১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্মলাভ করলো বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নের দেশ বাংলাদেশ। লাখো শহীদের রক্ত, মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত দেশে একদিকে বিজয়ের আনন্দ অন্যদিকে চারদিকে স্বজন হারানোর বেদনা। এরই মাঝে বিজয়ের মহানায়ক নতুন জাতির স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শত্রু শিবির পাকিস্তানে বন্দিত্ব পুরো জাতিকে ডুবিয়ে রেখেছে হাহাকারে। এই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠিত বিশ্ব। পাকিস্তানিদের ব্যাপারে ঢাকায় মুজিবনগর সরকারের নেতৃবৃন্দও অন্ধকারে। ১৬ ডিসেম্বরের পরে পাকিস্তানে জনগণের রোষানলে ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী।
কিস্তানি শাসক জুলফিকার আলী ভুট্টো মাথা গরম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর প্ররোচণায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে কি না, তা নিয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দও উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস যে গণহত্যা পরিচালিত হয়েছিল সে সময়ও আপামর জনগণ বঙ্গবন্ধুর বেঁচে থাকার জন্য দিনরাত নামাজ রোজা রেখেছিল। এমনি পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধারা দৃঢ়সঙ্কল্পবদ্ধ বঙ্গবন্ধুর কিছু হলে পাকিস্তান আক্রমণের। এই পরিস্থিতিতে সারাবিশ্বের মিডিয়ার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ। সদ্য স্বাধীন দেশ ও তাঁর নেতার প্রতি মুহূর্তের খবরের জন্য উন্মুখ বিশ্ববাসী।
২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পেনাং, স্ট্রেইট ইকো পত্রিকায় ‘ঘড়িতে অনেক সময় বয়ে গেছে’ শিরোনামে লেখা হয় ‘গ্রেফতারকৃত আশি হাজার পাকিস্তানি সৈন্য এবং ৯০ লাখ পাকিস্তানিদের মুক্তি দেয়ার ব্যাপারটি এখনো বাঙালি জনগণের ইচ্ছার ওপর। এই পরিস্থিতিতে মি. ভুট্টো যদি শেখ মুজিবুর রহমানকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করতে চান, তাহলে দ্রুতই তার মোহমুক্তি ঘটবে। মুজিব বাংলাদেশের জাতির পিতা, তিনি কখনো চান না যে, তার জাতি অন্য কোনো আদর্শের পতাকাতলে পরিচালিত হোক।
যদি মি. ভুট্টো উপলব্ধি করে থাকেন, তার এই ক্ষমতা পাওয়া পূর্ব খণ্ডের মতোই একটি গণতান্ত্রিক বিজয়; তবে তিনি বাংলাদেশের জন্ম ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করে ঘড়ির কাঁটা পিছনে ফিরিয়ে নেয়ার মতো এক ব্যর্থ চেষ্টা করছেন।’ ৩ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বিখ্যাত পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস ‘ভুট্টোর তুরুপের তাস’ শিরোনামে সম্পাদকীয়তে লেখে ‘ধূর্ত রাজনৈতিক খেলোয়াড় মি. জুলফিকার আলী ভুট্টো দুই সপ্তাহ আগে পরাজিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সাথে সাথে এক হাত খারাপ তাসের উত্তরাধিকারী হয়েছেন। কিন্তু মি. ভুট্টো উত্তরাধিকারীভাবে একটি তাস পেয়েছেন, যেটাকে তিনি পাকিস্তান বিভক্তি, ভারত ও বিদ্রোহী পূর্ব বাংলার (যেটা এখন বাংলাদেশ) সাথে কূটনৈতিক খেলার কঠোরভাবে কাজে লাগাতে চেষ্টা করবেন।
মি. ভুট্টোর তুরুপের তাস পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কলঙ্কিত সরকার ২৫ মার্চের গণহত্যার পূর্বাহ্নে গ্রেফতার করে। কিন্তু এ মুহূর্তে বাংলাদেশের জনগণের জন্য শেখ মুজিবের নেতৃত্ব একান্তভাবে জরুরি। এই নতুন জাতির পুনর্বাসন ও অগ্রগতির জন্য তাঁর নেতৃত্বের বিকল্প নেই। অপরদিকে ভারতের জন্যও শেখ মুজিবের প্রয়োজন। কারণ ভারতের সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র এই বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল সরকার, তদুপরি শরণার্থীদের দ্রুত প্রত্যাবর্তন, ভারতীয় সৈন্য ফিরিয়ে আনা এসব সমস্যা সমাধানের জন্যও শেখ মুজিবের নেতৃত্ব অপরিহার্য।
অবশ্য মি. ভুট্টো শেখ মুজিবকে কয়েদখানা থেকে গৃহবন্দি হিসেবে স্থানান্তরিত করতে সময় নষ্ট করেননি এবং ব্যক্তিগতভাবে তার সাথে দেখাও করেছেন। কিন্তু পাকিস্তানের নেতা এখনও স্পষ্ট করে বলেননি তিনি মুক্ত শেখ মুজিবকে ঢাকায় পাঠানোর পরিবর্তে কি মূল্য আশা করেন। তবে যাই হোক, ভারতীয় সৈন্যের কাছে পাকিস্তানের পরাজিত হওয়ার পর ভুট্টোর এ ব্যাপারে খুব বেশি কিছু আশা করার পথ খোলা নেই। বরং এ তাস নিয়ে বেশি খেলতে গেলে তিনি বিপদ ডেকে আনবেন। এ মুহূর্তে বিশ্ববাসী শেখ মুজিবের দ্রুত ঢাকা প্রত্যাবর্তন আশা করেন। তাছাড়া এ মুহূর্তেই তারা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের মুখে শেখ মুজিবের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সত্য কথাটি জানতে চায়।’
৩ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে কুয়ালালামপুরের ‘স্ট্রেইট টাইমস’ পত্রিকা সম্পাদকীয়তে ‘বাস্তবতার মুখোমুখি ভুট্টো’ শিরোনামে লেখে ‘প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। যদিও তিনি সবসময় বলছেন, পাকিস্তানের প্রদেশ দুটি। তবুও তিনি তার জনগণকে একটি প্রদেশ হারানোর বাস্তবতাকে গ্রহণ করার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন শেখ মুজিবকে শিগগিরই বিনাশর্তে মুক্তি দেয়া হবে। কারণ প্রেসিডেন্ট ভুট্টো উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছেন মুজিবকে আটকে রেখে যেমন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মেজাজ পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না, তেমনি ইসলামাবাদের ভাবমূর্তি বাড়ানো সম্ভব নয়। বরং পাকিস্তানের এ মুহূর্তে বেশি প্রয়োজন ভারতের সাথে একটি সমঝোতায় আসা। যেহেতু অফিসারসহ ৯০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ভারতের কাছে বন্দি। কেবলমাত্র শেখ মুজিবের মুক্তিই যুদ্ধ বন্দিদের ফেরত পাবার লক্ষ্যে ভারতের সাথে আলোচনার দ্বার খুলতে সমর্থ হবে।’
৫ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বিখ্যাত ‘ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর বোস্টন’ পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে ‘বিজ্ঞ পদক্ষেপ’ শিরোনামে লেখা হয়, ‘পাকিস্তানের নেতা মি. ভুট্টো জানিয়েছেন তিনি পূর্ব বাংলার সাথে ফেডারেশনের মতো একটি সম্পর্ক রাখতে চান। বাস্তবে এ ধরনের আশা করা ভুলের স্বর্গে থাকারই সমান। কারণ পূর্ব বাংলা এখন গর্বিত স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। বরং পূর্ব প্রদেশে দুঃখজনক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং শেষ পর্যন্ত সামরিক বিপর্যয়ের পর পাকিস্তানের জন্য এ মুহূর্তে বিজ্ঞ পদক্ষেপ হবে উপমহাদেশের সৌহাদ্যপূর্ণ প্রতিবেশী গড়ে তোলার চেষ্টা। এলক্ষ্যে তার অবিলম্বে ভারতের সাথে আলোচনায় বসা প্রয়োজন। আর এই আলোচনার পথ খোলা সম্ভব একমাত্র শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দেবার মধ্য দিয়ে।’
বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার ও বিচার
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পূর্ব মুহূর্তে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সমগ্র জাতিকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে মোকাবেলা করার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ও ২৬ মার্চের ঘোষণা বুকে ধারণ করেই সমগ্র জাতি মরণপণ সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অস্ত্র হাতে দুশ চব্বিশ বছরের পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করতে চালিয়ে গেছে সশস্ত্র সংগ্রাম। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধকালীন এই সময়ে চেষ্টা চালিয়েছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপ, সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমাগত আক্রমণ সর্বোপরি আল্লাহর অশেষ রহমতে রক্ষা পায় তাঁর জীবন। এই সময় সারাবিশ্বের সব পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু ছিল অন্যতম প্রধান আলোচিত বিষয়।
১৫ আগস্ট ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট-এর বক্তব্য ‘শেখ মুজিবের বিচার পূর্ব বাংলায় নভেম্বরের ভয়াবহ ঘূণিঝড়ের চেয়ে ভয়ংকর অবস্থা সৃষ্টি করবে উথান্ট’ শিরোনাম করে ‘লা নাসিঅন, বুয়েনাস অ্যারিস’ পত্রিকা লেখে ‘জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল মি. উথান্ট হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীর অভিযোগ এনে গোপন বিচার করলে পূর্ব বাংলার অবস্থা গত নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংস ও মৃত্যুর চেয়ে ভয়ংকর হবে। এদিকে ইয়াহিয়া খানের প্রশাসন শেখ মুজিবকে কোথায় রাখা হয়েছে সেটাও স্বীকার করতে নারাজ। তাদের তথ্য বিভাগ এটুকুই শুধু বলতে রাজি যে, পাকিস্তানের কোন এক স্থানে শেখ মুজিবের বিচার হচ্ছে। ঐতিহ্যগতভাবে পশ্চিমা চিন্তাধারায় বিশ্বাসী গণচীনের প্রতিবেশী এই দেশটির বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের অর্থাৎ জনগণের ভোট শক্তি এবং ইয়াহিয়া খানের ক্ষাত্র শক্তির ভেতর শেখ মুজিবই একমাত্র সমঝোতা।
উল্লেখ্য, শেখ মুজিবের দল গত ডিসেম্বর-এর নির্বাচনে শতকরা ৯৮ ভাগ ভোট পেয়েছিল। অপরদিকে বিশ্বজনমতও উথান্টের সাথে একমত যে শেখ মুজিবের বিচারের পরিণতি হবে ভয়াবহ।’ ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে ‘ত্রিনিদাদ গার্ডিয়ান, পোর্ট অব স্পেন’ পত্রিকায় ‘নির্বাচিত নেতা রাজক্ষমার অপেক্ষা রাখে না’ শিরোনামে সম্পাদকীয়তে লেখা হয় ‘অতিবড় মূর্খ ছাড়া এ মুহূর্তে কেউ-ই ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মন্তব্য করতে সাহসী হবে না।
ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন এদেশটি এখন মানুষের সৃষ্ট দুর্ভোগের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত। এমনকি নিরাপত্তার খোঁজে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ জনগণ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের দায়িত্ব ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা। আর এলক্ষ্যে তার উচিত ছিল পদত্যাগ করা, কিন্তু তা না করে গত কয়েক মাসে তিনি আরো সমস্যার জট পাঁকিয়ে তুলেছেন। সবেমাত্র নয় মাস হলো শেখ মুজিবের নীতির প্রতি সমর্থন জানিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ভোটাররা তাঁকে নিরঙ্কুশ জয় এনে দিয়েছিল। কিন্তু সেই শেখ মুজিব এখন দেশদ্রোহিতার অপরাধে বিচারের মুখোমুখি। এবং সম্ভবত তাঁকে মৃত্যুদণ্ডই দেয়া হবে। শেখ মুজিবের বক্তব্য পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ঠ অথচ সব সময়ের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতিদের দ্বারা শোষিত হয়ে আসছে। বস্তুত পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান কলোনি হিসেবে ব্যবহার করছে।
ওই বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করেই শেখ মুজিব নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে সমর্থ হয় এবং তিনি তার স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলেন। কিন্তু এই দাবি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও পশ্চিম খণ্ডের বিজয়ী নেতা মি. ভুট্টো (অবশ্য ভুট্টোর আসন সংখ্যা শেখ মুজিবের তুলনায় নগন্য) কর্তৃক বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ কারণেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সামরিক শাসন জারি হবার সাথে সাথে বাংলাদেশও স্বাধীনতার দাবিতে চলে এসেছে। তাই যদিও সাধারণ ক্ষমা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার চেষ্টার একটি প্রতীক তবুও এক্ষেত্রে সেটি খুব বেশি কার্যকর হবে না বা কার্যকর হবে না গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে যতক্ষণ না পর্যন্ত স্পষ্টভাবে শেখ মুজিবের প্রতি ভদ্রতা প্রদর্শন করা হবে।’
বঙ্গবন্ধুর মুক্তি
১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর পুরো জাতি অধীর আগ্রহে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির প্রতীক্ষার প্রহর বুনছিলেন। ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এদিন তিনি মুক্তি পেয়ে লন্ডনে পৌঁছেন। ১০ জানুয়ারি নয়াদিল্লি হয়ে তিনি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁর এই প্রত্যাবর্তন ছিল অন্ধকার থেকে আলোয় প্রত্যাবর্তন। সেসময় সারাবিশ্বের মিডিয়া প্রতি মুহূর্ত অনুসরণ করতে থাকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিষয়টি। বঙ্গবন্ধুর এই মুক্তির খুঁটিনাটি বিষয় বিশ্ব গণমাধ্যমে তাৎক্ষণিক প্রচারিত হতে থাকে। ৯ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ‘সানডে মেল, মালয় এশিয়া’ পত্রিকায় ‘মুজিব মুক্তি পেয়েছে শিরোনামে লেখা হয় ‘শেখ মুজিবুর রহমান ৮ জানুয়ারি খুব সকালে রাওয়ালপিন্ডি থেকে লন্ডন পৌঁছেন। বিশেষ বিমান ‘পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজ ৬৩৫-এ তিনি লন্ডন পৌঁছান। তিনি বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে ব্রিটিশ বিদেশ সম্পর্কীয় এবং কমনওয়েলথ অফিসের তিন সিনিয়র মুখপাত্র’র সাথে দেখা করেন। মুখপাত্র জানান, শেখ তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুই বলবেন না। তাঁর বাংলাদেশ সমর্থকরা তাঁকে সদ্যোজাত দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে।
এক বছর আগে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর পার্টির বিপুল বিজয়ের পর পূর্ব খণ্ডে সংকট শুরু হয়েছিল এবং সেই ঘটনার চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে এই নতুন দেশটির জন্ম হয়েছে। শেখ মুজিব পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে গত মার্চ মাসের শেষের দিকে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যা শুরুর পূর্বাহ্নে গ্রেফতার হয়েছিলেন। অবশ্য বিমানটি লন্ডন বিমানবন্দরে অবতরণের পূর্ব পর্যন্ত ঢাকা বা দিল্লি কেউ জানত না শেখ মুজিব কোথায়? শেখের রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগের এক ঘণ্টা পরে যে ঘোষণা দেয়া হয় তাতে তার গন্তব্যস্থলের কোনো উল্লেখ ছিল না।
রেডিও পাকিস্তান জানায়, শেখ একটি বিশেষ বিমানে পশ্চিম পাকিস্তান সময় বেলা ৩টায় (মালয় এশিয়া সময় ৫.৩০ মি.) রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগ করেছেন। রেডিও পাকিস্তান জানায়, শেখ মুজিবের ইচ্ছানুযায়ী তিনি কোথায় যাচ্ছেন, এ সম্পর্কে কিছুই জানানো হবে না। ঘোষক আরো জানান, শেখ তাঁর গন্তব্যে পৌঁছানোর পর নিজেই ঘোষণা দেবেন। এদিকে রয়টার ঢাকাস্থ রেডক্রস মুখপত্র ও বিদেশি সংবাদদাতাদের টেলিফোন করেছিল, সেখানে শেখ মুজিবের গন্তব্য সম্পর্কে কোনো খবর পৌঁছায়নি। এমনকি কোনো গুজবও পূর্ব পাকিস্তানে পৌঁছায়নি। রেডিও পাকিস্তান জানায়, মি. ভুট্টো শেখ মুজিবকে রাওয়ালপিন্ডিতে বিদায় সংবর্ধনা জানান।
ইতোমধ্যে আজ (৮ জানুয়ারি) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে জানিয়ে দিয়েছেন, মি. ভুট্টো যদি তার পাকিস্তানকে রক্ষা করতে চান বা উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হন তাহলে যেন অবিলম্বে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেন। মি. আহমদ আজ ঢাকায় আওয়ামী লীগের এক কর্মিসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, আমরা আমাদের প্রিয় নেতাকে মুক্ত করার জন্য যে কোনো ধরনের ত্যাগ স্বীকারে যেতে প্রস্তুত। যদি ভুট্টো তার পাকিস্তানকে রক্ষা করতে চান, তাহলে তিনি যেন অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুকে (বাঙালির বন্ধু, একটি আবেগ মথিত নাম, এই নামে শেখ পরিচিত) তার জনগণের মাঝে ফিরে আসার ব্যবস্থা করেন।
এছাড়া মি. আহমদ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকার জন্য তীব্র ভাষায় নিন্দা করেন। তিনি অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন যে তার দেশকে দ্বিতীয় ভিয়েতনামে পরিণত হবার হাত থেকে রক্ষা করেছেন এজন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, যখন তার দেশের হাজার হাজার লোককে হত্যা করা হচ্ছিল সেসময় যুক্তরাষ্ট্র বা চীন কেউই তাদের মিত্র পাকিস্তানকে বাধা দেয়নি এবং তারা আরো হত্যার রসদ জুগিয়েছে। তিনি জানান, সোভিয়েত ইউনিয়নের হুঁশিয়ারির কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশে প্রবেশ বন্ধ করে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিতর দিয়ে সৃষ্ট ভারত-বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী আরো দৃঢ় হবে।
৫১ বছর বয়স্ক শেখ মুজিবকে নয় মাস আগে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে নেয়া হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল দেশদ্রোহিতার অপরাধে তার বিচার হবে। তিনি গত ডিসেম্বরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়কালেও পাকিস্তানের জেলখানায় ছিলেন। যুদ্ধের শেষে ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ ও বাংলাদেশের জন্মের পর ভুট্টো ক্ষমতায় আসেন এবং এ সময়ে শেখ মুজিবকে জেলখানা থেকে গৃহে অন্তরীণ করা হয়। গত ২২ ডিসেম্বর তাঁকে জেলখানা থেকে নিয়ে আসা হয়।’
৮ জানুয়ারি ১৯৭২ রয়টার ‘লন্ডনে শেখ মুজিব’, ৯ জানুয়ারি লন্ডনের ‘সানডে টাইমস’ ‘শেখ মুজিবের সাথে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ’, ১০ জানুয়ারি ‘জাম্বিয়া ডেইলি মেইল ‘শেখ মুজিব দিল্লির পথে’, ১০ জানুয়ারি ইউএনআই ‘নয়াদিল্লির জনসভায় শেখ মুজিবের ভাষণ’, ১০ জানুয়ারি নেপালের ‘রাইজিং নেপাল, কাঠমন্ডু’ পত্রিকায় ‘পরিবর্তনের সূচনাঃ শেখ মুজিবের মুক্তি’ শিরোনামে সম্পাদকীয়, এদিনই ‘আল আয়আম খার্তুম’ পত্রিকায় ‘জিন্দাবাদ শেখ মুজিব’ শিরোনামে সম্পাদকীয়, ১০ জানুয়ারি ‘দি অ্যাডভোকেট ব্রুনাই, তাজমেনিয়া, অস্ট্রেলিয়া’ পত্রিকায় ‘শেখের দায়িত্ব’ শিরোনামে সম্পাদকীয়, ১০ জানুয়ারি নেপালের ‘নিউ হেরাল্ড, কাঠমন্ডু’ পত্রিকায় ‘চিরন্তন সত্য’ শিরোনামে সম্পাদকীয়, ১১ জানুয়ারি নয়াদিল্লি’র ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ‘দিল্লিতে শেখ মুজিবের স্মরণীয় সম্বর্ধনা’, শিরোনামে বঙ্গবন্ধুর প্রতি মুহূর্তের সংবাদ পরিবেশন করেছে।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তন : অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল। রক্তের আখরে বিজয়ী বাঙালির বিজয়ের পরিপূর্ণতার দিন। যুগ যুগান্তরের পরাধীনতার অবসানের পরিপূর্ণতার দিন। স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ফিরলেন তাঁর স্বদেশে। বিজয়ী দেশে বিজয়ী মহানায়কের স্মরণীয় প্রত্যাবর্তন। এই দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাঙালি জাতিরও অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার দিন। দু’শ চব্বিশ বছরের পরাধীনতার অন্ধকারের নাগপাশ থেকে আলোয় ফেরার দিন। বঙ্গবন্ধু ডেভিড ফ্রস্টকে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তাঁর এই প্রত্যাবর্তন ছিল অন্ধকার থেকে আলোয় প্রত্যাবর্তন। বঙ্গবন্ধুর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল রূপকথার নায়কের প্রত্যাবর্তন। সমগ্র জাতি সেদিন উপচে পড়েছিল খুশিতে। জনগণের চোখে ছিল আনন্দের অশ্রু। দেশে ফিরে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনগণের আনন্দের অশ্রুর সঙ্গে মিশে গিয়েছিল তাঁরও চোখের অশ্রু। বক্তব্য রাখতে গিয়ে সমগ্র জাতিকে নিয়ে কেঁদেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনও সারাবিশ্বের মিডিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ধারণ করেছে। সারাবিশ্বে বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করেছে সেদিনের সবচেয়ে আলোকিত বিষয়টিকে। সকল গণমাধ্যমেরই উল্লেখযোগ্য সংবাদ ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।
১১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বিখ্যাত নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা শিরোনাম করে ‘শেখ মুজিব নিজদেশেঃ পাঁচলাখ লোকের উচ্ছ্বসিত সম্বর্ধনা’, এছাড়া ‘মুজিব ভারতের সাথে চিরস্থায়ী বন্ধুত্বের কথা বললেন’ শিরোনামেও নিউইয়র্ক টাইমস আরেকটি স্টোরি প্রকাশ করে। এদিনই লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ শিরোনাম করে ‘মুজিব পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলেন’ শিরোনামে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ করেন। সারাবিশ্বের গণমাধ্যম বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সচিত্র বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ করে।
১১ জানুয়ারি নয়াদিল্লির বিখ্যাত পত্রিকা ‘স্টেটসম্যান’ ‘ঢাকা এখন উল্লসিতঃ লাখ লাখ লোক মহান মুজিবকে স্বাগত জানায়’ শিরোনামে লেখে ‘ঢাকা, ১০ জানুয়ারি, শেখ মুজিবুর রহমান আজ তার জনগণের কাছে ফিরে এলেন। নয় মাস কারাভোগের পর শেখ মুজিবের এই স্মরণীয় প্রত্যাবর্তন। লাখ লাখ লোক তাকে স্বাগত জানা জন্য বর্ণনাতীত উল্লাসে ফেটে পড়ে। জনগণ বস্তুত ছিল উল্লাসে দিশেহারা; তারা কেউ নাচছিল, কেউ বা চিৎকার করে জয়ধ্বনি দিতেছিল। রয়েল এয়ারফোর্স জেটটি মাটি ছোঁয়ামাত্রই বিশাল জনতা এগিয়ে আসে এবং প্রায় বিমানটির দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। খুব কষ্টে এই জনতাকে ঠেকিয়ে রেখে তাকে তিন বাহিনী গার্ড অব অনার প্রদর্শন করে এবং তার সাথে কূটনৈতিকদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়।
বিমানবন্দরে বিশাল জনতার সামনে উচ্চ মঞ্চে শেখকে কিছুটা ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। উল্লেখ্য এই সেই বিমান বন্দর, দশমাস পূর্বে যেখানে তাকে গভীর রাতে বন্দি হিসেবে নিয়ে আসা হয়েছিল আর আজ সেখানে তার বিমান নামল সূর্যালোকে এবং তাকে বরণ করা হলো বিজয়ী বীরের সম্বর্ধনায়। তোপগুলো তার সামনে গর্জন করে উঠল ৩১ বার। তাঁকে স্বাগত জানাতে প্রথমে এগিয়ে আসেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এরপর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য ক্যাবিনেট মন্ত্রীরা। অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন, কেবলমাত্র ইরান এবং চীনের কোনো প্রতিনিধি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্সিলর জেনারেল উপস্থিত ছিলেন।
জনতার স্রোতের ভিতর দিয়ে শেখ মুজিবের মোটর শোভাযাত্রা বিমানবন্দর থেকে রমনা রেসকোর্স পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে পুরো দুই ঘণ্টা সময় নেয়। রমনা রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় শেখ মুজিব ভুট্টোর কনফেডারেশন স্বপ্নের প্রত্যুত্তরে বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং এর একটি মানুষ বেঁচে থাকতেও এ স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবে না। প্রিয় নেতাকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেবার জন্য সমস্ত ঢাকা শহরের মানুষ এসে জড়ো হয়েছিল রমনা রেসকোর্স থেকে তেজগাঁও বিমানবন্দরের এই চার মাইলের ভেতর। এছাড়া পার্শ্ববর্তী জেলা ফরিদপুর, বরিশাল, কুমিল্লা থেকেও হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছিল।
খুব সকাল থেকেই ঢাকাকে মনে হচ্ছিল একটি উৎসবের নগরী। অসংখ্য মিছিল রেসকোর্স ও তেজগাঁও বিমানবন্দরের ভিতর ছোটাছুটি করছিল। সমস্ত রাস্তা ছিল মানুষে পরিপূর্ণ। প্রায় প্রতিটি মানুষের মুখে ছিল ‘জয়বাংলা’ স্লোগান। অধিকাংশের হাতে ছিল বাংলাদেশের পতাকা এবং শেখ মুজিবের ছবি। বিমানবন্দর ছিল মুক্তিবাহিনীর কড়া নিয়ন্ত্রণে। মুক্তিবাহিনীরা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণে শেখ মুজিবের মোটর শোভাযাত্রার পথ তৈরি করে। শেখ মুজিবের গতিপথের দুধারের সমস্ত বলকানি ও ছাদ ছিল মানুষে পরিপূর্ণ। তাদেরও মুখে ছিল উল্লাসিত স্লোগান। জনতার স্লোগান ছিল ‘জাতির পিতা দীর্ঘজীবী হোক’ ‘মুজিব ভাই দীর্ঘজীবী হোক।’ কিন্তু কিছু কিছু মিছিল স্লোগান দিচ্ছিল, ‘সপ্তম নৌবহর জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও’ ‘আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক নিপাত যাক’ এবং বাংলাদেশ-ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী দীর্ঘজীবী হোক।’
৫৩ বছর বয়স্ক বাঙালি নেতা জনসভায় পাকিস্তানিদের গণহত্যার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বার বার চোখের জল সামলাচ্ছিলেন। বিশাল জনতাকে উদ্দেশ্য করে শেখ মুজিব বলেন, লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার পূর্বে ভুট্টো সাহেব আমাকে বলেছিলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে কোনরূপ কনফেডারেশান রাখা সম্ভব কিনা, আমি বলেছিলাম, আমি আমার জনগণের সাথে আলাপ না করে কিছুই বলতে পারিনে। ভুট্টো সাহেব অপনার উদ্দেশ্যে আমি এখন বলতে চাই আপনার (পশ্চিম পাকিস্তান) সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ ছিল তার আজন্ম সাধনা আজ সে সাধনা পূর্ণ হয়েছে। কবি গুরুর কথা আজ মিথ্যে হয়েছে, আজ বাঙালি মানুষ হয়েছে আজ আমার কোন দুঃখ নেই। তিনি পৃথিবীর সমস্ত জাতির কাছে তার গৃহহীন, দুঃখী মানুষের জন্য ও বাংলাদেশকে পূর্নগঠনের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেন।
রমনা রেসকোর্সের জনসভায় শেখ মুজিব ১শ ফিট লম্বা নৌকাকৃতি মঞ্চ থেকে ভাষণ দেন। উল্লেখ্য নৌকা আওয়ামী লীগের নির্বাচন প্রতীক। শেখ মুজিব মঞ্চে আরোহণের সাথে সাথে সমস্ত জনসভা শ্লোগানে মুখর হয়ে উঠে। কেউ কেউ নেতার প্রতি পুষ্প বর্ষণ করতে থাকে। কেউ বা নেতার মুক্তির আনন্দে আকাশে পায়রা উড়াতে থাকে। সর্বত্রই হাসিখুশি মুখ। কারো মনে কোন দুঃখের চিহ্ন নেই। আজ তাদের দেখলে বোঝাই যায় না তারা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্যোগময় নয়মাসের গণহত্যার পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। বরং আজ তারা তাদের নেতাকে ফিরে পেয়ে যেন সুন্দর ভবিষ্যতের ব্যাপারে নিশ্চিত।
জনতার করতালির ভিতর শেখ মুজিব ৩৫ মিনিট ভাষণ দেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানান। ধন্যবাদ জানান সোভিয়েত ইউনিয়নকে। তিনি আমেরিকা ও অন্যান্য দেশের জনগণ যারা তাঁর মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন করেছিলেন, সবাইকে শুভেচ্ছা জানান। শেখ মুজিব তার এককোটি গৃহহীন মানুষকে খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে প্রতিপালন করার জন্য ভারতকে ধন্যবাদ জানান।
শেখ মুজিব কর্মীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, যদি আমরা আমাদের জনগণের মৌলিক অন্ন, বস্ত্র ও কাজের সংস্থান করতে না পারি তাহলে আমাদের এই কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে প্রশংসা করে বলেন, তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে আমাদের দ্রুত মুক্তিতে সাহায্য করেছে। শেখ আরো বলেন তার প্রহসনমূলক বিচারে কিছু বাঙালিকে সাক্ষী দেবার জন্য নেয়া হয়েছিল তিনি বিশ্বাস করেন, তাদেরকে জোরপূর্বক নেয়া হয়েছিল। বক্তব্য শেষে শেখ জনসভার উপস্থিত শহীদদের স্মরণে প্রার্থনা করতে আহ্বান জানান এবং তার সাথে সাথে স্লোগান ধরতে বলেন, জয়বাংলা ও ভারত বাংলাদেশ ভাই ভাই। উপস্থিত জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার এই আহ্বানে সাড়া দেন।’
১১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ‘দি মারকুরি, হাবার্ট, তাজমানিয়া, অস্ট্রেলিয়া’ পত্রিকায় শেখ মুজিবের প্রত্যাবর্তন শিরেনামে লেখে ‘উত্তাল জনতা শেখ মুজিবকে ঢাকায় আবেগঘন সংর্বধনা জানিয়েছে। শেখ মুজিবকে তার জনগণ যে ধরনের সংবর্ধনা জানিয়েছে, উপমহাদেশে এ ধরনের সংবর্ধনা ইতোপূর্বে দেখা যায়নি। শেখ মুজিবের জনগণের ভালোবাসার উচ্ছ্বাস উপমহাদেশ থেকে যেদিন ব্রিটিশ চলে গিয়েছিল সেদিনের ইতিহাসকে সবদিক থেকে ম্লান করে দিয়েছে। অবশ্য একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য তার নেতাকে যতদূর ত্যাগ স্বীকার করতে হয় শেখ মুজিব তার চেয়ে অনেক বেশি পথ অতিক্রম করে এলেন।
বাংলাদেশে পশ্চিমাদের অবহেলার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সব সময়ের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার এই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খুব সামান্যই করেছে এবং এই শোষণের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য শেষ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাদের রক্তাক্ত অপারেশন শুরু করেছিল। এখন স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। এ মুহূর্তে তাদের সমস্যা কীভাবে তারা পরিচালিত হবে। অবশ্য এটা পুরোপুরি নির্ভর করে শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর, তিনি কীভাবে তার জাতিকে পরিচালিত করবেন। কীভাবে বিভেদ সৃষ্টিকারীদের দমন করবেন এবং কি ধরনের আইন ও প্রশাসন তিনি গড়ে তুলবেন।
’৭০-এর নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছিল শেখ মুজিব তার দেশে বর্ণনাতীত জনপ্রিয়। তার প্রত্যাবর্তনের দিনও প্রমাণিত হলো যে জনপ্রিয়তায় এখনো ভাটা পড়েনি। তবে বাস্তব পরীক্ষা শুরুর সময় এখন। বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনের গতি ধীরই হয়ে থাকে এ সময়েই তার জনপ্রিয়তা বাস্তবের মুখোমুখি হবে। এই নতুন সদ্যোজাত স্বাধীন দেশটির পুনর্গঠনের জন্য এ মুহূর্তে প্রয়োজন কার্যকরী বিদেশি সাহায্য। অবশ্য এ লক্ষ্যে প্রয়োজন সরকারীভাবে স্বীকৃতি প্রদান। ইতোমধ্যে শেখ মুজিব ব্রিটেনের স্বীকৃতি আদায়ের পথ অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। আশা করা যায় অস্ট্রেলিয়া শিগগিরই অনুরূপ সিদ্ধান্তে যাবে।
অবশ্য শেখ মুজিবও তার সরকারকে ইতোমধ্যে প্রমাণ করতে হবে যে তার দেশ ও জনগণ তারই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এটা প্রমাণিত হলে নিশ্চয়ই অস্ট্রেলিয়া স্বীকৃতির ব্যাপারে তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেবে। বৃহৎ শক্তি কোনদিকে যায় এটা অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার ব্যাপার নয়।’ ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ‘দি ওয়েস্ট অস্ট্রেলিয়ান, পার্থ’ পত্রিকায় ‘শেখ মুজিবের দায়িত্ব গ্রহণ’ শিরোনামে সম্পাদকীয়তে লেখে ‘লাখো বাঙালির আবেগমথিত সংবর্ধনার ভিতর দিয়ে শেখ মুজিব ঢাকায় প্রবেশ করলেন। আর এর সাথে সাথেই তিনি প্রবেশ করলেন নতুন জাতিকে গড়ে তোলার এক বিশাল কর্মরাজ্যে। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। শেখের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে এসেছে। এখন চোখের সামনে একমাত্র যুদ্ধ তার স্বপ্নের জাতিকে বাস্তবে রূপ দেবার।
পৃথিবীর কোন জাতির নেতাকে বস্তুত এমন দুর্গম পথ পেরিয়ে এবং এমনি নাটকীয়ভাবে ক্ষমতার মঞ্চে আরোহণ করতে হয়নি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্যে বাংলাদেশ পাকিস্তানের শৃঙ্খল ভেঙেছে ঠিকই কিন্তু এ পথে গত নয়মাস তাদের ওপর চলেছে এক রক্তক্ষয়ী ও বর্বর পাশব অত্যাচার। এককোটির উপর সর্বস্ব হারানো লোক এখন এই নতুন রাষ্ট্রকে পূনর্বাসন করতে হবে। তার উপর অধিক জনসংখ্যা বহুল এই দেশটি পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশের একটি।
বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ লুণ্ঠিত, প্রশাসন বিধ্বস্ত, সর্বোপরি যুদ্ধের ভয়াবহতায় জনগণ হতাশ। এমত মুহূর্তে এই নতুন জাতিকে একতাবদ্ধ করে গড়ে তোলার মত রাজনৈতিক ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা একমাত্র শেখ মুজিবেরই আছে।’
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা, বিজয়ের পূর্ণতা লাভ করেছিল। শুরু হয়েছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রার। বাংলাদেশ প্রবেশ করেছিল অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত-এর মধ্য দিয়ে আবারো চেষ্টা চালানো হয়েছিল অন্ধকারের দিকে টেনে নেয়ার। কিন্তু সকল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ তার গৌরবোজ্জ্বল বিজয় সমহিমায় ধরে রেখেছে। প্রতি বছর ১০ জানুয়ারি আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় অন্ধকার থেকে আলোয় প্রত্যাবর্তনের ইতিহাসকে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: একাত্তরে বিশ্বে বঙ্গবন্ধু সম্পাদনা ও অনুবাদ স্বদেশ রায়
লেখক : গবেষক।