যে কারণে তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক বিরোধ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

তুরস্ক উপকূলের ইযমির শহরের একটি সরু রাস্তার পাশে হলুদ ফটকের একটি চার্চ। পিয়ের ফেরিঘাট থেকে অল্প হাঁটলেই সেখানে যাওয়া যায়। শুধু একটি বিবর্ণ সাইনবোর্ডে এই চার্চের পরিচয় বলা হয়েছে। কয়েকজন মানুষ এই চার্চের নিয়মিত ধর্মসভায় যাতায়াত করতেন। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। রোববারের প্রার্থনা সভায় এখন অসংখ্য আন্তর্জাতিক প্রতিবেদকের ভিড় লেগে যায়।

সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্র আর তুরস্কের মধ্যে যে তিক্ত কূটনৈতিক টানাপড়েন শুরু হয়েছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে এই চার্চটি। কারণ এখানে কর্মরত আমেরিকান যাজক অ্যান্ড্রু ব্রনসনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করার অভিযোগ এনেছে আঙ্কারা।

universel cardiac hospital

দুই বছর আগে পর্যন্ত অ্যান্ড্রু ব্রনসন শান্তিতেই চার্চে কাজ করতেন। তার একজন বন্ধু জানিয়েছেন, ২০১০ সাল থেকে এখানে তৈরি করা ছোট্ট ধর্মসভা পরিচালনা করতেন ব্রনসন। উত্তর ক্যারোলিনা থেকে আসা ব্রনসন স্ত্রী নোরিনকে নিয়ে তুরস্কে আসেন ১৯৯৩ সালে। এখানেই তারা তাদের তিন সন্তানকে বড় করেছেন।

২০১৬ সালের ৭ অক্টোবর এই দম্পতিকে ডেকে পাঠায় স্থানীয় থানা। তারা স্বেচ্ছায় সেখানে যান। কিন্তু মুক্তি দেয়ার বদলে তাদের দুইজনকেই হেফাজতে নেয় পুলিশ।

বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোয়ানের বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পর যে ৫০ হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এই গ্রেপ্তার দিয়ে তাদের অংশ হলেন ব্রনসন দম্পতি।

এর কয়েকদিন পর নোরিন ব্রনসনকে মুক্তি দেয়া হয়। তবে ডিসেম্বর মাসে যাজক ব্রনসনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠন করে তুরস্ক তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

কৌসুলিরা বলছেন, ব্রনসনের সঙ্গে দুটি গ্রুপের যোগাযোগ রয়েছে, যাদের সন্ত্রাসী বলে মনে করে তুরস্ক। অপরাধ প্রমাণিত হলে তার ৩৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে, তিনি কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টিকে (পিকেকে) সাহায্য করছেন। এই দলের নেতা ফেতুল্লাহ গুলেন- ব্যর্থ ওই অভ্যুত্থান চেষ্টার জন্য যাকে দায়ী করছে তুরস্ক।

গুলেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় বসবাস করেন এবং অভ্যুত্থান চেষ্টার সঙ্গে কোনরকম জড়িত থাকার অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন। বিচারের মুখোমুখি করতে তাকে তুরস্কে ফেরত পাঠানোর দাবি করছে আঙ্কারা।

ব্রনসনের স্বজন ও বন্ধুরা অভিযোগ করছেন, কূটনৈতিক দর কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে এই ধর্মযাজককে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে তুরস্ক। তার গ্রেপ্তার তাকে বরং আরো মহান করে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসবাইটেরিয়ান সম্প্রদায়ের লোকজন তার জন্য প্রার্থনা করছে, এমনকি তার জন্য অনাহারেও থাকছে।

তুরস্ক জানিয়েছে, আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে আদালতের কার্যক্রম চলছে।

বর্তমান সংকটের শুরু হয় গত ১৮ জুলাই থেকে, যখন শুনানির পর তুরস্কের একটি আদালত ব্রনসনকে কারাগারে রাখার আদেশ দেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সিদ্ধান্তকে ‘অসম্মান’ বলে বর্ণনা করেন এবং তাকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার জন্য তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের প্রতি আহবান জানান।

‘তাকে দীর্ঘদিন ধরে জিম্মি করে রাখা হয়েছে’ মন্তব্য করে এক টুইট বার্তায় ট্রাম্প লিখেছেন, ‘এরদোয়ানের উচিত এই চমৎকার খৃষ্টান স্বামী ও পিতার মুক্তির জন্য কিছু করা। তিনি অন্যায় কিছু করেননি, তার পরিবার তাকে পেতে চায়।’

স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটার কারণে গত ২৫ জুলাই ব্রনসনকে কারাবন্দীর বদলে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। এই সিদ্ধান্তে ওয়াশিংটন স্বাগত জানালেও পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছে।

ব্রনসনকে মুক্তি না দেয়ায় সর্বশেষ গত ১ আগস্ট তুরস্কের বিচার এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে হোয়াইট হাউজ।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর সর্বশেষ একটি চেষ্টার পর, শুক্রবার ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন, তুরস্ক থেকে আমদানি করা স্টিল আর অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক দ্বিগুণ করা হবে।

এই বিতণ্ডা এখন পুরোমাত্রার একটি কূটনৈতিক সংকটে পরিণত হয়েছে। এর আগে ১৯৭৪ এবং ১৯৭৮ সালে তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, যখন ১৯৭৪ সালে তুরস্ক সাইপ্রাসে অভিযান চালায়।

সাম্প্রতিক এই নিষেধাজ্ঞার পর তুরস্কের লিরার মূল্যমান ২০ শতাংশ পড়ে গেছে। বিনিয়োগকারীরা বিক্রি বাড়িয়ে দেয়ায় আরো কয়েকটি উদীয়মান অর্থনীতির মুদ্রার মানও কমেছে।

পাল্টা জবাব হিসেবে এরদোয়ান বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইলেকট্রনিক পণ্য বর্জন করবে তুরস্ক। আমেরিকান সরবরাহকারীদের সাথে ব্যবসাকারী কোম্পানিগুলোকে বিকল্প খোঁজার জন্যও তিনি আহবান জানিয়েছেন।

টার্কিশ এয়ারলাইন্স এবং টার্ক টেলিকমের মতো বড় ব্যবসায়িক কোম্পানিগুলো ঘোষণা দিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক কোনো মিডিয়ায় আর বিজ্ঞাপন দেবে না।

যখন দুই ন্যাটো সহযোগী দেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপের দিকে যাচ্ছে, তখন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় বৈঠকের জন্য এসেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রকে এক হাত দেখে নেয়ার সুযোগের ব্যবহার করছেন ল্যাভরভ। রাশিয়া এবং তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা ‘অবৈধ’ এবং ‘বিশ্ব বাণিজ্যে অন্যায় সুবিধা নিতে’ ওয়াশিংটন এসব করছে বলে তাদের দাবি।

তুরস্ক আর যুক্তরাষ্ট্রের এই তিক্ত কূটনৈতিক বৈরিতার কোনো সমাধানের আলো দেখা যাচ্ছে না- পাশাপাশি তুরস্কে ব্রনসনের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে