রবীন্দ্রনাথের চিত্রভাবনা || আহমদ রফিক

ছবি-আঁকা বা চিত্রকলা নিয়ে রবীন্দ্রভাবনা সুনির্দিষ্ট ও সুবিন্যস্তরূপে পাওয়া কঠিন। বিচ্ছিন্ন উক্তি চিঠিপত্র বা পরোক্ষ বক্তব্য থেকে যা-কিছু গুছিয়ে নেওয়া যায়। চলে যাবার দুই-আড়াই মাস আগে রানী চন্দের সঙ্গে আলাপচারিতায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছবি সম্বন্ধে কিছু কথা যেন ফের আমাদের মনে করিয়ে দেন : ‘একটা পাখি-শিল্পী তাকে পরিপূর্ণ রূপ দিয়ে যখন মানুষের দৃষ্টিগোচর করে তখনই তা ছবি।’ অবাক হতে হয় যখন এই কথাটাই বিশেষ ভাবে তাঁর পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি’তে (১৯২৫) খুঁজে পাওয়া যায় :

ছবি বলতে আমি কি বুঝি সেই কথাটাই খোলাসা করে বলতে চাই। ছবি পাশ কাটিয়ে যেতে নিষেধ করে। যদি সে জোর গলায় বলতে পারে “চেয়ে দেখো” তাহলেই মন স্বপ্ন থেকে সত্যের মধ্যে জেগে ওঠে। সত্যকে উপলব্ধির পূর্ণতার সঙ্গে একটা অনুভূতি আছে, সেই অনুভূতিকেই আমরা সুন্দরের অনুভূতি বলি।

universel cardiac hospital

‘পরিপূর্ণ রূপ’ কথাটার অর্থ দাঁড়ায় ‘মুখ্যত ছবির গুণ হচ্ছে দৃশ্যতা। যাকে পুরোপুরি দেখতে পাই তাকেই ভালো লাগে। রূপ বলতে এমন এক ফর্ম যাতে বিশেষ রসের যোগে অহেতুক ঔৎসুক্য জাগায়।… এই রূপ সৃষ্টিই আর্ট যে রূপের মধ্যে অহেতুক ঔৎসুক্যের সঙ্গে রিয়ালিটিকে দেখা যায়। ছবির কাজ হচ্ছে সার্থক দেখা দেখানো।… ছবি আঁকতে হলে এমন ভাবকে গ্রহণ করতে হয়, যে ভাবের মধ্যে পূর্ণতার রস আছে, সেই মূল ভাবের অনুগত করে রেখা ও রঙের বিন্যাস সাধন করা চাই।

ছবি-আঁকার বিষয়টাকে বুঝতে গিয়ে দেখা, উপলব্ধি ও দেখানোর পটভূমিতে রবীন্দ্রভাবনার অনুষঙ্গ হিসেবে সত্য, সুন্দর, আনন্দ ইত্যাদি শব্দ বারবার উঠে আসে যেখানে ‘সমস্ত চিত্ত দিয়ে দেখা, সত্যকে খোঁজা” শিল্পসাধনার সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। পার্থিব সত্যের পূর্ণ ও শুদ্ধ প্রকাশ ঘটানো ছবির মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে।

রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করেই বলেছেন, আমাদের আনন্দ হচ্ছে সুস্পষ্ট দেখার। কী দেখলুম তা নয়, যা চোখের সামনে আছে, যা প্রতিদিন দেখছি তা যথেষ্ট নয়। একটা বিশেষ কিছু দেখতে হবে, তার সম্মিলনই এর পরিপূর্ণতা। আমরা যা দেখি তাতে করে অর্ধেক জিনিস দেখি, অর্ধেক দেখি না, তাতে চলে না। থেকে থেকে চমক লাগিয়ে দেখানো চাই। মানুষ তাই বিচিত্র কৌশল অবলস্বন করেছে। সৃষ্টির নিপুণতায় তাকে দৃষ্টির ভিতরে টেনে আনছে।’

‘আটের কথা সাধারণভাবে যা বলবার তা হচ্ছে দেখাবে, যা দেখিনি তা দৃষ্টিাগাচর করবে। তাতে আনন্দ আছে।’ এই দেখার বিষয়েই রবীন্দ্রনাথের কথা :

যখন ছবি আঁকতে শুরু করি, আমার একটা পরিবর্তন দেখলুম। দেখলুম গাছেŸ ডাল পাতায় নানা রকম অভূত জীবজন্তুর মূর্তি। আগে তা দেখি নি। এ একেবারে নতুন ধরনের দেখা। এই রিয়ালিস্টিক মূর্তি কে দেখালে। আর্ট দেখালে। সে বললে, এ অন্যকেও দেখাতে। এই যে দেখার সম্পদ, এর চারিদিকে বিস্তার করে এসেছে মানুষ।… এই যে দেখা এ হচ্ছে ছবির দেখা।

কথাগুলোর মধ্যে শুধু রবীন্দ্রনাথের চিত্রভাবনাই নয়, তাঁর চিত্রদৃষ্টির ও চিত্রচেতনার বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে। বস্তুর অন্তর-রূপ উপলব্ধি ও তা প্রকাশের চেষ্টায় বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কটাও স্পষ্ট হরে উঠেছে। ফুটে উঠেছে অভিব্যক্তিবাদীদের সঙ্গে ভাবনার সামঞ্জস্য। চিন্তার এই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন, সৃষ্টির অর্থ নয় কোনো কিছু অবিতল পুনরাবৃতি করা। মাঠে ঘাটে যা দেখা যায়, তাকে অতিক্রম করে আর একটা রূপ দেওয়া, অন্য চোখে দেখার মধ্যদিয়ে ছবির সত্যরূপ ফুটিয়ে তোলাই চিত্রশিল্পীর কাজ। ব্যক্তি ও তার পরিবেশের মিথষ্ক্রিয়ায় ছবির জন্য।  প্রকৃতি বা দৃশ্যমান কোন বস্তকে (স্বপ্ন বা কল্পনারও হতে পারে) হুবহু তার চেহারায় নয়, তার মধ্যকার অন্য কিছুকে, দর্শনীয় কিছুকে শিল্পীচৈতন্যের নিরিখে এঁকে তোলাই বড় কথা।

চিত্রশিল্পী পল ক্লি (চধঁষ কষবব) বিশ্বাস করতেন, দৃশ্যমানতা আসলে শিল্পীর মনোগহনের উপলব্ধি যা অন্যের চোখে পড়ে না। শিল্পীর ঐ দেখার আবেগ দেখার চিত্ররূপকে রেখা-রঙের মাধ্যমে প্রকাশ করে। এখানে কাজ করে গভীরতর এক স্বজ্ঞা, সহজাতবোধ। সহজাতবোধ থেকে বুদ্ধি-নির্ভরতায়, মননধর্মিতায় উত্তরণ, রীতিগত শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়েও মুক্তির অন্বেষা, আত্মপ্রকাশের আকাক্সক্ষ।

এ ধরনের চিন্তা রবীন্দ্রচেতনায় ছবির অনুষঙ্গ রূপে দেখা দেয় :

কোনো একটা রূপ মনের মধ্যে হঠাৎ জেগে ওঠে, কোনো কিছুর সলে সাদৃশ্য বা সংলগ্নতা না থাক, জগৎটা আকারের মহাযাত্রারূপে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। অসীম অব্যক্ত রেখায় রেখায় আপন নতুন নতুন সীমা রচনা করেআয়তলে যে সীমা, কিন্তু বৈচিত্র্যের অন্তহীন। ছবিতে যে আনন্দ সে হচ্ছে সুপরিমিতের আনন্দরেখার সংযমে সুনির্দিষ্টকে সুম্পষ্ট করে দেখা। নিশ্চিত দেখার আনন্দে অসীমকে স্পর্শ করা।

রবীন্দ্রনাথের ছবির ভাবনায় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল রীতিবদ্ধতা ও গতানুগতিকতার নিয়মকানুন ভেঙে সেখানে অভিনবত্বের রূপ ফুটিয়ে তোলা, নজর-ফেরানো প্রকৃত সারল্যের দিকে। এই নিয়মভাঙার খেলা হয়তো সম্ভব হয়েছে ছবি-আঁকায় কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বাঁধা না-পড়ার জন্য। রবীন্দ্রনাথ যে স্বশিক্ষিত একথাটা কেউ মানেন আবার কেউ মানতে চান না। কিন্তু অস্বীকারের উপায় নেই যে, চিত্রকলার ধরাবাঁধা শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেননি বা বলা যায় সে সুযোগ তাঁর হয়নি, তবে সুযোগ হলেও সে শিক্ষা তিনি কতটা নিতেন বলা কঠিন।

তাই চিত্রকলার তত্ত্বগত দিক যেমন তাঁর নিজস্ব উদ্ভাবনা, তেমনি এর আঙ্গিকগত দিকও। হয়তো তাই হালকা সুরে সুধীন্দ্রনাথকে (১৯২৮) ছবি-আঁকার যথেচ্ছাচারের কথা জানান। চিত্ররীতির শিক্ষাগত নিয়মে বাঁধা পড়েননি বলে তাঁর মন রেখার খেলায় সিদ্ধির বদলে মুক্তি খোঁজে এমন অভিমতও প্রকাশ করেন। এখানেই রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি, সেজন্য অবনীন্দ্রনাখ থেকে নন্দলাল বসু কিংবা তাদের অব্যবহিত পরের গুণী শিল্পীরা রবীন্দ্রনাথের ছবি থেকে শিক্ষার্থীদের অনুসরণযোগ্য কোনো রীতিনীতির মর্মোদ্ধার সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন (আর্ট প্রসঙ্গ-অবনীন্দ্রনাথ)।

রবীন্দ্রনাথ নিজে এ সম্পর্কে অসচেতন ছিলেন না। তবে একথা ঠিক যে শিক্ষার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নিয়ম-শাসন-বহির্ভূত ব্যবস্থার পক্ষে, তাই আধুনিক চিত্রকলার ক্ষেত্রেও সনাতনী স্থবিরতা থেকে মুক্তি নীতিতে বিশ্বাসীা যেমন বিষয়ে তেমনি আমিকে আগল ভাঙার পক্ষপাতি। এমনকি আধুনিকতার চিন্তায় গড়ে ওঠা বেঙ্গল স্কুলের ঐতিহ্য নিষ্ঠায় বাইরের হাওয়া বইয়ে দেবার চেষ্টায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যেজন্য অবনীন্দ্রনাথ-গগলেন্দ্রনাথাদর দেশের বাইরে টানতে না পেরে জাপানি চিত্রশিল্পীকে নিয়ে এলেন সেখানকার চিত্ররীতির সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে।

স্বভাবতই এমন কথা রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই বলা সহজে ছিল যে,

আমি কবি আমি শিল্পী। ছবি ছবিই তার বেশি কিছু নয়, তার কমও নয়া ভারতীয় অজন্তীয় ওসব কিছু না। ভেতরের থেকে এলো তো এলো, না এল। তো এর না। তোমরা যখন আঙ্গিকের কথা বর্ণবিন্যাসের কথা বলো, আমার অবাক লাগে। আমার মনের মধ্যেই আছে ছবির ছায়া- তুলির আঁচড়ে তা ফুটে ওঠে।

উপরের বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথের চিত্রভাবনায় স্বতঃক্রিয়া (অটোমেটিজম) ও স্বতঃফূর্ত শব্দদুটোর গুরুত্ব। বোঝা যায় এ শব্দদুটোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে রবীন্দ্রচিত্রকলা তার সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। তাই দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের কোনো পূর্বপরিকল্পনা নেই, নেই হিসাব-নিকাশের কোনো পদক্ষেপ। সেজন্যই কেউ কেউ রবীন্দ্রচিত্রকে অবচেতনের সৃষ্টি বলে মনে করেন। এখানেই কান্ডিনস্কির চিত্রভাবনার সঙ্গে রবীন্দ্রচিত্রভাবনার মিল, যদিও এ মিল সবদিকে নয়।

রবীন্দ্রনাথের চিত্রভাবনায় স্বতঃক্রিয়ার যে প্রভাব সম্ভবত সেই টানেই তাঁকে প্রাকৃত সারল্যের দিকে ফিরে তাকাতে হয়। এক্ষেত্রে সমকালীন সভ্যতার প্রতি ক্ষ্ব্ধু অসন্তোষের অবদানও কম মনে হয় না। পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারিতে (১৯২৫) রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট কয়েই বলেন :

আধুনিক কলারসজ্ঞ বলছেন, আদিকালের মানুষ তার অশিক্ষিত পটুত্বে বিরল রেখায় যে রকম সাদাসিধে ছবি আঁকত, ছবির সেই গোড়াকার ছাদের মধ্যে ফিরে না গেলে এই অবান্তরভার-পীড়িত আটের উদ্ধার নেই। মানুষ বারবার শিশু হয়ে জন্মায় বলেই সত্যের সংস্কার বর্জিত সরল রূপের আদর্শ চিরন্তন হায় আছে, আর্টকেও তেমনি শিশুজন্ম নিয়ে অতি অলংকরণের বন্ধনপাশ থেকে বারে বারে মুক্তি পেতে হবে।

এই চিন্তার দিকে চোখ রেখেই সম্ভবত কোনো কোনো চিত্রসমালোচক রবীন্দ্রচিত্রকর্মে শিশুসুলভ সারল্যের প্রতিফলন দেখতে পেয়েছেন। প্রখ্যাত চিত্রসমালোচক আনন্দ কুমারস্বামীও শিশু-সারল্যের কথা উল্লেখ করেছেন। অতিরঞ্জনের হাত থেকে ছবিকে মুক্তি দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রাকৃত সারল্যের কথা ভেবেছেন। এর সঙ্গে আধুনিকতার কোনো সংঘাত আছে বলে তিনি মনে করেন না।  শুধু চিত্রশিল্পেরই নয়, রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ও বিচারে ভারজর্জর, স্থবির, ক্লিষ্ট সভ্যতার মুক্তিও একই পথে। সমকালের বিশ্বাসহীন, আদর্শহীন, সততাহীন ও আনন্দহীন অন্ধঘুগের তাড়নাতেই যেন রবীন্দ্রনাথ শিশুসুলভ সহজ সারল্যের জগতে এবং প্রাকৃত স্বাচ্ছন্দ্যের মুক্ত পরিবেশে ফিরে যেতে চেয়েছেন যাক বলা যায় প্রত্যাবর্তন, রাবীন্দ্রিক ভাষায় আর্টের নব-জন্মান্তর চিত্রসমালোচক আনন্দ কুমারস্বামীসহ দেশী-বিদেশী কোনো কোনো চিত্ররসিক রবীন্দ্রনাথের ছবিতে শিশুসুলভ সরলতার পাশাপাশি প্রাগৈতিহাসিক আদিমতার প্রতিফলন ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন। রবীন্দ্রনাথের উল্লিখিত চিন্তাভাবনার বৈশিষ্ট্যই হয়তো তার কারণ। তাছাড়াও প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীরূপ তাঁর হাতে কম আঁকা হয়নি।

শুধু-যে বর্তমান সভ্যতার অনাচার ও বর্বরতার প্রতিরূপ খুঁজতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রাগৈতিহাসিক সময়ের দিকে ফিরে তাকান (শঙ্খ ঘোষ) তাই নয়, ‘উদ্ভ্রান্ত আদিম যুগের’ অচিন্তনীয় পরিবেশে মানুষের আবির্ভাব ও তৎকালীন মানবসভ্যতার আদিম আনকোরা রূপটিকে জানা ও বোঝার জন্যও বিস্ময়ভরা কৌতূহল রবীন্দ্রনাথের বরাবরই ছিল। রেখা ও রঙে কৌতূহলী চেতনার প্রকাশ ঘটানো তাঁর পক্ষে স্বাভাবিকই ছিল। এজন্য ছবিতে ‘প্রিমিটিভিজিমের’ প্রকাশ খুঁজতে যাওয়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে বলে মলে হয় না। ‘প্রিমিটিভিজম কিংবা ‘নিওপ্রিমিটিজম’ (আদিমতা বা নব্য আদিমতা) যে নামেই এই শৈল্পিক চিন্তাকে চি‎িহ্নত করি না কেন, রবীন্দ্রনাথের ছবিতে এর প্রকাশ ভিন্ন এবং তা একেবারেই রাবীন্দ্রিক চেতনা ও বিশ্বাসে স্নাত। তাছাড়া ‘প্রিমিটিভিজম’ আর প্রাকৃত সারল্য কিংবা প্রাগৈতিহাসিক মুক্ত স্বাচ্ছন্দ্য চরিত্রবিচারে ঠিক এক জিনিস নয়।

রবীন্দ্রনাথের চিত্রভাবনায় আরও একটি বিশেষ প্রত্যয় বরাবর কাজ করে গেছে, প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয়। যেখানে প্রাকাশ পেয়েছে প্রাণের সজীবতা সৌন্দর্যও আপ্রন্দর নিহিত চেতনা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় :

ছবি হচ্ছে গিয়ে একটা ফর্ম-এর হারমনি রঙের হারমনির সমাবেশে একটা এক্সপ্রেশনকে রূপ দেওয়া। তার ধারা বা বাইরের রূপ আলাদা হোক না কেন, মূলত তারা একইা মানুষের প্রত্যেকেরই ইনডিভিজুয়াল এক স্বাতন্ত্র্য আছে। প্রত্যেককেই আলাদাভাবে দেখছি, বিভিন্ন রূপে তা প্রকাশ করছি, কিন্তু সেইটেই বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা হচ্ছে সেই ভঙ্গির ভিতর দিয়ে বিভিন্ন ভাষার ভিতর দিয়ে যে আবেদন ফুটিয়ে তোলে, সেখানেই হল সর্বজনীনতা; সেখানেই ইটার্নাল হিউম্যানিচির ইউনিটি দেখা যায়।

ছবির সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের এই যে সব চিন্তাভাবনাযথার্থভাবে দেখা এবং সার্থকভাবে দেখানোর সর্বাত্মক চেষ্টা! তার নিহিত সত্তাকে তুলে ধরার চেষ্টা, তাকে আদিম সারল্যের চেতনায় নিষিক্ত করে তোলারবীন্দ্রনাথকে অভিব্যক্তিবাদীদের সঙ্গে এক কাতারে বসিয়ে দিতে সাহায্য করেছে। কিন্তু রবীন্দ্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য হল যে, তিনি  শুধু স্বতঃফূর্ত অভিব্যক্তির কথাই বলেন না, বর্ণময় আবেগ প্রকাশের কথাই কেবল বলেন না, তিনি সেইসঙ্গে মানবিক আবেগ! স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণের আবেগ! প্রাণের আনন্দের কথাও বলেছেন। বলেছেন সর্বজনীন উপভোগ্যতার কথা উপভোগযোগ্য রসের কথা। প্রাগৈতিহাসিক মানবের মধ্যে এ জিনিসটা ছিল। হয়তো তাই রবীন্দ্রনাথ সেদিকে বারবার আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, নিজেও যেতে চেয়েছেন সেই পথ ধরে। তাই তিনি বলতে পেরেছেন :

সত্যিকারের রস একটা সেখানে ভাষার তফাতে কিছু আসে যায় না।… যেখানে যেটুকু প্রাণের বিষয়যা আনন্দ দেয়, যে সৌন্দর্ষে মুগ্ধ হই, রস পাই ঐ ইটার্নাল এবং ইউনিভার্সাল। সেখানে জাতিভেদ নেই। ভাষার তফাতে কোনো ক্ষতি করে না। ‘প্রিমিটিভরাও’ তো ছবি এঁকে গিয়েছে তারা যা বোঝাতে চেয়েছে, তারা যে রস পেয়েছে তাদের সৃষ্টি কাজে, তা আমাদের বুঝতে বা রস পেতে তো কোনো কিছু ভাবতে হয় না।…  আর্ট হচ্ছে রসের বাহন। যে জিনিস দেখে আনন্দ পেয়েছি… সেই আনন্দ সেই রস যখন অন্যের ভিতর চালনা করে দেওয়া যায় তাকেই বলে আর্ট; তা তুমি ছবি এঁকেই পারো বা সাহিত্যে… নয় গানে।

ছবির এই সর্বজনীন উপভোগ্যতার কথা এর রসাস্বাদন ও আনন্দ-উৎসরের কথা রবীন্দ্রনাথের চিত্রভাবনাকে বারবার আলোড়িত করেছে। বলেছেন, ‘সত্য তার রূপ ছবিতে আনন্দ দিয়েছেন’ বলেছেন দৃষ্টি ও সৃষ্টির পরিপূর্ণতা ও আনন্দের কথা। চৈতন্যের আলোয় সত্যকে পরিপূর্ণরূপে দেখা ও দেখানোর আনন্দ রবীন্দ্রনাথের চিত্রভাবনার একটি মৌল বিষয়। চিত্রশিল্পী যামিনী রায়কে লিখেছেন :

ইন্দ্রিয়ের ব্যবহারে আমাদের জীবনের উপলব্ধি।… দৃষ্টির ওপরে দেখার ধারা আমাদের চেতনাকে উদ্রেক করে রাখে।… যে দেখায় মনকে টালে না, যা একঘেয়ে, যার বিশেষ রূপের বৈচিত্র্য নেই তার মধে! মন নির্বাসিত হতে থাকে। ছবি একটি নিশ্চিত প্রত্যক্ষ অস্তিত্বের সাক্ষী। তার ঘোষণা যত স্পট হয়, যতই সে হয় একান্ত ততই ভালো।… যখন ছবি আঁকায় মনকে টানল তখন দৃষ্টির মহাযাত্রার মধ্যে মন স্থান পেল। গাছপালা জীবজন্তু সকলই আপন আপন রূপ নিয়ে চারদিকে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠতে লাগল। রেখায় ও রঙে সৃষ্টি করতে লাগল যা প্রকা হয়ে উঠছে।… এই যে নিছক দেখবার জগৎ ও দেখাবার আনন্দ এর মর্মকথা বুঝবেন তিনি… যিনি যথার্থ চিত্রশিল্পী।’

এই দেখাবার আনন্দ সব ধরনের শিল্পেরই অন্বিষ্ট, কমিউনিকেশনের মূলকথা। তাই ‘অবসর কালে বিনা প্রয়োজনে’ ছবি-আঁকার কথাটা অর্ধেক ঠিক। আদিম শিল্পে (নৃত্যগীত বাদ্য ও চিত্রকলায়) প্রয়োজনটাই ছিল বড়, এখন প্রয়োজনের চেহারাটা পাল্টেছে, এই যা।  তবে প্রয়োজন অপ্রয়োজন দুইয়ের টানেই শিল্পকলা। তাঁর ছবির নিজস্ব ভাষা তৈরির পেছনে রবীন্দ্রনাথের চিত্রভাবনা সত্য, সুন্দর ও আনন্দের যে ভিত্তি নিয়ে দাঁড়ায় তা হঠাৎ পাওয়া বিষয় নয়, দীর্ঘদিনের সযতেœ রচিত শিল্পসূত্র। তেত্রিশ বছর বয়সে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের নিসর্গ-সৌন্দর্ঘে উদীপ্ত রবীন্দ্রনাথ পদ্মা-ইছামতি-গড়াই-আত্রাই-এর উপর দিয়ে এক একটি উজ্জ্বল দিনের রংফেরা, নদীতীরে বন ও গাঢ় সবুজ শস্যক্ষেতের রৌদ্রস্নানে প্রফুল্ল হয়ে ওঠা এবং সেই জীবন ও জনপদের বহুবিচিত্র রূপ দেখে দেখে এক অজানা আকর্ষণে ছবির জগতে পৌঁছে গেলেন। চারপাশের উদ্দীপক উপাদান ছবির তত্ত্বগত রোধ নির্মাণেও এগিয়ে এল। স্পষ্ট হল যে :

ছবিতে জিনিসের একটিমাত্র অংশ আমাদের চোখের সামনে ধরে দেওয়াতে শুধুমাত্র দৃশ্যসৌন্দর্যের উপভোগটাই তীর হরে ওঠে। আর্ট মাত্রেরই কাজ হচ্ছে বিশ্বের যেটুকু আমাদের মনোহরণ করে সেইটুকুই সযতেœ অন্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে অবিমিশ্র উজ্জ্বল করে ধরা। সত্যের যেটুকু ছেঁকে নেওয়া, সাজিয়ে তোলা আর্টিস্টের কাজ। সেইজন্যে আমার মনে হয় বিশুদ্ধ আর্ট হচ্ছে ছবি ও গান।

এই যে দৃশ্য সৌন্দর্যকে নিংড়ে, পরিশ্র“ত করে আনন্দ-সৌন্দর্যে রূপান্তরিত করা, যাকে বলা যায় ছবি-আঁকাএখানের রবীন্দ্রনাথ দেখতে চান সুপরিমিতের প্রকাশ। তাতে করে ছবি বিশুদ্ধ বা অবিশুদ্ধ যে শিল্পের ঘরানাভুক্ত হোক না কেন ক্ষতি নেই। পরিমিতি ও  সংযমের কথাটাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বভাবসুলভ কৌতুকের ভঙ্গিতে তাঁর মতো করেই বলেছেন। বলেছেন যে :

অমিতা যখন সুমিতাকে পায়, তখন সে চরিতার্থ হয়। ছবিতে যে আনন্দ সে হচ্ছে সুপরিমিতির আনন্দ, রেখার সংযমে সুনির্দিষ্টকে সুস্পষ্ট করে দেখা, মন বলে ওঠে, নিশ্চিত দেখতে পেলুমতা সে এক টুকরো পাথর, একটা গাধা,  একটা কাঁটাগাছ, একজন বুড়ি যাই হোক! নিশ্চিত দেখতে পাই যেখানেই, সেখানেই অসীমকে স্পর্শ করি আনন্দিত হয়ে উঠি।

রবীন্দ্রনাথের চিত্রভাবনায় এই আনন্দের কথা, উপভোগের কথা বার বার এসেছে। এসেছে সত্যের সঙ্গে, পূর্ণতার উপলব্ধির সঙ্গে মিশে। এই আনন্দের টানে কবির ছবি-আঁকা, ভিন্ন ফর্মে ভিন্ন রূপে আনন্দের উদ্ভাস ঘটানোর কাজে হাত লাগানো। এ উদ্দেশ্যেই ঝড়ো গতিতে রেখা ও রঙের সমন্বয়ী বিন্যাস ঘটিয়ে সহজ, সরল, বিচিত্র রীতির পথ ধরে চলাসেখানে প্রচলিত বা প্রতিষ্ঠিত রীতি যদি স্থান পায়, তো ভালো, না পেলে ক্ষতি নেই। এই আঁকার কাজে প্রাকৃত ভাবের মধ্যে মানবিক ভাবের উদ্ভাস ঘটানোই বড়ো কথা। রবীন্দ্রনাথ কথাটা নানা উপলক্ষে বহুবার বলেছেন, প্রকৃতিকে হুবহু তুলে ধরা চিত্রকলার কাজ নয় (তা হলে তো ফটোগ্রাফিই যথেষ্ট) অর্থাৎ প্রকৃতি আসবে, বিষয় আসবে। ‘শিল্পীচেতনার হাজার চোখে প্রতিসরিত হয়ে ভিন্ন রূপ নিয়ে ধরা দেবে ভিন্ন এক ছবি হয়ে, যে ছবি আগে কেউ দেখেনি। ছবি সম্পর্কে তার ভাবনার কিছুটা প্রকাশ ঘটেছে ‘আলেখ্য’ (পরিশেষে) কবিতায়।

তোরে আমি রচিয়াছি রেখায় রেখায়

লেখনির নটন লেখায়।…

সীমায় বাঁধিবে তোরে সাদায় কালোয়

আঁধারে আলোয়।

অমূর্ত উপলব্ধিকে রেখায়-রঙের মূর্তরূপে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্যেই ছবির আত্মপ্রকাশ। আত্মপ্রকাশ শিল্পীরও। রবীন্দ্রচিত্রভাবনার এটা গোড়ার কথা।

 

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে