যেভাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেল একুশ

বিশেষ প্রতিনিধি

ফাইল ছবি

পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে এত বড় আন্দোলন বাঙালি জাতি ছাড়া আর কোনো জাতি করেছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না।

দাবি ছিল বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার। সেই দাবি এগিয়ে নিতে গিয়ে এ দেশের দামাল ছেলেরা বাংলা ভাষাভাষির রাষ্ট্র বাংলাদেশ আদায় করে ছাড়লেন। বাংলা ভাষা তো বেঁচে রইলই পর্যায়ক্রমে ভাষা আন্দোলন একটি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নিল এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার গৌরব অর্জন করল।

universel cardiac hospital

আর তাই একুশ আমাদের অহংকার, একুশ আমাদের চেতনা। একুশ একদিকে যেমন মাতৃভাষার স্বীকৃতি আদায়ে জীবন দেয়ার শোক, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা অর্জনের গৌরব।

ফাইল ছবি

মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব দরবারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পৌঁছে দেয়ার পেছনেও বেশ কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছিল বাঙালিকে। দুজন প্রবাসী বাঙালিকে এর জন্য করতে হয়েছে অক্লান্ত পরিশ্রম। একুশে ফেব্রুয়ারির এই দিনে সেই গৌরবময় অধ্যায়টি তুলে ধরা হলো-

নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রথম উদ্যোগ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সাবেক ছাত্র কানাডার ভ্যাঙ্কুভারের প্রবাসী বাঙালি প্রয়াত রফিকুল ইসলাম (১৯৫৩-২০১৩)।

১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি জাতিসংঘের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারি কফি আনানকে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে রফিক ১৯৫২ সালে ভাষা শহীদদের অবদানের কথা উল্লেখ করে কফি আনানকে প্রস্তাব করেন ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে যেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

চিঠিটি কফি আনানের প্রধান তথ্য কর্মচারী হিসেবে কর্মরত হাসান ফেরদৌসের নজরে আসে। তিনি ১৯৯৮ সালের ২০ জানুয়ারি রফিকুলকে অনুরোধ করেন তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন।

তখন রফিকুল ইসলাম ও কানাডা প্রবাসী তার আরেক সহযোগী আবদুস সালাম ‘অ্যা গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভারাস অব দ্যা ওয়াল্ড’ নামে একটি সমিতি গঠন করে। সাতটি ভাষার ১০ জন সদস্য এ সংগঠনে যুক্ত হন। যাদের মধ্যে দুজন বাঙালি- রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম, দুজন ইংরেজ- জ্যাসন মোরিন ও সুসান হজিন্স, একজন জার্মান- রেনাটে মার্টিনস, দুজন ফিলিপিনো- অ্যালবার্ট ভিনজন ও কারমেন ক্রিন্টোবাল, একজন কুচি- নাজনীন ইসলাম, একজন ক্যান্ডোনিজ- ড. কেলভিন চাও এবং হিন্দিভাষী করুনাজোসি ছিলেন।

এ সমিতির পক্ষ থেকে বিভিন্ন দেশের সাতটি ভাষায় লিখিত এবং দশ ব্যক্তির স্বাক্ষর সংবলিত আবেদন ইউনেস্কোতে জমা দেয়া হয়।

আবেদনের প্রাথমিক জবাবে ইউনেস্কোর শিক্ষাবিষয়ক প্রকল্প বিশেষজ্ঞ আনা মারিয়া ওই সমিতিকে জানায়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুরোধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব নয়। তবে কোনো সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। এরপর রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ সরকারের সে সময়ের শিক্ষা সচিব কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণে সচিব শিক্ষামন্ত্রী এস কে সাদেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মন্ত্রী বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উত্থাপন করেন।

অন্যদিকে রফিকুল ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ করতে থাকেন। আনা মারিয়ার পক্ষ থেকে পাঁচটি দেশের নাম উল্লেখ করে ওই দেশগুলোকে ‘অ্যা গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভারাস অব দ্যা ওয়াল্ড’র প্রস্তাবটি ইউনেস্কোতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবের অনুরোধ করা হয়। পাঁচটি দেশ হচ্ছে- বাংলাদেশ, ভারত, কানাডা, ফিনল্যান্ড ও হাঙ্গেরি।

এরপর ইউনেস্কো অফিস থেকে বলা হয়- দেশগুলোকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ করার দাবির পক্ষে বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায় করতে হবে।

তখন বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী এম এ সাদেক এবং শিক্ষা সচিব কাজী রকিবুদ্দিন, অধ্যাপক কফিলউদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর সেক্রেটারিয়েটের তৎকালীন ডিরেক্টর মশিউর রহমান। ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোজাম্মেল আলি, কাউন্সিলর ইকতিয়ার চৌধুরী, ইউনেস্কোর সেক্রেটারি জেনেরালের শীর্ষ উপদেষ্টা তোজাম্মেল হকসহ অন্য অনেকে দিনরাত পরিশ্রম করে ২৯টি দেশকে প্রস্তাবের পক্ষে নিয়ে আসেন।

১৯৯৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। ইউনেস্কোর প্রস্তাব উত্থাপনের শেষ দিন। তখনো প্রস্তাব গিয়ে পৌঁছায়নি। ওদিকে রফিক সালামেরা ব্যাপারটি নিয়ে বিনিদ্র রজনী অতিক্রম করে চলেছেন। টেলিফোনের সামনে বসে আছেন, কখনো চোখ রাখছেন ইমেইলে। আসলে প্রস্তাবটির পেছনে প্রধানমন্ত্রীর একটি সই বাকি ছিল।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন সংসদে। সংসদ শেষে সেখান থেকে বেরিয়ে স্বাক্ষর করে প্রস্তাব ইউনেস্কোতে পাঠাতে পাঠাতে বেঁধে দেয়া সময়সীমা পেরিয়ে যাবে। তখন প্রস্তাবটিতে দ্রুত স্বাক্ষর দিতে টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করা হয়। তিনি তাতে সই করেন। অবশেষে সময় শেষ হওয়ার মাত্র এক ঘণ্টা আগে ফ্যাক্সবার্তা পৌঁছায় ইউনেস্কো অফিসে।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর, এক ঐতিহাসিক দিন। প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় ইউনেস্কোর ৩০তম সম্মেলনের সভার প্রথমেই। ১৮৮টি দেশ এতে সাথে সাথেই সমর্থন জানায়। কোন দেশই এর বিরোধিতা করেনি, এমনকি খোদ পাকিস্তানও নয়। সর্বসম্মতিক্রমে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গৃহীত হয় ইউনেস্কোর সভায়।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অন্যতম রূপকার রফিকুল ইসলাম আজ আমাদের মাঝে আর নেই। দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে ২০১৩ সালের ২০ নভেম্বর কানাডার ভ্যাঙ্কুভার হাসপাতালে তিনি পরলোক গমন করেন। তিনি স্ত্রী বুলি ইসলাম ও দুই ছেলে মাশফিকুল ইসলাম জ্যোতি আর তাশফিকুল ইসলাম জয়ন্তকে রেখে গেছেন। তারা ভ্যাঙ্কুভারেই থাকেন।

প্রয়াত রফিকুল এবং তার বন্ধু কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া ফেরি করপোরেশনের সাবেক চিফ ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সালাম দুজনকেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বৈশ্বিক স্বীকৃতি অর্জনে অবদান রাখায় স্বাধীনতা পদক দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে