প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ ঢাকা বিমান বন্দর সড়কে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজ সংলগ্ন পথচারী আন্ডারপাস নির্মাণকাজের উদ্বোধনকালে সরকারি কর্মচারীদের তাদের দায়িত্ব আন্তরিকতার সঙ্গে প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষানুযায়ী পালনের আহবান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের শিশুরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে, বিবেককে জাগ্রত করেছে। তাই আমি আশা করবো জনগণ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষানুযায়ী সকলেই তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করবেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকলকে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে। ড্্রাইভার ও হেলপারদেরও আইন মানতে হবে। ওভারটেকিং না করে লাইন দিয়ে বাস চালাতে হবে। ওভারটেক করতে গেলে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজ চত্বরে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেন।
তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত পুলিশ মহাপরিদর্শকের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট সকলকে যথাযথভাবে নির্দেশ দিতে হবে যেন কোনরকম অনিয়ম না হয়।’
সড়কে ট্রাফিক সম্পর্কিত অপরাধ আইন শৃঙ্খলাবাহিনী অনেক সময় সনাক্ত করতে পারে না এ কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী যানবাহন নিয়ন্ত্রণে সকল সড়কে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন ও ডিজিটাল নম্বর প্লেট ব্যবহার নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এর মাধ্যমে লেজার সিগন্যাল দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে অনিয়ম সনাক্ত করা যাবে বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারি কর্মচারীদের অহেতুক বিলম্ব পরিহারের আহবান জানিয়ে বলেন, এই আন্ডারপাস প্রকল্পটি যথাসময়ে বাস্তবায়িত হলে দুটি অমূল্য প্রাণ হয়তো এভাবে ঝড়ে যেত না।
তিনি শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজের নিহত শিক্ষার্থী দিয়া খানম মীম এবং আব্দুল করিম রাজিবের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাদের শোক-সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।
মীম এবং রাজিব ২৯ জুলাই বিমান বন্দর সড়কে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শহীদ রমিজ উদ্দিন স্কুল ও কলেজের কাছেই জাবালে নূর পরিবহণের বাসের চাপায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারায় এবং এ দুর্ঘটনায় আরো কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়।
অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বক্তৃতা করেন।
এ সময় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল মসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল নিজামুদ্দিন আহমেদ এবং জ্যেষ্ঠ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার ইন চিফ মেজর জেনারেল সিদ্দিকুর রহমান সরকার প্রকল্প সংশ্লিষ্ট উপস্থাপনায় জানান, সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ারিং বিগ্রেড ৪৩ মিটার দীর্ঘ এই মাল্টিপারপাস অত্যাধুনিক আন্ডারপাসটির নির্মাণ কাজ ১ বছরের মধ্যে শেষ করবে। সরকারের অর্থায়নে এর ব্যয় নির্ধারিত হয়েছে ৫৪ কোটি টাকা।
প্রধানমন্ত্রী শহীদ রমিজ উদ্দিন স্কুল ও কলেজের সামনে নির্মাণাধীন আন্ডারপাস প্রকল্পে বিলম্বে উস্মা প্রকাশ করে বলেন, এই আন্ডারপাস আগেই ডিজাইন করা হলেও এতে একটি সামান্য সমস্যা ছিল এবং এটি জানার পর তিনি তা দূর করার উদ্যোগ নেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন নির্মাণ কাজ করতে গেলেই জমির মালিকানা নিয়ে যে সমস্যায় পড়তে হয় সে সমস্যা এখানেও ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাস্তা কার, জায়গা কার, জমি কার, লেক থাকলে পানি কার এগুলো নিয়ে একটা বিতর্ক থাকে, আমি আশাকারি এই সমস্যাগুলো আর হওয়া উচিত নয়। এরজন্য যথাযথ ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে।
তিনি বলেন, টাকা কে দেবে এজন্য দীর্ঘদিন এই আন্ডারপাসের প্লান করেও বসে থাকা হয়েছে। এখানে যখন রেডিসন হোটেল হলো, মেডিকেল কলেজ হলো, তারপরে স্কুল এবং ফ্লাইওভার করার পর থেকেই এই নকশা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সবাইকে অনুরোধ করবো আমাদের এখানে বড় বড় আমলারা আছেন-তাদেরকে বলবো আপনারা যদি কোন সমস্যা সমাধান করতে না পারেন, আমিতো রয়েছিই। আমাকে জানানো হলে সেই সমস্যার সমাধান করে দিতে পারি।’ এজন্য প্রধানমন্ত্রী তার নিজস্ব মোবাইল ফোনে বা অফিসে যোগাযোগের অনুরোধ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাস চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী সকলকে যথাযথভাবে ট্রাফিক আইন মেনে চলার আহবান জানান। তিনি উপস্থিত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘রাস্তা পারাপারের সময় অন্তত দাঁড়িয়ে একবার ডানে ও একবার বামে দেখে নিতে হবে কোন গাড়ি আসছে কিনা। আর রাস্তা পারাপারের জন্য যে জায়গাটি নির্দিষ্ট করা রয়েছে- কোথাও ফুটওভার ব্রীজ, কোথাও জেব্রা ক্রসিং, কোথাও আন্ডার পাস আছে- ঠিক সেইসব জায়গা দিয়েই রাস্তা পারাপার হতে হবে। এর বাইরে দিয়ে রাস্তা পার হওয়া মোটেই ঠিক নয়। আর কেউ যদি এ ধরনের কাজ করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি বলেন, ফিটনেস ও লাইসেন্সবিহীন গাড়ি সড়কে চলতে পারবে না। হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ সংশ্লিষ্ট এলাকা এবং যেখানে বেশি মানুষের চলাচল রয়েছে সেখানে ফুটওভার ব্রীজ বা আন্ডারপাস করে দেওয়ার জন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দেন।
বক্তৃতায় সরকার প্রধান বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন এবং শিক্ষিত জাতি গঠনে তাঁর সরকারের বৃত্তি-উপবৃত্তিসহ নানা সহায়তা প্রকল্পের কথাও উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, নিরাপদে গাড়ি চালানো নিশ্চিত করার জন্য সরকার চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেও অনেক চালক এতেও ফাঁকি দেয়। তারা নিজেরা ভালোভাবে ট্রেইনিং করে না। আবার হেলপারদের হাতেও গাড়ি দিয়ে দেয়। তারপরও সরকারের নানা পদক্ষেপের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা অনেকটা হ্রাস পেয়েছে।
দুর্ঘটনার দিন বিমানবন্দর সড়কে রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসের চালক নিয়ম-বহির্ভূতভাবে গাড়ি চালাচ্ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ধরনের অপরাধ ক্ষমা পাবে না। দায়ী চালকদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে।
গুজবে বিভ্রান্ত না হয়ে সত্য যাচাইয়ের পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীসহ সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়েছি সুশিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষার জন্য। অশ্লীল কথা বা গুজবের জন্য নয়।’
তিনি বলেন, ‘এই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে অনেকে গুজব ছড়িয়েছে। দয়া করে গুজবে কান দেবেন না।’
তিনি এ সময় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁর আহবানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ঘরে ফিরে যাওয়ায় শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানান।
২৯ জুলাই দুর্ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামলে তাদের দাবি-দাওয়া সরকার মেনে নেয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্দোলনে যখন দেখলাম স্কুলের ইউনিফর্ম বানিয়ে অনেকে ঢুকে পড়ছে, বুঝলাম তৃতীয় পক্ষ, যারা রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চায়। এটা দেখার পর শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়ি। তখন একটি অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ঘরে ফিরে যেতে বলি। আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই, তারা সময় মতো ঘরে ফিরে গেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যখন আমাদের (ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের কার্যালয়) অফিস আক্রান্ত হলো, তখন সেখান থেকে ফোন আসছিল, বলা হচ্ছিলো- আমরা তো টিকতে পারছি না, শুধু পাথর ছোড়া হচ্ছে। তখন বলেছি শুধু ধৈর্য ধরতে।
তিনি প্রশ্ন তোলেন, কারা করলো এটা? সেসময় ব্যাপক গুজব ছড়ানো হয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে বিভিন্ন দর্জি দোকানে ইউনিফর্ম বানানোর হিড়িক পড়ে গেছে, এসব কারা করেছে?’
শিশু কিশোরদের আন্দোলনের সময় সবাই ট্রাফিক আইন মেনে চললেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর আবার পুরনো বিশৃঙ্খলা ফিরে আসায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, ‘যতদিন শিক্ষার্থীরা রাস্তায় ছিল, তারা ট্রাফিক কন্ট্রোল করছিল এবং সবাই কিন্তু তাদের কথা মেনে নিয়েছিল, এটা ঠিক। কিন্তু যখনই সবাই ফিরে গেল স্বাভাবিক হলো যানবাহন চলাচল, তারপর কী দেখি? রাস্তার পাশেই ফুটওভার ব্রিজ, আমরা দেখলাম ইয়ং ছেলে মেয়ে সামান্য কয়েক কদম হাঁটলে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে পারে, সেটা না করে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে হাত দেখিয়ে দেখিয়ে।’
‘হাত দেখিয়ে দেখিয়ে বেআইনিভাবে রাস্তা পার হওয়া, সেটাও কিন্তু গ্রহণযোগ্য নয়’ সতর্ক করেন প্রধানমন্ত্রী।
নগরীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা যাবে না। নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলতে হবে। এমনকি বাসেও বিন থাকতে হবে। তিনি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীকেও নির্দেশনা প্রদান করেন।
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার স্বার্থে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে থাকতে পারে বলেও অভিমত দেন প্রধানমন্ত্রী।