গোরক্ষার নামে একের পর হামলা। সংখ্যালঘুর উপরে, বিশেষত মুসলিমদের উপরে হামলা করাকে বীরত্বের কাজ বলে মনে করা। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অজুহাতে কট্টর সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠা। বছর চারেক আগেও কিন্তু পরিস্থিতিটা এই রকম ছিল না। ২০১৪ সালে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি দেশের মসনদে বসার পর থেকেই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এবং অসহিষ্ণুতার ঘটনার সংখ্যা যেন লাফিয়ে বেড়েছে। তার সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছে আর এক বিপদ— গুজবের ভিত্তিতে গণপ্রহার। গত দেড় বছরে শুধু ছেলেধরা গুজবে ৬৯টি হামলা হয়েছে। তাতে মৃত্যু হয়েছে ৩৩ জনের।
২০১৪ সালে ভারতে সরকার বদলেছে। তার পর থেকেই দেশ জুড়ে কট্টরবাদী শক্তিগুলির বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়ে গিয়েছে, প্রকাশ একাধিক সমীক্ষায়। নরেন্দ্র মোদীর সরকার চার বছর কাটিয়ে ফেলেছে মসনদে। এই চার বছরে অসহিষ্ণুতা এবং বিদ্বেষজনিত হিংসার ঘটনা কতগুলি? তার হিসেব তুলে ধরা হয়েছে ইন্ডিয়াস্পেন্ড-এর সমীক্ষায়। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার আগের চার বছরে পরিস্থিতিটা কেমন ছিল, তুলে ধরা হয়েছে সে হিসেবও।
এই হিসেব বলছে, ২০১০ থেকে ২০১৪-র আগে পর্যন্ত দেশে গোরক্ষার নামে হামলার ঘটনা মাত্র ২টি। আক্রান্ত ৪ জন। তবে সে সব হামলায় কারও মৃত্যু হয়নি।
আর ২০১৪ থেকে ২০১৮-র জুলাই পর্যন্ত হামলার সংখ্যা ৮৫। আক্রান্ত হয়েছেন ২৮৫ জন। মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৩৪ জনের।
গোরক্ষার নামে বা ‘হিন্দুত্ব’ রক্ষার নামে কোন রাজ্যে অশান্তি হয়নি, খুঁজে পাওয়া কঠিন। রাজস্থানে একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে। সেই অলওয়ারেই আবার স্বঘোষিত গোরক্ষকদের গণপ্রহারে গত ২০ জুলাই মৃত্যু হয়েছে রাকবর নামে এক ব্যক্তির। গুজরাটে হামলা হয়েছে, মহারাষ্ট্রে হয়েছে, কর্নাটক, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ— প্রায় সব রাজ্য থেকে একের পর এক হামলার খবর এসেছে।
গোরক্ষার নামে উৎপাত পশ্চিমবঙ্গ আগে কখনও সে ভাবে দেখেনি। কিন্তু ২০১৪-র পর থেকে যে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে দেশে, পশ্চিমবঙ্গও তার বাইরে থাকতে পারেনি। গোরক্ষার নামে হত্যার সাক্ষীও হতে হয়েছে পশ্চিমবঙ্গকে। ২০১৭ সালের আগস্টে জলপাইগুড়ির ধূপগুড়ি থেকে কোচবিহারের তুফানগঞ্জে গরু নিয়ে যাওয়ার পথে আক্রান্ত হন নুরুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন এবং হাফিজুল শেখ। গাড়ির চালক নুরুল পালাতে পেরেছিলেন। বাকি দু’জনের মৃত্যু হয় গণপ্রহারে।
পরিস্থিতির এত দ্রুত অবনতির কারণ কী? কারণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের বড় অংশই একমত।সমীক্ষক সংস্থা ইন্ডিয়াস্পেন্ডের বিশেষজ্ঞ হর্ষ মন্দরের মতে, প্রথমত কট্টরবাদীরা এখন এই সব হামলা করে শ্লাঘা বোধ করছেন। তাঁরা ভাবছেন, এই সব হামলা বীরত্ব বা পৌরুষের কাজ। দ্বিতীয়ত, হামলাকারীরা বেশ নিশ্চিন্ত এবং নিরাপদ বোধ করছেন। হামলা বা খুনের দৃশ্য ভাইরাল হলেও প্রশাসন তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করবে না— অনেকের মধ্যেই এ রকম একটা বিশ্বাস জন্মে গিয়েছে। তৃতীয়ত, এই সব হামলা এবং তার ভিডিয়োর মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আতঙ্কিত করে দেওয়া যাবে বলে কট্টরবাদীরা মনে করছেন।
কট্টরবাদীদের এই বাড়বাড়ন্তের জন্য কি নরেন্দ্র মোদীকে সরাসরি দোষারোপ করা সম্ভব? এ বিষয়ও বিশেষজ্ঞরা বুঝার চেষ্টা করেছেন। তাদের মতে কেন্দ্রে তাঁর সরকার আসার পর থেকেই দেশে অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ বেড়েছে, সে কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কি কখনও সমর্থন করেছেন এই হিংসাকে? প্রধানমন্ত্রী তো একাধিক বার এই হিংসার বিরুদ্ধে বার্তা দিয়েছেন। সাবরমতী আশ্রমের শতবর্ষ পূর্তির অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘‘গো-ভক্তির নামে মানুষ খুন মেনে নেওয়া যায় না।’’ ২০১৭ সালে সংসদের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগের দিন নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, গোরক্ষার নামে হামলা বরদাস্ত করা হবে না, রাজ্যগুলি এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করুক। এর পরেও কি মোদীকে দায়ী করা যাবে?
অধ্যাপক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘মোদীকে সরাসরি দায়ী করা কঠিন। এমনকি, আরএসএস-কেও সরাসরি দায়ী করা যায় না। কারণ আরএসএস যে হিন্দুত্বের কথা বলে, তার সঙ্গে এই তথাকথিত গোরক্ষা কর্মসূচির কোনও মিল নেই। আরএসএসেরও গো-সেবা কর্মসূচি রয়েছে। কিন্তু সেই কর্মসূচির নামে হিংসাত্মক আক্রমণ বা হামলা আরএসএস করেছে, এমন নজির নেই। শ্রীরাম সেনা, রাজপুত করণী সেনা— এই সব সংগঠন কিন্তু হামলাগুলো করছে।’’
তা হলে কি বিজেপি বা আরএসএস এই হিংসার জন্য দায়ী নয়? উদয়নের ব্যাখ্যা, ‘‘দায়ী তো বটেই। আসলে একটা প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দেওয়া হয়েছে। গোরক্ষার নামে মানুষ খুন করতে হয়তো নরেন্দ্র মোদী বলেননি। কিন্তু কট্টরবাদকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। তাই নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে কট্টরবাদীরা উৎসাহিত হয়েছেন। দেশে এখন তাঁরা যা বলবেন, তেমনই হবে— কট্টরবাদীরা এমনই ভাবতে শুরু করেছেন।’’
এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রশাসন কতটা আগ্রহী, তা নিয়েও বিশেষজ্ঞদের সংশয় রয়েছে। তাঁরা বলছেন, গোরক্ষার নামে হামলা বন্ধ করার দায় রাজ্যগুলির উপরে চাপিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে চেয়েছেন মোদী। কিন্তু রাজ্যগুলিও কট্টরবাদীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার দায় নিজেদের উপরে নিতে চাইছে না। বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি সরকার নীরব থাকছে। কট্টরবাদীদের তারা সরাসরি সমর্থন করছে না ঠিকই। কিন্তু নীরব প্রশ্রয় দিয়ে রাজনৈতিক লাভ ঘরে তুলতে চাইছে।
গোরক্ষকদের তাণ্ডবেই অবশ্য শেষ নয় সমস্যার। ছেলেধরা গুজবে পিটিয়ে মারার প্রবণতাও আচমকা হু হু করে ছড়িয়েছে গোটা দেশে। এই ধরনের ঘটনা আগে খুব বেশি ঘটত না। কিন্তু গত দেড় বছরে বিভিন্ন রাজ্য থেকে এই ধরনের একের পর এক ঘটনার খবর আসতে শুরু করেছে। ২০১৭-র ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৮-র ৫ জুলাই পর্যন্ত ছেলেধরা গুজবের শিকার কত জন?
২০১৮-র মাঝামাঝি এসে কিন্তু এই ধরনের গুজব আরও বেশি করে ছড়িয়েছে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহেই দেশের নানা প্রান্তে এ রকম ৯টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। তাতে ৫ জনের মৃত্যুও হয়েছে।
২০১৭-র আগের বছরগুলোয় চোখ রাখলে কিন্তু এই ছেলেধরা গুজবে গণপ্রহারের ঘটনা অনেক দিন নজরে আসে না। ২০১২-র অগস্টে শেষ বার বিহারের পটনায় এই রকম একটা ঘটনা ঘটেছিল বলে সমীক্ষা থেকে জানা যায়।
সূত্র : আনন্দ বাজার/ইন্ডিয়াস্পেন্ড