড়ালে কিছু অসাধু চক্র প্রশ্ন ফাঁস করছে। প্রশ্নপত্র সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় নামছে শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকরা। যারা প্রশ্নপত্র সংগ্রহে ব্যর্থ হচ্ছে, তারা পরবর্তীকালে বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে জিপিএ-৫ ক্রয় করছে। এর ফলে শিক্ষা এখন ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ভেঙে পড়েছে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা। এমন পরিস্থিতি থেকে খুব দ্রুত পরিত্রাণ না মিললে মূর্খ জাতি হিসেবে পরিচিতি পেতে আমাদের খুব বেশি সময় লাগবে।
ভেঙে পড়া শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন করে তুলে ধরতে পারে একমাত্র সঠিক পরিকল্পনা। বর্তমান পরিস্থিতিতে অবকাঠামো উন্নয়নে জোর না দিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়নে জোর দেয়া বেশি দরকার। এ বিষয়ে আপস করা যাবে না। কোয়ান্টিটি নয়, কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের দ্রুত এমপিওভুক্তির আওতায় আনাসহ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আধুনিক করে গড়ে তুলতে হবে। উচ্চ শিক্ষায় গবেষণার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং প্রাথমিক শিক্ষায় সৃজনশীল (গতানুগতিক নয়) পাঠদান প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যে অর্থ বরাদ্দ পেয়েছে শিক্ষা খাত তা আধুনিক শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য পর্যাপ্ত নয়। তবে শিক্ষার উন্নয়নে শুধু পর্যাপ্ত বাজেট থাকাটাই মূল বিষয় নয়। চাহিদামতো বাজেটের সঙ্গে সমানতালে যুগোপযোগী পরিকল্পনা দরকার। তবেই ভেঙে পড়া শিক্ষাব্যবস্থা সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সাহস পাবে।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
![](https://cloud.matopath.com/mop/2022/03/onnesha-ad.jpeg)