বুনো মোষের মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বাসটা এগোতে থাকে। পাগলা হাতির মতো গ্রাম, বসতি, ক্ষেত ফসল সবকিছু তছনছ করে দিতে মত্ত-উন্মত্ত হয়ে ছুটছে যেন। এ যেন সুঁইয়ের ফুটো দিয়ে লাঙলের ফলা সেঁধিয়ে দেবার মতো কা-।
ভোজবাজির মতো ব্যাপারটি ঘটে গেল।
কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাইওয়ে থেকে নেমে ডানে মোচড় দিয়েই চড়াই-উৎরাই মাড়িয়ে, লাফাতে লাফাতে বাস এগোতে থাকে। ওদিকে হেলপার-ওস্তাদ ডানে, বামে, সোজা, সাইড দিয়া, ব্রেক ব্রেক, হালকা চাইপা এমনই নানা রকম নির্দেশনা দিয়ে চলেছে। সে সঙ্গে গলা চড়িয়ে, বাসের বডিতে চাপড় পিটিয়ে হেকে চলেছে সাবধান। সামনে গাতা। ডাইনে খাল। বামে ঝাক্কি-, পথের গায়ে ছাল-বাকল নাই।
আমরা যাত্রীরা সবাই প্রায় ঝিমোচ্ছিলাম তখন। কেউ কেউ আবার গভীর ঘুমে ডুবে গেছে কখন যেন। তখনই বলা নেই, কওয়া নেই গ্রামের ভেতর এক রাস্তা ধরে গোত্তা খায় বাসটি। তারপরই হর্ন বাজাতে বাজাতে, ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে, পুরো শরীরে ঝুম ঝুম শব্দ তুলে দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটতে থাকে বাস। সে সঙ্গে গগণবিদারি চিৎকার হেলপারের। আমাদের কথা ওদের কানেই ঢোকে না। তাচ্ছিল্য ভরে, সবকথা উপেক্ষা করে ড্রাইভার স্টিয়ারিং ধরে আছে তো ধরেই আছে। মত্ত নেশায় যেন পেয়ে বসেছে ড্রাইভারকে। আর সে নেশায় মাঝে মাঝে রস ঢালছে ওর সাগরেদ-হেলপার। নিজে সিগেরেট জ্বেলে ওস্তাদের ঠোঁটে গুঁজে দিচ্ছে, “টান দেইন ওস্তাদ জোরসে টান দেইন।” যাতে সিগেরেট জ্বালাতে গিয়ে ওস্তাদ আবার তালকাটা না হয়ে পড়ে।
ওস্তাদও ঝুঁকে ঝুঁকে, ঝুলে ঝুলে নেশামগ্ন হয়ে টেনে নিতে থাকে বাস। বাসের বাইরে মানুষের কর্কশ চিৎকার! ভেতরে আমাদের আর্তচিৎকার কোনোকিছুকেই ভ্রƒক্ষেপ করছে না। ও একমনে ওর মতো চালিয়েই যাচ্ছে। তবে আর্তচিৎকার আমাদের প্রাণের জন্যে যত না, তারচেয়ে বেশি পথচারীদের প্রাণের কথা ভেবে। পথচারীদের প্রাণ যদি যায় তাহলে আমাদের কারও প্রাণ থাকবে কিনা সন্দেহ। হাটুরে মারের চোটে তখন সবার জীবনাবসান অবধারিত। কেননা বাসটি আসলে যাচ্ছে হাটের ভেতর দিয়েই।
হপ্তার হাটবার আজ। তাই পথের দুধারে বিক্রেতারা পসার সাজিয়ে বসেছে। কলাটা, পেঁপেটা, মুরগি-হাঁস, আন্ডা! কত না বাহারে সব পণ্য। আর সেসব পসার ঘিরে মানুষে মানুুষে লোকারণ্য। তাদের ওপর দিয়েই প্রায় বাসটি চালিয়ে আসছে ড্রাইভার। লোকজন ছিটকে পড়ছে এদিক-ওদিক। কেউ কেউ টুকরি মাথায় চাপিয়ে দৌড়াচ্ছে। আর ড্রাইভারের মা-বাপ চৌদ্দগোষ্ঠী তুলে গাল-মন্দ করছে।
শেষ বিকেল। সূর্য পাটে যাবার আয়োজন চারদিকে। তাই কেনাকাটার তুমুল ব্যস্ততা দোকানে দোকানে। হাটুরেদের সন্ধার আগে আগে বাড়ির পথ ধরার প্রাণান্তকর চেষ্টা। না পারলে শেষে অন্ধকার পথে নানা ঝকমারি। তাই ক্রেতা-বিক্রেতার শেষ চাপটা যখন হাট জুড়ে তখনই বাসটি পাগলা হাতির মতো তা-ব শুরু করেছে হাট প্রাঙ্গণে।
ড্রাইভারের পাগলামোটা আসলে শুরু হয়েছে আরও অনেক আগে থেকেই। গোপালগঞ্জ থেকে ফিরছি আমরা। রিজার্ভ বাস নিয়ে। গিয়েছিলাম টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর মাজার দেখতে। তার আগে মেহেরপুর গিয়েছিলাম বদ্যিনাথ তলায়। স্বাধীনবাংলা সরকারের দ্রষ্টব্যস্থানগুলো দেখতে। আমরা যখন ঘুরে ঘুরে সব দেখছিলাম তখন একবার দেখলাম বাসের ড্রাইভারকে। আমগাছের ছায়ায় বাসটি রেখে ইঞ্জিন পরীক্ষা করছে। অন্য একজন, হেলপারের সঙ্গে মিলে বডি সাফ করছে। দুদিন ধরে একটানা পথে পথে ঘুরছে বাসটি। তাই ওকে তেল জল খাইয়ে একটু টাটকা করে নিচ্ছে বুঝি। এরপর হঠাৎ কোথায় যেন চলে গেল ড্রাইভার। ওকে না দেখে হেলপারকে জিজ্ঞাসা করলাম। ও-ই জানালো ওস্তাদ চান করতে গেছে। স্নানের কথা শুনে আমাদেরও গা চড়চড় করে উঠল। বাসের মতো দুদিন ধরে আমাদের গায়েও তেলজল পড়ছে না। তাই স্নানের জায়গা খুঁজতে আমরা একে-ওকে তাড়া দিচ্ছিলাম। কিন্তু কোথায় গিয়েছে তা আর বলতে পারল না হেলপার। বললাম, যতক্ষণ সম্ভব আপনারা ঘুমিয়ে নেন। এরপর আবার রাতভর রাস্তায়।
হেলপার গা করল কিনা বোঝা গেল না। শুধু বলল অসুবিধা নাই, অভ্যাস আছে।
আমরা আর কথা না বাড়িয়ে ফের ঘোরাঘোরিতে মন দিই। এখানে ওখানে চলতে চলতে একসময় থমকে দাঁড়াই। বড্ড মায়াবী এক সুর কোত্থেকে যেন ভেসে আসছে। বুকের ভেতরটা ঠিক মুচড়ে ওঠে সে সুর শুনে।
জব্বর বাজাচ্ছে গো! কার ব্যাটা গো! কলজে ছিড়ে সুর আসছে যেন! গাছ তলায় বসে গা জুড়োচ্ছে এক রিকশাঅলা। ওর মুখেই বাজছে এমনই প্রশংসা।
আমরাও কান পেতে সুরের আল ধরে ঠিকই পৌঁছে যাই উৎসে-দেখি রোদে গামছা লুঙ্গি মেলে দিয়ে পাশেই ছায়ামত জায়গায় বসে একমনে বাঁশি বাজাচ্ছে ড্রাইভার। চোখ দুটো বুজে, সুরের তালে তাল পা নাচাচ্ছে। শরীরও নানাভাবে বেঁকে বেঁকে সংগত করছে সুরের তালে। পাছে ওর মগ্নতা নষ্ট হয়ে যায় তাই আর পা বাড়ালাম না। নিরাপদ দূরত্বে থেকে ওর বাঁশির সুরে শরীর-মন ভেজাতে থাকি। এবং ওর আড়ালে থেকেই একসময় নীরবে চলে আসি। ও ঘুণাক্ষরেও জানতে পারল না ওর অমন গুণের কথা আমরা কজন ঠিকই জেনে ফেলেছি।
যার কণ্ঠে সুর, হৃদয়ে সুরের ঝরনাধারা, সে মানুষটিই এখন অমন বুনো পশুর মতো আচরণ করছে কেন ঠিক বুঝতে পারলাম না।
– মুরাদ বলল, কদিন ধরে নেশাভাং করতে পারছে না হয়তো, তাই টেম্পার লস্ করছে।
– রঞ্জন বলল, ড্রাইভার আর মেথর, নেশাছাড়া ওদের চলেই না। এ ব্যাটাকে ছেড়ে দে, গলা ভিজিয়ে আসুক।
– তারপর সবাই পটল তুলি! ঝিকিয়ে ওঠে মুরাদ ওর কথা শুনে।
– বরং নেশা করলেই ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছার গ্যারান্টি আছে। তা না হলে অমন পাগলা হাতির মতো কখন কোথায় কার উপর দিয়ে বাস চালিয়ে দেবে তার ঠিক নেই। হয়তো এখনই ব্যাটার মাথার তার ছিড়ে গেছে। তাই উম্মাদের মতো গাড়ি চালাচ্ছে। বলে হাসতে থাকে রঞ্জন।
– আমাদের মধ্যে আর একটুও সংশয় নেই-আমরা সবাই একমত ড্রাইভার এদিককার পথ ঘাট কিছুই চেনে না। ওকে হায়ার করা একেবারেই ঠিক হয়নি। শরীর ঝেঁকে উঠে ননির।
– ঝন্টু বলল, চরম ভুল হয়েছে। এখন এর মাসুল দিতে হবে কড়ায়-গ-ায়।
মুরাদের মেজাজ একেবারে তুঙ্গে। আমি তখনই সাইফুলকে বললাম, যাব ফরিদপুর-গোপালগঞ্জ, কুষ্টিয়া তখন ময়মনসিংহ রুটের বাস নিচ্ছিস কেন? ছোট্ট রুট। ঢাকা থেকে মাত্র আড়াই ঘণ্টার জার্নি ময়ময়সিংহ। ওরা লং জার্নিতে অভ্যস্থ না। আর আমাদের যাত্রা চারদিনের। বেশিরভাগ সময়টাই বাসে কাটবে। তার ওপর পদ্মার ওপাড়ে যারা বাস চালায় তারা সেসব পথ-ঘাট ভালো চেনে। ওদের থেকেই বাস হায়ার কর। শেষে বললাম, যশোর-কুষ্টিয়ার বাস হলে ভালো হয়। কিন্তু না আমার কথা গ্রাহ্যই করল না সাইফুল। বলল, কমে পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় চার হাজার টাকা সেভ। এখন সেভ না বরং হাসপাতালে কতটাকা ঢালতে হয় তার জন্যে তৈরি থাক।
– রঞ্জন বলল, এদিককার বাস হলে কেউ হাইওয়ে ছেড়ে পুরনো রাস্তায় ঢোকে! কবে সে রাস্তা পরিত্যাক্ত হয়ে গেছে। এখন পাড়ার রাস্তা হয়ে গেছে সেটি।
আসলেই তাই। আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা। এখানে-ওখানে খানাখন্দকে ভরা। কোথাও রাস্তার ছাল-বাকলা এমনভাবে উঠে গেছে যেন পথ বুড়ো চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। মানুষের বাড়িঘর উঠোনের ওপর দিয়ে একসময় তৈরি হয়েছিল এ রাস্তা। এখনও পথের দুধারে এবাড়ি-ওবাড়ির উঠোন। বাড়ির বৌ-ঝিরা গল্প করছে। মাথার উকুন বেছে দিচ্ছে। কেউ মাথায় তেল মেখে দিচ্ছে। কেউ দিচ্ছে বিনুনি বেঁধে। মোরগ-মুরগি উঠোনে ঠুকরে ঠুকরে কী সব খাচ্ছে। খোয়ারের আশপাশে হাঁসদের জমাট ভিড়। ওদিকে খেয়াল করার সময় কোথায় ড্রাইভারের। অনবরত হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে। বাসের মধ্যে, হর্নের শব্দে খাওয়ায় মগ্ন মোরগ-মুরগিগুলো কেমন আঁৎকে উঠে কক্ কক্ করে ডেকে উঠছে। এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ছে যেন। হাসেরা থপ্ থপ্ পা ফেলে কৎ কৎ শব্দ তুলে পেছন বাড়ির আলো-আধারিতে মিশে যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এমনি করে নেচে কুদে পুরো ফরিদপুর পাড়ি দিল পুরনো রোড ধরে।
তখন থেকেই সবাই বলাবলি করছিল ড্রাইভার এদিককার পথঘাট কিছু চেনে কিনা সন্দেহ!
আমি নিশ্চিত পথঘাট সব অচেনা ড্রাইভারের। আন্দাজের ওপর দিয়ে চলছে। সঞ্জয় না থাকলে বুঝতেই পারতাম না। কোথায় আসছি কোথায় যাচ্ছি। ওর বাড়ি এ এলাকায়। পথ-ঘাট সবই ওর চেনা। তাই তো সঞ্জয় বলল-পুরনো রোড ধরে যাচ্ছে বাস। কেন যাচ্ছে। কী আশয়-বিষয়। জানার জন্যে অনেকবার ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করেও কোনো উত্তর মেলেনি। ক্ষুব্ধ কণ্ঠ মুরাদের।
একসময় ফের হাইওয়েতে এসে ওঠে বাস। এতক্ষণ ঝাকুনিতে শরীর প্রায় থেতলে গেছে সবার। তাই মসৃণ রাস্তায় চাকা পড়তেই সবার ঝিমুনি চলে আসে। অনেকেই ঘুমিয়ে পড়ে ক্লান্তিতে। ঘুম কিংবা নিদ্রার আবেশে যখন সবাই মগ্ন, তখনই বুনো মোষের মতো খ্যাপাটে-ভঙ্গিতে হামলে পড়ল কাঁচা সড়কের ওপর। উন্মাদের মতো বাস চলল এতক্ষণ। শেষে হাট-বাজার ছাড়িয়ে পথের একপাশে বাস রেখে মুহূর্তে হাওয়া ড্রাইভার। গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে পেছন পেছন হেলপারও উধাও।
আমরা যেন সবাই আকাশ থেকে পড়লাম। এ কোন ভেল্কিবাজির মধ্যে পড়েছি। বলা নেই কওয়া নেই বাস থামিয়ে নেমে পড়ল। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কখন ফিরবে কোনো কিছু না জানিয়েই এভাবে চলে যাওয়ার মানে কী! রাগে অপমানে আমাদের গা চিড়বিড় করছিল। তার কিছুটা শোধ হয় সাইফুলকে ঝেড়ে।
তোর মধ্যে যদি সামান্য ম্যাচুরিটি থাকতো তাহলে ময়মনসিংহের বাস নিয়ে গোপালগঞ্জ আসতি না। কথা বলছিল আর রাগে চুল টানছিল মুরাদ।
– না এলেই পারতি, এখন অতো ঝাল দেখাচ্ছিস কেন?
– একমাস ধরে প্রোগ্রাম করছি আসব বলে, তখন না এলেই পারতি, এ কেমন কথা সাইফুল!
তিমির এতক্ষণ চুপটি ছিল, এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে ওর। তুই চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনের পরিচয় দিয়েছিস। অজানা-অচেনা পথে একটা ভিনদেশি ড্রাইভার এনে ছেড়ে দিয়েছিস। এখন ঝোপ বুঝে কোপ মারছে কখনও। কখনও আছাড় মারছে মাথায় তুলে! কিচ্ছুটি বলার জো নেই। রীতিমতো সার্কাস দেখছি চেয়ে চেয়ে!
– বাসটাতো আমার! আমার স্বার্থ আছে তোদের ওপর দিয়ে দুপয়সা আয় করবো। তাই তো এ বাস নিয়েছি। এবার হলো তো!
সাইফুলের কাটা কাটা আর তেতো কথায় সবাই চুপ মেরে যায়। গুমোট পরিস্থিতি বাস জুড়ে।
– শাম্মা বলল, এদিকে নিশ্চয়ই কোনো চোলাইখানা আছে। খবর পেয়ে চলে এসেছে গলায় ঢালতে।
– গ্রামের ভেতরে চোলাইখানা! মনে হয় না। আমাদের গ্রামের ভেতর রেখে শালা সটকে পড়েছে কোথায় যেন। ভুল না বললে পতিতালয়েও যেতে পারে। ড্রাইভার বলে কথা। ওদের চরিত্রের বিশ্বাস নেই। নির্ঘাৎ কোথাও গিয়ে ফুর্তি করে কাটাচ্ছে।
– যা কী বলিস! হয়তো প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেছে। লজ্জার ভঙ্গিতে বলে মনিশ।
প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এতক্ষণ লাগে। কোন অন্ধকারে কখন গা ঢাকা দিয়েছে খেয়াল আছে! শাম্মা রাগে মুঠো পাকিয়ে একটা ঘুষি ঝাড়ে ওর উরুর ওপর।
ওদিকে বাসের বাইরে মানুষের চেচাঁমেচি চিৎকার। রিকশার বেল অনবরত বাজছে। কান ঝালাপালা হবার জোগাড়। এমনিতে কাঁচা রাস্তা। মাঝখানে অল্প একটু জায়গা ইটের সলিং করা। রিকশা যেতে পারে। দুটো রিকশা হলেই ক্রস করতে সমস্যা হয়ে যায়। তখন ঢেংগামত অতবড় পঞ্চাশ সিটের বাস রাস্তায় ফেলে রাখলে পথচারি হাঁটে কোথা দিয়ে। রিকশাই বা যাবে কোন পথ দিয়ে। তীব্র হট্টগোল বাইরে। সঞ্জয় বলল, গণবিক্ষোভ শুরু হওয়ার পথে। যেকোনো সময় গাড়ি উল্টে ফেলে দেবে ক্ষেতে। না হয় বাসে আগুন ধরিয়ে দেবে, মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। আমরা এভাবে বসে থাকলে শেষে পালাবার পথও খুঁজে পাবো না।
– বলে কী হবে! কতক্ষণ সময় নেবো? দু’ঘণ্টায়ও যদি ড্রাইভার না ফেরে তখন? মুরাদ ভীষণ উত্তেজিত।
– তারপরও চল কজন মিলে করজোড়ে সবার কাছে মাফ চাই এবং আমরা যে পরিস্থিতির শিকার তা খুলে বলি। সঞ্জয়ের অনুরোধে কাজ হয় না। সাফ বলে দেয় মুরাদ :
– আমি পারব না মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে।
তখনই ধাপ ধাপ করে কিল ঘুষি চাপড় পড়তে থাকে বাসের গায়ে। টিনের চালায় শিল পড়ার মতো শব্দ। সঞ্জয় এবার তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়। এখনও সময় আছে চল্ লোকজনের হাতে পায়ে গিয়ে ধরি।
– এই যে সাহেবরা বাপ-দাদার কেনা রাস্তা পেছেন নাকি! মাথায় শালাদের শালাদের ঘিলু আছে না! ইচা মাছের গু। বুদ্ধিশুদ্ধি থাকলে কেউ গাঁয়ের ভেতর অমন ধেবড়া সাইজের বাস ঢোকায়।
– অই শালার পুতরা বাস সরাÑ!
– অই শুয়য়ের বাচ্চা…!
– বাস কানা নাকি ড্রাইভার কানা! তা না হলে কোন দুঃখে ময়মনসিংহের বাস এখানে মরতে এসেছে!
– হরতালে আন্দোলনে কত বাসই তো পোড়ে। দে এ ব্যাটাদের বাসটা পুড়িয়ে।
– দেব্যানে! সময় হলে ঠিকই দেব্যানে কাকা।
এরপরই¬Ñ
– মার ধাক্কা। বলেই কয়েকজন জোয়ান মদ্দ ঠিকই হামলে পড়ে বাসের ওপর। মারো ঠেলা হেঁইও..। জোরসে ঠেলা হেঁইও…। আরো জোরে হেঁইও…।
অনেকগুলো মানুষ একজোট হয়ে ঠেলতে থাকে। একসময় ঠিকই তিরতর করে নড়েচড়ে বসে বাসটি। স্টিয়ারিং এ ড্রাইভার নেই। তার ওপর সরু রাস্তা। তখন খ্যাপাটে হয়ে যেভাবে বাস ঠেলছে লোকজন, যখন-তখন হুমড়ি খেয়ে বাস কোথায় গিয়ে যে পড়ে ঠিক নেই। আশপাশে কোনো খাদ গিয়ে পড়লে নির্ঘাৎ ডুবে মরতে হবে। এতকিছু ভেবে আমরা বাসে অস্থিরভাবে চেঁচামেচি করলেও ওরা ক্ষান্ত হয় না। একইভাবে ঠেলতে থাকে বাসটি।
এবারে বাঁশের মোটা ডা-া এনে বাসের গায়ে বেদম পিটুনি ঝাড়তে থাকে কেউ কেউ। সে সঙ্গে খিস্তির কী ভাষা। কী তার শ্রী। খিস্তি ছুড়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে একেকজন। হাটুরে লোকজন তো আছেই। বিশেষ করে রিকশাঅলারা দারুণ বিপাকে পড়েছে। সেই কখন থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে। এক চুলও নড়তে পারছে না। এদিকে হাটও ভেঙে গেছে অনেকক্ষণ। বাড়িমুখো মানুষের চাপ রাস্তাজুড়ে। সে সঙ্গে ট্রাক্টর-লড়ির দৌরাত্ম। ওরা দূর গ্রাম থেকে মাটি এনে বাজারে ফেলছে। নিচুজমি ভরাট করার কাজ চলছে। সেই মাটি পরিবহন কাজও থেমে আছে। লোকাল মেম্বারের লরি এসব। কখন যে মাস্তান নিয়ে এসে গণধোলাই দেয় কে জানে। অগত্যা মুরাদ ওরা কজন নেমে আসে বাস থেকে। নামতেই মারমুখো হয়ে ছুটে আসে লোকজন। দুহাত তুলে মুরাদ ওরা কথা বলা চেষ্টা করে। কিন্তু মানুষের গগণবিদারি চিৎকারে সে চেষ্টা ভেস্তে যায়।
ওদের এক কথা, বাস সরাও। চেয়ে চেয়ে কী দেখছিস! এক্কেবারে চোখ তুইলে ফেলবো! তালের আঁশ যেমন করে আঙুল দিয়ে খুঁইচে খুঁইচে খোড়ল থেকে বের করে চোখ দুইডা তুইলে ফেলবো! উত্তেজিত একজন নাকমুখ ভেংচে কথাগুলো বলল।
– রিকশার রাস্তায় বাস ফেলে রাখার মানে কী।
বাস সরাতে হবে। এক দাবি বাস সরাতে হবে।
দুহাতে তুলে, কখনও করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে ওদের কাছে কথা পৌঁছানোর চেষ্টা করে মুরাদ। ওদের মধ্যে গ্রাহ্য করার মতো মানুষ নেই বললেই চলে। উন্মত্ত মানুষের ভিড় আর বিবেকহীন মানুষের স্বল্পতা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ বিপদের দিকে ঠেলে দেয়। কে যেন আধলা এক ইট ছুঁড়ে মারে হঠাৎ জানালার কাচে। ঝনাৎ করে কাচ ভেঙে পড়ে। এবার গভীর আতঙ্কে ঝলসে ওঠে আমাদের মন। রীতিমতো হাত-পা কাঁপছে কারও কারও। দুচারজন স্থানীয় মুরুব্বি চেষ্টা করেছে ওদের থামিয়ে কথা শোনার। কাজ হয়নি। বরং অপমানিত হয়েছে ওরা।
এমনি যখন তুঙ্গে অবস্থা তখনই ভিড় ঠেলে বাসে ওঠে ড্রাইভার। হাতের জ্বলন্ত সিগেরেট ছুড়ে ফেলে দিয়ে তড়িঘড়ি স্টার্ট দেয় বাস। বারবার গিয়ারে চাপ দিতেই ঝর্ং র্র্ঝ র্র্ঘ ঘর্ং শব্দ ওঠে। সে সঙ্গে ধোঁয়ায় ধোঁয়াময় হয়ে যায় চারদিক। একদিকে কালো ধোঁয়া। তার ওপর তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ!
ওই তোরা কেউ খেয়াল করিসনি, ড্রাইভারটা কখন অতগুলো চোখ ফাঁকি দিয়ে বাসে গিয়ে উঠলো। আক্ষেপে কেউ কেউ তরপাতে থাকে ভীষণ রকম।
– ড্রাইভারটা আরও বড় বেজন্মা। মানুষের পয়দাই না। ধোঁয়ায় ঢাকা মানুষগুলোর কণ্ঠে আহাজারি!
কেউ কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে হাত নেড়ে ধোঁয়া সরাতে সরাতে বলে, শালার ব্যাটার টায়ার ফুটো করে দে। ড্রাইভার কোনো দিকে না তাকিয়ে ব্যাক গিয়ারে বাস ঠেলতে থাকে। আর জগৎময় ধোঁয়া ছড়িয়ে মানুষের জমাট ভিড় ছাড়াতে চেষ্টা করে। এতে বেশ কাজ হয়। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বলে অনেকে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে।
কোত্থেকে যে এই হারামখোররা এসে পড়ল আমাগ ঘাড়ের ওপর! যন্ত্রণার পর যন্ত্রণা। এতক্ষণ বাস ফেলে রেইখে এক ভোগান্তি! এখন আবার ধোঁয়ার পর ধোঁয়া ছেড়ে নাক-মুখ জ্বালিয়ে দিচ্ছে শালার পুতেরা।
নাকমুখ চেপে দৌড়াতে থাকে আর এমনি কথার ঝাল ছড়াতে থাকে হাটুরে লোকজন। শেষ অবধি বাস যেহেতু নড়েচড়ে বসেছে তাই ক্ষুব্ধ মানুষের মনও একটু একটু প্রশমিত হতে থাকে। এমনি করে হাটের ভিড় ঠেলে সাবধানে পথ মাড়িয়ে হাইওয়েতে ফিরে আসে বাস।
এবার ড্রাইভারকে তুলোধুনো করতে ভুল করে না মুরাদ ওরা।
– শালা খানকির পো, মাগীবাজ।
– শালা মাতাল!
– অই মাতাল বাস থামা। তোর বাসে মরতে যামু নাকি। রাজ্যির যত ক্ষোভ বৃষ্টি হয়ে ঝরতে থাকে ড্রাইভারের ওপর।
– কোন বান্দীর বাড়ি গেছিলি বদমাইশি করতে।
– শালা মদুরার বাচ্চা মদুরা। তোরে আজকা মদের ড্রামে চুবাইয়া মারুম।
– মদ অনেক দামি। অত দামি মাল অই শালার পেছনে ঢালা যাইব না। চোলাই লাগব। চোলাইয়ের ড্রামে ডুবামু শালারে।
– খানকির পুতের চ্যাংটা কাইটা দে। যার ধৈর্য্যসহৃ নাই তার অইটা থাকার কাম নাই। খাৎনা কইরা দে।
– কোন মাগীর ঘরে ঢকুছিলো, ওর লগে বিয়া পড়াইয়া দে।
এমনি নানা তিক্তবানে যখন জর্জরিত ড্রাইভার। তখন বলল, একটা মুহূর্তও সময় নষ্ট করি নাই। খালি গেছি আর আইছি।
– লান্টির পো-দুই ঘণ্টা পাড়। খালি গেছি আর আইছি। তামাশার কথা!
– অন্ধকারে ভালা কইরা মুখটাও দেখতে পারি নাই। বিশ্বাস করেন আর না করেন। বলেই কোনরকম পাশ কেটে একটা বিপদ এড়ায় ড্রাইভার। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল বুঝি।
– আহা! মাগীর মুখ দেখতে পারে নাই বলে ভাইজানের কী কষ্ট! শালা মামদার পো কথা বার্তা হিসাব কইরা ক’ নাইলে ঘাড় খাবি কিন্তু।
– মাগীর মুখ অইব কেন? বাচ্চার মুখ। অসহায়ের মতো কথাটা বলল হেলপার। ওর কণ্ঠে কান্নারা দলা পাকিয়ে আছে যেন। একটু ঝাঁজও মিশে আছে যেন সে কান্নায়।
– মানে। অনেকে একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে।
– ওস্তাদের বাচ্চা অইছে। বাচ্চারে দেখতে গেছিল। এবার বেশ রুখু শোনায় হেলপারের কণ্ঠ।
সবাই কেমন যেন হোঁচট খায়। থমকে যায়। গভীর এক নীরবতা মুহূর্তে নেমে আসে বাস জুড়ে। তারপরও বিষয়ের গভীরে না গিয়ে ফের বেজে ওঠে মানিকের গলাÑ
– প্যাসেঞ্জার ট্রিপ মারতে আইয়া হালায় বাচ্চা পয়দা করল কহন?
– আরে কোনো মাগীর পেট বাজাইয়া গেছিল হয়তো। অই শালির বেটি সুযোগ বুঝে এখন পেয়ে বসেছে। দালালের হাতে মারধোরও খেয়েছে কিনা কে জানে। দেখতো চোখ মুখ ফোলা কী না। ইনজুরি নিয়া গাড়ি চালানো তো রিস্কি।
রাগে বোধ হয় ড্রাইভারের মাথায় আগুন জ্বলছে। পথে খানাখন্দ কিছুই খেয়াল করছে না। প্রচ- ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি চালাতে থাকে। ড্রাইভারের মনেও বুঝি সে ঝাঁকুনির দোলা।
– আমরা তো ছোটলোক। রাস্তাঘাটে মানুষ। আপনারাতো ভার্সিটির পোলা। অনেক জ্ঞানী জ্ঞানী কথা কইলেন আহনের সময়। অহন মুখে কী সব ভাষা আপনাগো। লজ্জা করে না!
আকাম-কুকাম করে এখন ব্যাটা জ্ঞান দিতে এসেছে! পায়ের টেঙ্গি ভেঙে দিলে তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল!
এবার হেলপারের ধৈর্যের বাধভাঙে বুঝি। প্রতিবাদের সুর বেজে ওঠে ওর কণ্ঠে! তীব্রক্ষোভ, অবহেলা, অপমান আর উপেক্ষার যন্ত্রণার পাশাপাশি নোংরা খিস্তির গ্লানি এবং ড্রাইভারের প্রতি গভীর ভালোবাসা তাকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। গলা চড়িয়ে মন খুলে ওর কথাগুলো বলে যায়। সে কথা শুনতে অসুবিধা হয়নি কারও।
আসলে ড্রাইভারের বাড়ি ময়মনসিংহ হলেও বিয়ে করেছে ফরিদপুর। বউ পোয়াতি হবার পর থেকেই বাপের বাড়ি। ড্রাইভার একবার কি দুবার এসেছিল তখন শ্বশুরবাড়ি। এদিকে চারমাস হলো বাবা হয়েছে ও। কিন্তু আজও বাচ্চার মুখটি দেখতে পারেনি সে। ছুটি মেলেনি। অনেক বলে কয়েও মালিকের মন গলাতে পারেনি ছুটির জন্যে। এমনকি হাতে পায়ে ধরেছে, এ-ও বলেছে না হয় বেতন দিয়ইন না! বিনা বেতনে ছুটি দিবাইন তাও রাজি। কিন্তু কাজ হয়নি। তাই পোয়াতি বউয়ের কোনো সেবা-শুশ্রƒষা করতে পারেনি ও।
বাচ্চা হবার পরও কোনোভাবেই মহাজন ছুটি দেয়নি। ছুটিছাড়া এলে গাড়ি হাতছাড়া হয়ে যাবে। অন্য ড্রাইভারের হাতে স্টিয়ারিং তুলে দেবে কোনো কথা না ভেবেই। টার্মিনাল জুড়ে বেকার ড্রাইভারের ছড়াছড়ি। তাই অনেক দিন নীরবে কেঁদেছে। একরকম হাহাকার নিয়ে পথ চলেছে। শেষে কাউন্টার ম্যানেজারকে বলল, দাদা, কতজনেরে দেখলাম মোবাইলে ছবি পাডায়, আমার ছাওয়ালের ছবি মোবাইলে কেমনে পাঠাইব, একটু বুদ্ধি বাৎলাইয়া দেন না দাদা।
খানিক আগেই ট্রিপ ছেড়ে গেছে টার্মিনাল। তাই ক্যাশ মেলাতে ব্যস্ত ছিল গোবিন্দ। লেজারবুকে চোখ রেখে বলল, ছবি পাডাইতে অইলে যেনতেন মোবাইলে অইব না। দামি মোবাইল লাগবে। ড্রাইভার লুঙ্গির কোচড় থেকে ওর মোবাইল বের করে গোবিন্দের দিকে বাড়িয়ে দেয়। গোবিন্দ এক ফাঁকে মোবাইলটা নেড়েচেড়ে টেবিলে রাখে, পরে ঠেলে দেয় ড্রাইভারের দিকে। এইডা ছবি পাঠানোর ভাও না। এইডা দিয়া বড়জোর ম্যাসেজ পাডাইতে পারবা-ছবি না! ইতার লাগি আরও দামি মোবাইল লাগব।
– দাদা আপনারডা দামি না! দেইহা তো দামিই মনে হয়! আমারডা দামি অইলে কী অনব? ছাওয়াল তর, তর ছাওয়ালের ছবি দিয়া কী করুম।
– আমনার মোবাইলে আমার ছাওয়ালের ছবি পাডাইলেই আমি দেখতে পামু।
– বেক্কল! আমারডায় খালি কাম অইব। তর বউয়েরডা কেমন মোবাইল! তারও তো ক্যাপাসিটি থাকতে অইব। যেমুন তরডার ক্যাপাসিটি নাই।
– বউয়েরও তো নাই তয় শুমুন্দির আছে। আমারডার লাহান। খালি উনিশ আর বিশ।
– তয় ক্যামনে পাঠাইব। তোর আর শুমন্দির কোনো ফারাক নাই। একই ভাও!
সুতরাং মোবাইলে ক্যাপাসিটি না থাকায় সন্তানের মুখ আর দেখা হয়নি। তবে বউকে বলে রেখেছিল ক্যাপাসিটিঅলা মোবাইল ধারে কাছে কারও পাইলে যহন তহন য্যানো জানায় ওকে। দাদার নম্বরডা তহন না হয় দেওন যাইব।
কিন্তু সে সুযোগও মেলেনি আজ অবধি। তবে ছবি না দেখলেও বাচ্চার চেহারা প্রায় মুখস্থ ওর।
– চুলডা কার মতো- তোমার না আমার!
– চোক্ষু।
– গায়ের রঙ আমারডা না পাইলেই অয়।
– তোমারডা পাইছে? আলহামদুলিল্লাহ! তোমার গতরের রঙডা পাইলে জব্বর অইব!
– কী মুখ লাগাব! বাবার মুখ লাগে না! অগুলা আবিযাবি কতা।
– বাবুর কপালে টিপ দাও নাই! কালা টিপ। কাজলের। বড় একখানা টিপ?
– দিয়াম! মাশাল্লা। তাইলে আর মুখ লাগবও না। কু-দৃষ্টিও কারও পরব না। তুমি নিশ্চিন্ত থাক বাবুর মা। আর কতাকমু না, বাবুডা মনে অয় হাই তুলতাছে। তুমি ওরে ঘুম পাড়াও।
এমনি অনেক কথা হয় বউয়ের সঙ্গে। কিন্তু আজও জীবন্ত শরীরটাকে নেড়েচেড়ে দেখার ভাগ্য হয়নি ওর-তাই এবারে যখন পদ্মার ওপারে রিজার্ভ যাওয়ার প্রস্তাব পেল তা আর হাতছাড়া করতে মন চায়নি। ফরিদপুর ছুঁয়েই যখন যেতে আসতে হবে তখন এ সুযোগে বাচ্চার মুখটি যদি এক নজর দেখা যায় সে প্রত্যাশায় খেপটি নিয়েছিল ড্রাইভার। তারপরও শ্বশুরবাড়ি যে যাবেই এমন ভাবনা একেবারে মূর্ত হয়নি। সুযোগ পেলেই তবে যাবে। কিন্তু এদিক দিয়ে যাবার পথেই দেখা শ্বশুরের সঙ্গে।
কখন দেখা হলো? শ্বশুর এল আবার কোত্থেকে!
এবার খেয়াল হয় সবার। আসার দিন গোয়ালন্দ চৌরাস্তার মোড়ে এক বুড়ো মতো লোককে দেখে বাস থামায় ড্রাইভার। লম্বা দুটো বরাক বাঁশ কাঁধে। দূরে কোনো বাজারে নিয়ে যাচ্ছে বিক্রি করতে। কাঁধের বাঁশ দুটো বাসের সঙ্গে আঁটোসাঁটো করে বেঁধে তারপর বুড়ো মানুষটাকে নিজের সীটের পেছনে বসিয়ে তার গন্তব্যে এনে নামিয়ে দিয়েছিল। সেই বুড়োটাই ড্রাইভারের শ্বশুর।
– শ্বশুরের লগে দেহা হওয়ার পরও যদি বউডার লগে দেখা না কইরা যায় তাইলে গ্রামের লোকজন আর বাড়ির লোকজন কী কইতে পারে। আপনারা শিক্ষিত মানুষ। বিবেকরে একবার জিংগাইয়া দেহেন তো!
ও আরও বলল-বউকেও অনেক নিন্দে শুনতে হবে মানুষের। বিশেষ করে বাচ্চার জন্যে মন পুড়ছিল সেই কবে থেকে। চারমাস বয়েস হবার পরও বাবা হয়ে সন্তানের মুখ দেখেনি। এ নিয়ে ভাষণ অনুতাপ হতো ড্রাইভারের। অনেকদিন একা একা চোখের জলও ফেলেছে। তাই আজ যখন সুযোগ এলো এপথ দিয়ে যাবার। তার ওপর শ্বশুরের সঙ্গে যখন দেখা, তখন একঝলক বাচ্চার মুখ না দেখে থাকতে পারেনি। কিন্তু শ্বশুর বাড়ি আরও বেশ দূর। স্বল্প সময়ে অতদুর যাওয়া সম্ভব হবে না বলে বাচ্চাকে নিয়ে কাছে-পিঠে এক আত্মিয়ের বাড়ি এসে অপেক্ষা করতে বলেছে। সময় যাতে একচুলও নষ্ট না হয় সেটা মাথায় রেখেই এ ব্যবস্থা। ফোনে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল। কাছাকাছি এসে ফের ফোন দিয়েছিল মোবাইলে। কিন্তু বাচ্চা ঘুমাচ্ছিল বলে রওনা দিতে দেরি হয়ে গেছে।
ওরা যখন কাছাকাছি, তখনও বাচ্চা ঘুমিয়ে। রাস্তার পাশে এক গাছের নিচে অপেক্ষা করছিল ড্রাইভার। তখন অন্ধকার নেমে গেছে। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছিল ঝোপঝাড়ে। মাঝে মাঝে ট্যাক ট্যাক করে ডেকে উঠছিল কাঠবিড়ালি। সে অন্ধকারে গাছতলায় দাঁড়িয়ে ম্যাচের মৃদু আলোয় একঝলক দেখেছিল নিজের আত্মজাকে। কোলে নেয়ারও সুযোগ হয়নি। পাছে ঘুম ভেঙে যায়। কপালে চুমুও আঁকেনি। যদি ঘুম ছেড়ে যায়। শুধু বাচ্চার মুখ তাকিয়ে দেখেছিল তাও বেশি সময় নয়। বারবার ম্যাচের কাঠি নিভে যাচ্ছিল বলে বাচ্চার মুখ ঢেকে যাচ্ছিল অন্ধকারে। আবার আলো থাকলেও সময় সময় চোখে জল এসে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল বাচ্চার মুখ। চোখের জল আড়াল করতে তাই আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায়নি ড্রাইভার। বেশ খানিকটা পথ চলে আসার পর মনে হল ওর বউয়ের মুখটিও একবারও দেখা হয়নি। একবারও তাকায়নি ওর বউয়ের দিকে। ম্যাচের কাঠি পুড়ে যাচ্ছিল বলে বার বার ম্যাচ জ্বালতে আর সে আলোয় বাচ্চার মুখ দেখতেই পেরিয়ে যায় সময়। দূরে এসে অনুশোচনা হয়। পেছন ফিরে তাকায়। অন্ধকারে আর মুখ দেখা যায় না কারও। শুধু শারীরিক অবয়বে বোঝা যায় ওটা শিউলি। ডুরে শাড়ি পরা।
হেলপারের কথাগুলো শুনে সবাই মুখে চুক চুক শব্দ করে আফশোস করতে থাকে, তুমি বলে গেলেই তো পারতে।
– প্রয়োজনে রাতটা কাটিয়ে যেতে।
– গাড়ি থামাও ড্রাইভার। তুমি ঘুরে আসো।
– একটা আমনবিক কাজ হল। তুমি একটু বুঝিয়ে বললেই তো…।
– এটা খুব অন্যায় কাজ হয়ে যাচ্ছে। আমরা এর জন্য বিবেকের কাছে দায়ী থাকবো, তুমি গাড়ি ঘোরাও ড্রাইভার।
– আজ রাতটা তুমি থেকে যাও। আমরা বাসেই রাত কাটিয়ে দিতে পারব কোনো অসুবিধা হবে না!
– তুমি গাড়ি ঘোড়াও ড্রাইভার-এভাবে চলে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না! ভীষণ অন্যায়-ভীষণ অন্যায় হয়েছে আমাদের।
এমনি কথার ফুলঝুড়ি বাস জুড়ে।
তখন ড্রাইভার বলে, ম্যাচের আলোয় কদ্দুর আর দেহা যায়। এক পলক শুধু দেখলাম। হ্যারিকেনের লেইগ্যাও অপেক্ষা করি নাই। কান্না দলা পাকিয়ে ওঠে ওর কণ্ঠে।
বাচ্চাডা সজাগ অইলে একটু কোলে নিতে পারতাম। তাও পারলাম না। দোয়া-আশীর্বাদ কইরা একটা চুমাও দিতে পারলাম না। সজাগের অপেক্ষাও করলাম না। এমুন অভাগা বাপ আমি। তারপরও কত কথা শুনাইলেন। মুখে যা আইলো কইলেন। আটকাইলো না কিছুই। যাচাই-বাছাই করার প্রয়োজনডাও অইল না আপনাগো! কী অবিচার। কী অবিচার বলেই হিক্কা তুলে কাঁদতে থাকে ড্রাইভার। ওর শরীর ঝেঁকে ঝেঁকে কান্না বেরুতে থাকে।
এ দেখে হেলপারও কেঁদে ওঠে ডুকরে ডুকরে। বা হাতের চেটোয় ও নিজের চোখ মুছতে থাকে আর ডান হাতে গামছা নিয়ে ওস্তাদের চোখ মুছে দিতে থাকে। হয়তো গভীর মায়ায় কিংবা পাছে চোখ ঝাপসা হয়ে গেলে ড্রাইভিং যদি বিঘিœত হয়। যাত্রীদের নিরাপত্তা যদি অনিশ্চিত হয়। হয় ঝুঁকিপূর্ণ। তাই একটু পরপরই গামছায় ওস্তাদের চোখ মুছে যাচ্ছিল সাগরেদ।
এ দেখে পুরো বাস নিস্তব্ধ হয়ে যায়। নিস্তব্ধ হয়ে যায় গভীর কোনো বেদনায়। ফিস ফিস করে কারা যেন বলে, বড় অন্যায় হয়ে গেছে! বড় অন্যায়!
ওদিকে সমস্ত রাগ-ক্ষোভ অপমান আর কষ্ট গাড়ির গতির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে তীব্র গতিতে বাস টেনে যাচ্ছে ড্রাইভার। ছুটে যাচ্ছে গন্তব্যে। যেটুকু সময় অপচয় হলো তা বুঝি পুষিয়ে দেবার প্রাণান্তকর চেষ্টা ওর!