রাজধানীর চারপাশ দিয়ে ঐতিহাসিকভাবে বয়ে যাওয়া নদীগুলোই যেন ঢাকার লাইফ লাইন। তাছাড়া ঢাকার জনপদকে সুরক্ষিত নাগরিক সভ্যতা গড়ে ওঠার মূলেও এসব নদীর প্রবাহই প্রধান ভূমিকা রেখেছে। অথচ মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে ঢাকার চারপাশের নদীগুলো সব উপযোগিতাই হারিয়ে ফেলেছে। জলাবদ্ধতা দূরীকরণে থাকা রাজধানীর চারপাশের নদীগুলো এখন যেন জনসাধারণের কাজে আসছে না। দিন দিনই যেন জলাবদ্ধতার ভোগান্তী আরো বাড়ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নে এসব নদীর পানি স্বাভাবিক গুণাগুণ হারিয়ে ফেলেছে। সেই সঙ্গে অবাধে চলেছে নদী ভরাট, অপদখল এবং নদী বিনাশী নানান তৎপরতা। যেন নদী দখল ও দূষণের প্রতিযোগিতা চলছে। প্রকৃতির দান রাজধানীর চারপাশে প্রবাহিত এসব নদী দখলমুক্ত করতে পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে জানিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। অপরদিকে, ভরাট হওয়া জায়গা পুনরায় খনন করে নদীর অবয়ব ফিরিয়ে আনার দাবি পরিবেশবাদীদের।
জানা গেছে, দখলের কবলে অস্তিত্ব হারাচ্ছে বুড়িগঙ্গাসহ রাজধানীর আশপাশের নদীগুলো। এসব নদীর দুই পাড় ঘেঁষে বিভিন্ন জায়গায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবনসহ নানা স্থাপনা। নিয়ম অনুযায়ী নদী তীরের ৫০ থেকে ১০০ ফুটের মধ্যে কোনো স্থাপনা থাকতে পারবে না। তবে এ এলাকায় নদীর পাড় বলতে কিছু নেই, এমনকি কোথাও কোথাও নদীর মধ্যেই গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন।
বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, ‘নদীর সীমানা নির্ধারণী পিলার থেকে ১৫০ ফুট রেখে স্থায়ী বা অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে। কেউ যদি এ আদেশ অমান্য করে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করে তবে তা নিয়ম বহির্ভূত। তাছাড়া তুরাগ নদের পাড়ে কোনো ধরনের শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমতি দেয়নি কর্তৃপক্ষ। তিনি বলেন, ‘বিআইডব্লিউটিএর লোকবল কম থাকায় আমরা তাৎক্ষণিক অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারি না।’
অভিযোগ রয়েছে, একটু একটু করে দখলে নিয়ে নদীতীরে পাকা স্থাপনা নির্মাণ করেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরাই। নদী দখলমুক্ত করতে ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি এলাকাবাসীরও।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমির হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘ঢাকার চারপাশের নদ-নদীগুলো দখল দূষণে অবস্থা খুবই ভয়াবহ। বিভিন্ন শিল্প-কারখানা গড়ে তুলে এটিকে এমনভাবে দখল করা হয়েছে, যা পরিণত হয়েছে সরু খালে।’ অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘নদীর সীমানা নির্ধারণেও যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে না। বেশ কিছু স্থানে নদীর পাড় থেকেও ৭ থেকে ১০ মিটার ভেতরে সীমানা পিলার নির্ধারণ করেছে স্থানীয় জেলা প্রশাসন, যা বে-আইনি।’
বিআইডব্লিউটিএ বলছে, রাজধানীর চারপাশ ঘিরে বহমান নদীগুলোকে বাঁচাতে ভূমি রের্কড ও জরিপ অনুযায়ী নদীতীরে গড়ে ওঠা সব স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। বিআইডব্লিউটিএর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা। তবে উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে দখল হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। এজন্য তদারকি জরুরি বলে মনে করেন তারা।
অপর এক সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শেষে আগামী বছরের মধ্যে বুড়িগঙ্গা নদী ঘিরে গড়ে উঠবে নান্দনিক স্থাপনা। এরই মধ্যে ১১টি জায়গায় বেশ কয়েকটি প্রকল্পের অনুমোদনও দেয়া হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক আরিফ উদ্দিন বলেন, ‘নদীর দুই তীরের অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে সবই ভাঙা হবে। এসব স্থাপনার মধ্যে রয়েছে অনেক বহুতল ভবন। নদীর জমি উদ্ধারের পর এবার স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সীমানা চিহ্নিত করে নদীর পাড়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করে দেব। ভেতরে গাছ লাগিয়ে দেব, যেন কেউ পুনরায় দখল করতে না পারে।’
উল্লেখ্য, রাজধানীর চারপাশের নদীর দখল দূষণ নিয়ে দৈনিক মানবকণ্ঠে গত বছর ১ অক্টোবর থেকে পাঁচ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।