রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ইতিহাসের দেশটি বসনিয়া নামেই বেশি পরিচিত। বলা হয়ে থাকে, বসনিয়া হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে জটিল নির্বাচনের দেশ।যে দেশে গতকাল রবিবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এ সাধারণ নির্বাচনে রুশপন্থী জাতীয়তাবাদীদের জয়ের সম্ভাবনা বেশি। এদের মধ্যে রয়েছে রিপাবলিকা সরপস্কা এবং এইচডিজেড পার্টি। রবিবারের নির্বাচনে মোট ৫৩টি দল লড়াই করেছে। ভোটার ৩৩ লাখ।
আলজাজিরা বলছে, ২০ বছরের আগের সাম্প্রদায়িক যুদ্ধের ক্ষত ভুলে যাবে কি-না, গতকালের ভোটের রায় সেই প্রশ্নের বড় একটা জবাব হতে পারে। ১৯৯৫ সালের যুদ্ধে কম করে এক লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল। এদিকে লাতভিয়ায় নির্বাচনেও রুশপন্থী দলের জয়ের আভাস মিলেছে।
বসনিয়া যুদ্ধের পর ইউরোপের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের দেশটিতে এটি অষ্টম সাধারণ নির্বাচন। কেন্দ্র, দুই স্বতন্ত্র সরকার, ক্যানটন ও ডিস্ট্রিক্ট অব ব্রিচকোতে এই নির্বাচন হবে। কেন্দ্রীয় প্রেসিডেন্ট (তিনজন), কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট, দুই অংশের অ্যাসেম্বলি, ব্রিচকো ও সার্ব স্বতন্ত্র অংশ রিপাবলিকা স্রেপ্সকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো।
কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন–মনোনীত ৫৩টি দল, ৩৬টি জোট ও ৩৪ স্বতন্ত্র প্রার্থী এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। দেশের বেশির ভাগ মানুষই ভোটার। ভোট দেবেন ৩৩ লাখ ৫২ হাজার ৯৩৩ জন ভোটার। তিন সদস্যের কেন্দ্রীয় প্রেসিডেন্সি পর্ষদের জন্য প্রার্থী হয়েছেন ১৫ জন। এর মধ্যে বসনীয় আসনের জন্য ছয়জন, ক্রোয়েট আসনের জন্য পাঁচজন এবং সার্বীয় আসনের জন্য চারজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
এই নির্বাচনের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২ লাখ ইউরো (৪০ কোটি ৫৫ লাখ টাকার বেশি)। ১৯৯৫ সালে ডেটন শান্তি চুক্তির মধ্য দিয়ে দেশটিতে সাড়ে তিন বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটে। যে যুদ্ধে লাখো মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। স্থানচ্যুত হয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। সমালোচকদের দৃষ্টিতে নড়বড়ে চুক্তিটির মাধ্যমে দেশটিকে দুটো আধা স্বতন্ত্র শাসনে বিভক্ত করা হয়েছে, যা একটি দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যুক্ত।
এই সরকার বিভক্তিগুলোকে আরও প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং বসনিয়াকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। একাধিক প্রেসিডেন্টের দেশ বলকান উপদ্বীপে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ত্রিভুজ আকৃতির। বসনিয়া অঞ্চলটি উত্তরে পাহাড় ও গভীর বনবেষ্টিত। বিশাল এলাকাজুড়ে অমসৃণ ও সমতল কৃষিভূমির হার্জেগোভিনা অঞ্চলটি দক্ষিণে। এর সংকীর্ণ উপকূল। দেশটির আয়তন ৫১ হাজার ১২৯ বর্গকিলোমিটার। লোকসংখ্যা ৩৫ লাখ ২৬৩৬ জন। রাজধানীর সারায়েভো। দেশটির মুদ্রার নাম মার্কা।
অন্য দেশের মতো বসনিয়ায় একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন না। বসনীয়, সার্ব ও ক্রোয়েট—এই তিন জাতির সমন্বিত প্রেসিডেন্সি পর্ষদ রয়েছে সেখানে। প্রেসিডেন্সি পর্ষদের নেতৃত্বে বা চেয়ারম্যান পদে আট মাস পরপর পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন আসে। প্রেসিডেন্সি পর্ষদে এখন রয়েছেন এসডিএ দলের বাকির ইজেৎবেগোচ (বসনীয়), পিডিপি দলের ম্লাদেন ইভানিচ (সার্ব) ও এইচডিজেড বিহ দলের দ্রাগন চোভিচ (ক্রোয়েট)। ১৭ মার্চ থেকে এ পর্ষদে চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন বাকির ইজেৎবেগোচ। এর বাইরে রিপাবলিকা স্রেপ্সকার জন্য পৃথক প্রেসিডেন্ট রয়েছেন। এই অংশের বর্তমান প্রেসিডেন্টের নাম মিলোরাদ দোদিক।
দেশটিতে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় ১৯৯৬ সালে। সরকারের মেয়াদ ৪ বছর। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় দুটি স্বতন্ত্র পক্ষ রয়েছে। একটি দ্য ফেডারেশন অব বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, যেটিতে মুসলিম বসনিয়াক ও ক্রোয়েটদের আধিপত্য বেশি। অপরটি হচ্ছে সার্বদের পরিচালিত রিপাবলিকা স্রেপ্সকা। দেশটির পার্লামেন্ট দুই কক্ষবিশিষ্ট। দ্য হাউস অব পিপলস এবং দ্য হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ। হাউস অব পিপলসে ১৫ জন সদস্য রয়েছেন। এর দুই–তৃতীয়াংশ ফেডারেশন অব বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার এবং এক-তৃতীয়াংশ স্রেপ্সকার। অর্থাৎ বসনিয়াক (বসনিয়ার মুসলিম), ক্রোয়েট ও সার্বদের পাঁচজন করে সদস্য রয়েছেন এতে।
হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে রয়েছেন ৪২ জন সদস্য। এর দুই-তৃতীয়াংশ ফেডারেশন থেকে এবং এক-তৃতীয়াংশ স্রেপ্সকা থেকে ভোটারদের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। এর বাইরে দুই অংশের আলাদা প্রেসিডেন্ট, সরকার, সংসদ, পুলিশ ও পৃথক কর্তৃপক্ষ রয়েছে। সব মিলিয়ে দেশটিতে ৪ জন প্রেসিডেন্ট, ৫টি পার্লামেন্টারি হাউস এবং ১০টি ক্যানটন অ্যাসেম্বলি (শাসনতান্ত্রিক বিভাগ) রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য ভোটাররা তিন সদস্যের প্রেসিডেন্সি পর্ষদ ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত করে।
ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কথিত দুই স্বতন্ত্র পক্ষের এই সরকার গঠন হয়। এত জটিল হিসাব–নিকাশের পর যে–কারও মাথায় একটি প্রশ্ন আসতে পারে যে তাহলে বসনিয়ার নেতৃত্ব কে দেন? এর উত্তরও এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। জাতীয় বা কেন্দ্রীয় সরকার সামরিক বাহিনী, বিচার বিভাগ, রাজস্ববিষয়ক নীতি প্রণয়ন, বৈদেশিক বাণিজ্য ও কূটনীতির বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত। এর চেয়ে দুটি স্বতন্ত্র অংশই তুলনামূলক বেশি কেন্দ্রীভূত। তাদের আলাদা পুলিশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রয়েছে। দুই স্বতন্ত্র অংশের বিভেদ দেশটির শাসনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয় বারবার।
বসনিয়াক বা মুসলিমরা চায় কেন্দ্র শক্তিশালী হোক। অন্যদিকে, সার্বরা কোনো অবস্থায় স্বতন্ত্র শাসন সমর্পণ করতে রাজি নয়। আর ক্রোয়েটদের মধ্যে বিভক্তি আরও বেশি। তাঁদের অনেকে আশা করেন, ক্রোয়েটদেরও স্বতন্ত্র শাসন তৈরি হবে। বিশ্লেষকদের মতে, ডেটন শান্তি চুক্তির মাধ্যমে বসনিয়ায় রক্তগঙ্গা বন্ধ হয়েছে ঠিকই, তবে দেশটির একেবারে হাত পা বেঁধে ফেলা হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রত্যাশা রয়েছে বসনিয়ার। সে ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দাবি, নানা সরকারের দেশটিকে ‘একটি কণ্ঠে কথা বলতে পারার’ উপায় খুঁজে বের করতে হবে। যদিও বিষয়টি প্রায় দুঃসাধ্য। স্বতন্ত্র সরকার রিপাবলিকা স্রেপ্সকার প্রেসিডেন্ট মিলোরাদ দোদিক বরাবরই বসনিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করে আসছেন। যুদ্ধ–পরবর্তী বসনিয়া তাঁর মতে একটি ‘ব্যর্থ ধারণা’।
বিশ্লেষকদের মতে, বসনিয়ার অতীত ইতিহাস থেকে বোঝা যায়, সেখানে শান্তি বজায় রাখা কঠিন ব্যাপার। স্বাধীন হলেও নতুন যুদ্ধ শুরু ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে যুগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয় বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) স্বীকৃতি চাওয়া হয়।
১৯৯২ সালের মার্চে এক গণভোটে বসনিয়ার ভোটাররা স্বাধীনতা বেছে নেয়। প্রেসিডেন্ট আলিজা ইজেৎবেগোচ এটিকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। বসনিয়ার বাসিন্দাদের মধ্যে মুসলিম ৪৪ শতাংশ, সার্ব ৩১ শতাংশ ও ক্রোয়েট ১৭ শতাংশ। এই তিন জাতির প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারব্যবস্থা গড়ে ওঠে সেখানে। তবে স্বাধীন হয়েও সেখানে শান্তি ফিরে আসেনি, শুরু হয় জাতিগত যুদ্ধ।