সিলেট সিটি নির্বাচনে বিএনপির সংকট জামায়াত ও বিদ্রোহী প্রার্থী

জামায়াত ও দলের বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে সংকট কাটছে না বিএনপির। ২০ দলীয় জোটের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে একক প্রার্থী দেয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াত। দলটি তাদের সিলেট মহানগর আমির অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়েরকে প্রার্থী দিয়ে বেকায়দায় ফেলেছে জোটকে। এ নিয়ে বাকি শরিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যে জামায়াতের প্রতি ক্ষোভ সঞ্চার হচ্ছেও বলছেন কেউ কেউ। এ প্রসঙ্গে ২০ দলের শরিক বাংলাদেশ ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি জোট নেতাদের উদ্দেশে গতকাল বলেন, আন্দোলনের অংশ হিসেবেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত ও করতে হবে আমাদের। বিনা চ্যালেঞ্জে কোনো নির্বাচন ছাড় দেয়া উচিত হবে না। প্রমাণ করতে হবে নৌকার বিপরীতে ধানের শীষই হচ্ছে জনগণের প্রতীক। তিনি বলেন, ২০ দল আমরা অনেক দূর এগিয়ে আসছি, শেষ দিকে এসে জোটের মধ্যে মতবিরোধ হোক আমি চাই না। প্রত্যেক দলের নিজস্ব বিষয় রয়েছে। জোটের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সেটি ত্যাগ করা উচিত। জেবেল গানি বলেন, আমি আশাবাদী ৯ জুলাইয়ের আগে জামায়াত তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করবে। অতীতে তারা যেমনটি করেছে। এদিকে বিএনপি দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মিটিয়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে মনোনয়ন দেয় সদ্য সাবেক হওয়া মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে। এতে ক্ষুব্ধ হন মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম। তিনি দলীয় সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে মনোনয়নপত্রও দাখিল করেছেন। অপরদিকে জোটের প্রায় সব শরিক দল আসন্ন তিনটি সিটির নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীকে সমর্থন দিলেও সিলেটে জামায়াতের প্রার্থিতা নিয়ে এখন পর্যন্ত জটিলতা কাটছে না, অপেক্ষা করতে হবে আগামী ৯ জুলাই মনোনয়ন প্রত্যাহার পর্যন্ত। ২৭ জুন বুধবার বিকেলে গুলশানে অনুষ্ঠিত ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আশা প্রকাশ করেছেন, আগামী দুয়েক দিনের মধ্যেই জামায়াতের সঙ্গে বিষয়টির সুরাহা হবে। গত দুই দিন অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্তের কথা জানায়নি জামায়াত। সিলেট জামায়াতের শীর্ষ নেতারা বলছেন, জোটগতভাবে সমর্থন না পেলেও সিলেটে জামায়াতের এককভাবে নির্বাচনের সম্ভাবনা আছে। জোটের নেতারা মনে করেন, গাজীপুরের মতো সিলেটেও জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে কিছু কাউন্সিলর পদ ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আসনভিত্তিক দফারফা করার প্রয়োজন হতে পারে। সিলেটে জামায়াতের মেয়র প্রার্থী বলছেন, যে কোনো উপায়েই তিনি প্রার্থী হতে আগ্রহী এবং প্রয়োজনে ওপেন নির্বাচনে যাক বিএনপি-জোট। আর বিএনপির নেতাদের ভাষ্য, জামায়াত চাইলে এককভাবে নির্বাচনে যেতে পারে। বিশেষ করে সিলেটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদরুদ্দিন আহমদ কামরানের সঙ্গে জামায়াতের ঘনিষ্ঠতা থাকায় ভোটে এর প্রভাব পড়বে। বিশ দলীয় জোটের একটি শরিক দলের মহাসচিব বলেন, জামায়াতের সঙ্গে সিলেটে সমাধান না হলে না হোক। সিলেটের বিএনপিও এটাই চায়। কারণ, তারা মনে করে সিলেটে জামায়াতের ভোট পাবে না বিএনপি। শুনেছি, আওয়ামী লীগের প্রার্থী কামরানের সঙ্গে জামায়াতের সুসম্পর্ক আছে। তাদের অনেক প্রতিষ্ঠানেও শরিক হিসেবে আছেন কামরান। সিলেটে জামায়াতের প্রার্থী মহানগর আমির অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, আমি নির্বাচন করব। মনোনয়নপত্র দাখিল করেছি। আর এটা অনেক আগে থেকে আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। আমরা চাই জোটগত সমর্থন। তা সম্ভব না হলে নির্বাচন ওপেন হোক। জামায়াতের একক প্রার্থিতায় সমস্যা দেখছে না সিলেট বিএনপিও। সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাহের শামীম বলেন, তারা যদি চায় ওপেন করবে, করে দেখুক। তাদের অবস্থান যাচাই হবে। আবদুল কাহের শামীম আরো বলেন, শোনা যায়, সিলেটে জামায়াতের সঙ্গে কামরানের সম্পর্ক অনেক ভালো। ব্যবসায়িকভাবে, রাজনৈতিকভাবেও তাদের সম্পর্ক ভালো। এটা তো ভোটেও প্রভাব পড়তে পারে। ২৭ জুন বুধবার বিকেলে ২০ দলীয় জোটের দুই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকেও তিন সিটি কর্পোরেশনের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে জামায়াতের প্রতিনিধি, দলটির নির্বাহী পরিষদ সদস্য মাওলানা আবদুল হালিম উপস্থিত হলেও হাজিরা দিয়েই চলে যান। যাওয়ার সময় তিনি বলে যান, আমি সব কথা মির্জা ফখরুল সাহেবকে বলেছি। পরে বৈঠকে মির্জা ফখরুল শরিক নেতাদের উদ্দেশে বলেন, জামায়াতের প্রার্থী নিয়ে জটিলতা থাকলেও তারা নিজেরা কথাবার্তা বলে আমাদের জানাবে। আশা করি, কাল-পরশুর মধ্যে একটা সমঝোতা হবে। বৈঠকে উপস্থিত খেলাফত মজলিসের প্রতিনিধিকে সিলেটে তাদের মেয়র প্রার্থী মনোনয়ন বাদ দেয়ার অনুরোধ করেন মির্জা ফখরুল। এ ব্যাপারে খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের বলেন, জামায়াত আগে থেকেই সিলেট বা রাজশাহী সিটি নির্বাচন করার আগ্রহ দেখিয়েছে। এখন জোটের সব শরিকরা বিএনপির প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে। আমাদেরও প্রার্থী ছিল। আমরা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছি। সিলেট সিটি নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, আমাকে দল মনোনীত করেছে। বলা হয়েছে প্রার্থিতা করতে। এই হচ্ছে সর্বশেষ অবস্থান। এখনো আমি মাঠে আছি। সিলেট জেলা দক্ষিণের জামায়াত আমির মাওলানা হাবিবুর রহমান বলেন, দেশের ১২টি সিটির মধ্যে একটিও কি জামায়াত পেতে পারে না? আমরা জোটগত মনোনয়নের ব্যাপারে আশাবাদী। নৈতিকভাবেই ২০ দলীয় জোট আমাদের সমর্থন দেবে। যদিও জেলা জামায়াতের আরেক শীর্ষ নেতার ভাষ্য, আমাদের সমর্থন দিতে বাধ্য হবে বিএনপি। আমরা নির্বাচন করব সিলেটে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদরুদ্দিন আহমদ কামরানের সঙ্গে জামায়াতের সুসম্পর্কের বিষয়ে মাওলানা হাবিবুর রহমান বলেন, কামরান সাহেব আমাদের রাজনৈতিক সহকর্মী। তার সঙ্গে বন্ধুত্বও নেই, শত্রুতাও নেই। আমাদের মধ্যে সখ্যও নেই। যারা সুসম্পর্কের কথা প্রচার করে, তারা রাজনৈতিক হিংসার কারণে বলে। ২৬ জুন অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে এখানেও জামায়াতের প্রার্থী নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। যদিও কয়েকটি কাউন্সিলর পদের বিনিময়ে সমঝোতা হওয়ায় প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেয় জামায়াত। এর আগে স্থগিত হওয়া ঢাকা উত্তর সিটির উপনির্বাচনেও জামায়াত প্রার্থী দিয়ে পরে প্রত্যাহার করে। জামায়াতের প্রার্থী প্রসঙ্গে এলডিপি সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন বলেন, তিন সিটি নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থী হচ্ছে জোটের প্রার্থী। তিনি জামায়াতের প্রতি অনুরোধ করেছেন জোটের স্বার্থে নিজেদের প্রার্থী না দেয়ার জন্য। অন্যদিকে সিলেট মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম দলীয় সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে মনোনয়নপত্রও দাখিল করেছেন। এতে দলটির সংকট কাটছে না, বরং আরো প্রকট হচ্ছে। বিএনপির প্রার্থী সেলিম বলেন, ৩৯ বছরের রাজনীতিতে আমি দলের কোনো সিদ্ধান্তের বাইরে যাইনি। এবার আমি আমার দলের নেতাকর্মীর চাপের মুখে মনোনয়ন জমা দিয়েছি। আগামী ৩০ জুলাই নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর বিপক্ষে নেতাকর্মীরা ব্যালটের মাধ্যমে জবাব দেবেন। বিদ্রোহী হয়ে নির্বাচন করলে দল যদি বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে কি করবেন- এ প্রসঙ্গে বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী সিলেট মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম বলেন, তার পরও আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় থাকব। এতে কোনো প্রকার ছাড় নয়। কোনো দালালকে ছাড় দিতে আমি রাজি নই। সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক) নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য মনোনয়নপত্র জমাদানের শেষ সময় ছিল বৃহস্পতিবার। ওই দিন বিকেলে বিএনপির দলীয় মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী মনোনয়নপত্র জমা দেন। পরে মনোনয়নপত্র জমা দেন বদরুজ্জামান সেলিম।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে