সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার পরও কৃষিঋণ বিতরণে অনীহা দেখাচ্ছে।
চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ১২ হাজার ১০১ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো।
তবে এটি লক্ষ্যমাত্রার ৫৫ দশমিক ৫১ শতাংশ।
আগের অর্থবছরের একই সময়ে বিতরণ হয়েছিল ১২ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। সেটি ছিল লক্ষ্যমাত্রার ৬২ দশমিক ২৭ শতাংশ। কিছু ব্যাংকের বিতরণ পরিস্থিতি ভালো হলেও অর্থবছরের সাত মাস পেরিয়ে গেলেও লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক ঋণও বিতরণ করেনি ২৫ ব্যাংক।
এই খাতে বিতরণকৃত মোট ঋণের মধ্যে খেলাপির পরিমাণ চার হাজার ৯৯৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। যা মোট ঋণের ১২ দশমিক ৩৯ শতাংশ। একক ব্যাংক হিসাবে সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের পরিমাণ সোনালী ব্যাংকের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, তুলনামূলক সুদহার কম ও ঋণ আদায় ঝামেলাপূর্ণ হওয়ায় কৃষিঋণে বেশিরভাগ ব্যাংকের আগ্রহ কম। এ কারণে ২০১১ সাল বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের অন্তত ২ শতাংশ কৃষিতে বিতরণ বাধ্যতামূলক করা হয়। কোনো ব্যাংক নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হলে পরবর্তী এক বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অর্থ জমা রাখার বিধান রয়েছে।
চলতি অর্থবছর কৃষি খাতে ব্যাংকগুলোর জন্য মোট ২১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকসমূহ ৯ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা এবং বেসরকারি ও বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ ১১ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা বিতরণ করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে জুলাই-জানুয়ারি শেষে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত খাতের ব্যাংক ৫ হাজার ৮৭২ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৫৯.৪৬ শতাংশ।
এ সময়ে কৃষিতে অগ্রণী ব্যাংক ৬৩.৮২ শতাংশ, বেসিক ব্যাংক ৫৭ দশমিক ২৩ শতাংশ, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক- বিডিবিএল ১০৪.৯৩ শতাংশ, কৃষি ব্যাংক ৬৩.৯৭ শতাংশ, জনতা ব্যাংক ৭০.৭৬ শতাংশ, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ৭০.৬৩ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে। তবে রুপালী ব্যাংক মাত্র ৯.৯৯ শতাংশ এবং সোনালী ব্যাংক ৩১.৭২ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে।
প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংক আলোচ্য সময়ে ছয় হাজার ২২৯ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৫২.২৩ শতাংশ। গত অর্থবছরের আলোচ্য সময়ে বিতরণ করেছিল সাত হাজার ৪০২ কোটি টাকা বা ৬৮.৪৮ শতাংশ। এ সময়ে বিদেশি মালিকানার ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, উরি ব্যাংক এবং বেসরকারি মালিকানার মধুমতি ব্যাংক এক টাকাও বিতরণ করেনি।
লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক ঋণ বিতরণ করতে পারেনি এমন তালিকায় রয়েছে বিদেশি মালিকানার ব্যাংক আল-ফালাহ। এছাড়া বেসরকারি মালিকানার এবি ব্যাংক ২৭.০৫ শতাংশ, আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক ৪০.৬২ শতাংশ, ব্র্যাক ব্যাংক ৪৬.৮৪ শতাংশ, ঢাকা ব্যাংক ৪৪.২৫ শতাংশ, ডাচ-বাংলা ব্যাংক ২০.৯৬ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৩৮.৪৯ শতাংশ, মেঘনা ব্যাংক ৩৯.৪৪ শতাংশ, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৩২.৮৬ শতাংশ, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ১৯.৮৮ শতাংশ, এনসিসি ব্যাংক ২১.৪১ শতাংশ, এনআরবি কমাশিয়াল ব্যাংক ৪৪.৩৯ শতাংশ, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ১২.৭৭ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ৪২.৫০ শতাংশ, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ২১.৯৪ শতাংশ, সাউথ ইস্ট ব্যাংক ২৪.০৯ শতাংশ, দি সিটি ব্যাংক ৩১.৪০ শতাংশ, দি প্রিমিয়ার ব্যাংক ৪৬.৭১ শতাংশ, ইউনিয়ন ব্যাংক ৩০.৮০ শতাংশ এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ৪১.৫৩ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে।
প্রতিবেদন পর্যালোচনায় আরো দেখা যায়, কৃষকদের মাঝে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৪০ হাজার ৩০৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। বিতরণ করা মোট এ ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ চার হাজার ৯৯৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। যা মোট ঋণের ১২ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
একক ব্যাংক হিসাবে সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের পরিমাণ সোনালী ব্যাংকের। ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণও বেশি। ব্যাংকটির কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৯৩৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৩০৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। যা মোট কৃষি ঋণের ২২ শতাংশ।
এরপরেই ১৯ শতাংশ খেলাপি ঋণ নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক-রাকাব। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের প্রায় পুরোটাই খেলাপি।
দেশি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ উত্তরা ব্যাংকের। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ১৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ব্যাংকটির মোট ২৮৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা কৃষিঋণের মধে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে ব্যাংকের এমডিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান এবং ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বর্তমানে ব্যাংকের তারল্য সংকট রয়েছে। তাছাড়া আমানতের সুদহারও বেশি একারণে কিছুটা কমেছে। তবে বছর শেষে ব্যাংকগুলো লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করবে বলে আশাবাদী আমি।