মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের (এমআরপি) পর এবার আসছে ই-পাসপোর্ট। ‘বাংলাদেশে ই-পাসপোর্ট ও স্বয়ংক্রিয় বর্ডার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন’ প্রকল্পের আওতায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এই উদ্যোগের পেছনে চারটি কারণ রয়েছে বলে জানা গেছে। কারণগুলো হলো—বহির্বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে বিশ্বের সর্বশেষ উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা, বাংলাদেশি পাসপোর্টের নিরাপত্তা বাড়ানো, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশি পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে বাংলাদেশি নাগরিক ও আগত বিদেশি নাগরিকদের সুষ্ঠুভাবে আসা-যাওয়া নিশ্চিত করা। তবে ই-পাসপোর্ট চালু হলেও পাশাপাশি এমআরপির কার্যকারিতা থাকবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘বাংলাদেশে ই-পাসপোর্ট ও স্বয়ংক্রিয় বর্ডার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন’ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৬৩৫ কোটি ৯১ লাখ টাকা। যার পুরোটাই সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সুরক্ষা সেবা বিভাগের আওতায় ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট কর্তৃপক্ষ এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পটি চলতি বছরের জুলাই থেকে শুরু হয়ে আগামী ২০২৮ সালের ৩০ জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ঢাকা (ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়, ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট অফিস, ডাটা সেন্টার, পাসপোর্ট অ্যাসেম্বলি লাইন, পার্সোনালাইজেশন সেন্টার, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র), ৬৪টি জেলায় অবস্থিত ৭২টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, বিদেশে অবস্থিত ৮০টি বাংলাদেশ মিশন, যশোরে অবস্থিত ডিজাস্টার রিকভারি সেন্টার, দেশের অভ্যন্তরে তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ২৪টি স্থলবন্দর (২টি স্থলবন্দরে স্বয়ংক্রিয় বর্ডার কন্ট্রোল সিস্টেম, ২২টিতে ই-পাসপোর্ট রিডারের মাধ্যমে ইমিগ্রেশন), ৭২টি এসবি ও ডিএসবি অফিস, মিউনিখ, জার্মানিতে রেফারেন্স পয়েন্টে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১লা এপ্রিল ২০১০ সালে এমআরপি ও মেশিন রিডেবল ভিসা (এমআরভি) পদ্ধতি চালু করা হয়। কিন্তু এমআরপি ব্যবস্থায় পাসপোর্টের জালিয়াতির আশঙ্কা ও দশ আঙুলের ছাপ ডাটাবেজে সংরক্ষণ না থাকার সুযোগে এই পদ্ধতির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে একাধিক পাসপোর্ট করার প্রবণতা ধরা পড়ে। এরফলে ই-পাসপোর্ট চালুর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল পাসপোর্ট সেবা সপ্তাহ উদ্বোধন কালে বাংলাদেশে ই-পাসপোর্ট প্রবর্তনের কার্যক্রম গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দেন। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রীর জার্মানি সফরকালে ২০১৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জার্মানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ভেরিদোজ জিএমবিএইচ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বাংলাদেশে ই-পার্সপোর্ট চালুর বিষয়ে একটি এমওইউ স্বাক্ষর হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের পরিচালক, সুরক্ষা সেবা বিভাগের প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত সাত সদস্যের মাধ্যমে একটি কমিটি ই-পাসপোর্টের টেকনিক্যাল স্পেশিফিকেশন (Technical Specification) নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া এই বছরের ২৩ মার্চ অনুষ্ঠিত একনেক সভায় ‘ইন্ট্রোডাকশন অবমেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) ও মেশিন রিডেবল ভিসা (এমআরভি) ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রকল্পটির ৩য় সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনকালে যেন ই-পাসপোর্টের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হয়, এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একনেক সভার সিদ্ধান্তের আলোকে বাংলাদেশে ই-পাসপোর্ট প্রবর্তনের জন্য নেওয়া কার্যক্রম পর্যালোচনা ও সমন্বয়ের জন্য মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে এই বছরের ৭, ১৮ ও ২২ ফেব্রুয়ারি এবং ২, ৩ ও ৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ছয়টি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এসব সভায় প্রকল্পের আর্থিক, কারিগরি ও ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে নেওয়া সিদ্ধান্তের আলোকে প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করা হয়েছে। একইসঙ্গে অনুমোদন প্রক্রিয়াকরণের জন্য পরিকল্পনা কমিশনেও পাঠানো হয়।
প্রকল্পের আওতায় ই-পাসপোর্ট বুকলেট সংগ্রহ (২০ লাখ সরাসরি আমদানি, ২৮০ লাখ দেশে তৈরি) করা হবে। ই-পাসপোর্টের জন্য ডেমোগ্রাফিক তথ্য, দশ আঙুলের ছাপ, চোখের কর্নিয়ার ছবি ও ডিজিটাল স্বাক্ষর সংগ্রহ পূর্বক যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে তথ্যসমূহ কেন্দ্রীয় ডাটা সেন্টার ও ডিজাস্টার রিকভারি সেন্টারের সার্ভারে সংরক্ষণ এবং পাসপোর্টের আবেদনকারীদের পাসপোর্ট দেওয়ার জন্য পার্সোনালাইজেশন সেন্টারে পাসপোর্ট প্রিন্টিংয়ের পর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ও দূতাবাসগুলোয় পাসপোর্ট বিতরণ করা হবে। এ কাজটি নিরবচ্ছিন্নভাবে করার জন্য সার্ভার, রাউটার, সুইচ, কম্পিউটার, প্রিন্টার, স্ক্যানার, ক্যামেরা, ই-পাসপোর্ট রিডার, প্রিন্টিং মেশিন স্থাপন প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার ইনস্টলেশন সম্পন্ন করা হবে। জনবল নিয়োগ (প্রেষণে-৩২ জন, আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে-১৯০ জন) নিয়োগ দেওয়া হবে। এ প্রকল্পের আওতায় যানবাহন সংগ্রহ করা হবে ২৫টি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতেই বাংলাদেশে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশেই মেশিন রিডোয়েবল পাসপোর্ট সাপোর্ট করে না। সেক্ষেত্রে আমাদের নাগরিকরা ভোগান্তির শিকার হন। তাই এই প্রকল্প। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে আধুনিক বিশ্বে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন