দুয়ারে কড়া নাড়ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। ভাষার মাসে বাঙালির প্রাণের উৎসবও এটি। এই মেলা নিয়ে লেখক-পাঠকের সঙ্গে প্রকাশকেরও আগ্রহের কমতি নেই। সারাবছর এই মেলার অপেক্ষাতেই থাকেন তারা। আমাদের বইমেলা এখন সাংস্কৃতিক মেলা, আলোর মেলা ও জাতিসত্ত্বা প্রকাশের মেলা হয়ে উঠেছে। একইসঙ্গে অনেক মানুষের মিলনমেলাও এটি। মেলায় আগত শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবাই স্টল ঘুরে ঘুরে খোঁজেন প্রিয় লেখকের বই। নতুন বই হাতে নিয়ে ভেজা মলাটের ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে বাড়ি ফেরেন বইপাগল মানুষ। এটাই তো বইমেলার পরিচিত দৃশ্য। ১৯৭২ সালে মুক্তধারার প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের সামনে চট বিছিয়ে কয়েকটি বই নিয়ে বসেছিলেন। পরের বছরগুলোতে তার সঙ্গে যোগ দেন আরো কয়েকজন প্রকাশক। ১৯৮৪ সালে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় এই মেলা। তখন থেকেই বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে আয়োজিত হয়ে আসছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা।
বইমেলাকে কেন্দ্র্র করে এরই মধ্যে রাজধানীর বইবাজার খ্যাত বাংলাবাজার ও আরামবাগে চলছে কর্মযজ্ঞ। দম ফেলার সময় নেই শ্রমিকদের। দিন-রাত কাজ করে বইকে পাঠকের দ্বারে পৌঁছে দিতে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। পাঠক-লেখক প্রকাশকদের বইমেলাকে কেন্দ্র করে শেষ সময়ে ছাপাখানাগুলোতে কাজের চাপ প্রচুর। প্রাায় ২৪ ঘণ্টাই প্রেস চালু রেখেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বই ছাপার কাজ চলছে। তাই নতুন কাজের ফরমায়েশ বাতিল করে দিচ্ছেন প্রেস মালিকেরা। এ ছাড়া বইমেলার তারিখ যত এগুচ্ছে, কাজের চাপ ততই বাড়ছে। রাজধানীর বাংলাবাজার, সূত্রাপুর, পুরানা পল্টন, নয়াপল্টন, ফকিরাপুল, নীলক্ষেত, আরামবাগ ও কাঁটাবনের বিভিন্ন ছাপাখানা ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
ছাপাখানার কর্মীরা জানান, ব্যস্ততা বেড়েছে জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে। যা ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে চলবে। পুরান ঢাকার প্যারীদাস রোডের সরু গলিতে হাঁটতেই দেখা গেল, ভ্যানে করে কাগজের স্তূপ টানা হচ্ছে। সেখানে শোনা গেল, ছাপাখানার খটখট শব্দ। ছাপাখানাগুলোর ভেতরে গাদা গাদা কাগজ। একটি ছাপাখানায় ঢুকতেই রঙের ঝাঁজালো গন্ধ নাকে এসে লাগল। ছাপার যন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসছে সদ্য ছাপা হওয়া কাগজের বড় শিট। এরপর এগুলোকে বাঁধাইখানায় নেয়া হচ্ছে। কেটে বাঁধাইয়ের পর নতুন বইগুলো প্রকাশনগুলোর দোকান ও গুদামে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। সূত্রাপুরের গোপাল শাহ লেনের একুশে প্রিন্টার্স। প্রতিষ্ঠানটি এবারের বইমেলা উপলক্ষে পার্ল পাবলিকেশন, তাম্রলপি, অনুপম, দিব্য প্রকাশসহ ১৫টির বেশি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ছাপার কাজ করছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, তিনটি বাই কালার ছাপার যন্ত্রে ১৮ জন শ্রমিক কাজ করছেন।
একুশে প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী পারভেজ আহমেদ বলেন, ‘প্রতিদিনই বই ছাপার নতুন অর্ডার আসছে। কাজের চাপ এত বেশি যে নভেম্বর থেকে দুই পালায় ২৪ ঘণ্টা প্রেস চালু রেখেছি। শ্রমিকেরা পালাবদল করে কাজ করছেন।’
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি বলছে, বাংলাবাজার, সূত্রাপুর, গোপীবাগ, ফকিরাপুল, পুরানা পল্টন, নয়াপল্টন, আরামবাগ, নীলক্ষেত ও কাঁটাবনে বইমেলার কাজ চলছে। এ এলাকাগুলোতে প্রেসের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৭০০। প্রকাশক ব্যবসায়ীরা অক্টোবর-নভেম্বর থেকেই বই ছাপা শুরু করেন।
বাংলাবাজারের মদীনা বাঁধাই ঘরের কর্মী শাহজাহান হোসেন বলেন, ‘আমাদের বাঁধাই ঘরে সারা বছর পাঁচজন শ্রমিক কাজ করে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই সময়টাতে দ্বিগুণ কাজ হয়ে থাকে। এর ফলে অতিরিক্ত লোক নিয়োগ করতে হয়। এবারো এর ব্যতিক্রম হয়নি।’
কালি-কলম প্রকাশনীর প্রকাশক মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘প্রকাশনার সংখ্যার চেয়ে মনের দিকেই প্রকাশকদের এবার বেশি নজর। কাগজের মূল্য বৃদ্ধিটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে পারলে বইয়ের দামও কমে আসবে। পাঠকদের জন্য ভালো বই কিনতে সহায়ক হবে।’
সাহস পাবলিকেশন নাজমুল হুদা রতন বলেন, ‘বইমেলা উপলক্ষে আমাদের সব কাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। আশা করছি, মেলার প্রথম দিন থেকেই সব বই স্টলে থাকবে।’
সময় প্রকাশনীর ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘অধিকাংশ না হলেও অন্তত অর্ধেক বই প্রেস থেকে বাঁধাইখানায় চলে এসেছে। বাঁধাই চলছে আর কিছু বই ছাপা চলছে, কিছু বই এখনো ডিজাইনের কাজ চলছে। এটা আসলে চলতেই থাকবে, ফেব্রুয়ারির কাজের শেষ নেই।’
কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন যে, বইমেলার পরিসর বেড়েছে, কিন্তু কমেছে আন্তরিকতা। কর্পোরেট সংস্কৃতির একটা অশুভ বাণিজ্যিকীকরণের ছায়া পরোক্ষভাবে হলেও লক্ষ করা যায় বইমেলা আয়োজনে। এ ছাড়া ই-বুক, ব্লগ ছাপা বইয়ের চাহিদার ওপর প্রভাব ফেলছে। বই ঘরের স্বত্বাধিকারী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘কাগজের বই পড়ার যে আনন্দ তা অন্য কোনো মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব নয়। এটিই আসল সত্য কথা।’
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ২০১৮ সালের তুলনায় এবার মেলার পরিসর বাড়ছে বলে সংবাদ এসেছে বিভিন্ন মাধ্যমে। এর অর্থ হচ্ছে, মেলায় অংশহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বাড়ছে। আনন্দের সংবাদ নিশ্চয়ই। বাংলা একাডেমির নতুন মহাপরিচালক হাবিুল্লাহ সিরাজী বলেন, ‘এবারের বইমেলাকে কেন্দ্র করে বাইরের সৌন্দর্যের দিকেও দৃষ্টি আছে। মেলায় প্রথমবারের মতো লেখক মঞ্চ নামে ৫ জন লেখক তার বই নিয়ে কথা বলতে পারবেন। মেলায় অংশ নিচ্ছে ৪৫০টি প্রকাশনী সংস্থা এবং নতুন ১৯টি প্রকাশনা সংস্থাকেও মেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।’
মেলা নিয়ে কেউ মন্তব্য করেছেন যে, বইমেলার পরিসর বেড়েছে, কিন্তু কমেছে আন্তরিকতা। কর্পোরেট সংস্কৃতির একটা অশুভ বাণিজ্যিকীকরণের ছায়া পরোক্ষভাবে হলেও লক্ষ করা যায় বইমেলা আয়োজনে। এ ছাড়া ই-বুক, ছাপা বইয়ের চাহিদার ওপর প্রভাব ফেলছে। বই ঘরের স্বত্বাধিকারী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘কাগজের বই পড়ার যে আনন্দ তা অন্য কোনো মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব নয়। এটিই আসল সত্য কথা।’
বইমেলার নিরাপত্তায় র্যাব-পুলিশের কড়া নজরদারির পাশাপাশি পুরো এলাকা আনা হচ্ছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার আওতায়। প্রকাশকরা বলছেন, কোনো চক্রান্তই বইমেলা আয়োজনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। এবারের বইমেলায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রদানের পরিকল্পনা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। র্যাব-পুলিশ-ডিবির সমন্বয়ে এবারের মেলায় শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। মাঠে থাকবে আনসার, ভিডিপি, ফায়ার সার্ভিস ও সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, বইমেলার ভেতরে ও বাইরে সাদা পোশাকে ও ইউনিফর্মে পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ থাকবে। ইভটিজিং ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা প্রতিরোধে থাকবে পুলিশের ফুট ও মোটরসাইকেল পেট্রলিং। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য থাকবে ওয়াচ টাওয়ার, ফায়ার টেন্ডার ও প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা। এবারো বইমেলার আশপাশ হকারমুক্ত করবে ডিএমপি। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মেলায় প্রবেশ ও বাইরের জন্য থাকবে আলাদা গেট। প্রত্যেক দর্শনার্থীকে আর্চওয়ে ও মেটাল ডিটেক্টরে তল্লাশির মাধ্যমে মেলায় প্রবেশ করতে দেয়া হবে। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় শিশুদের জন্য থাকছে বিশেষ আর্কষণ। যেখানে বই দেখা ও কেনার পাশাপাশি মনের আনন্দে খেলতেও পারবে শিশুরা। মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশে হচ্ছে এই শিশু কর্নার।