কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলা ও চীনের তিব্বত আগ্রাসন : এন এস ভেঙ্কটরমন


২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আরো একটি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটলো কাশ্মীরে, যেখানে ৪০ জনের বেশি ভারতীয় সেনা নিহত এবং বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটা ছিল সবচেয়ে বড় আক্রমণ। এই আক্রমণে দেশটির অভ্যন্তরে এবং প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে বড় ধরণের ক্ষোভ ও শোক তৈরি হয়েছে। অনেক ভারতীয়ই দুশ্চিন্তায় পড়েছে সন্ত্রাসীদের এই নৃশংস হামলা পরিস্থিতিতে কী করণীয় তা নিয়ে।

বৈশিষ্ট্য এবং উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে কাশ্মীরের এসব হামলা এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হামলাগুলোর সঙ্গে ষাট বছর আগে চীনের তিব্বতে আগ্রাসনের বিশেষ কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। চীনের জোর করে তিব্বতে ঢুকে তা দখল করা এবং কাশ্মীরকে সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে দখল করার চেষ্টায় স্থানীয় জনগণের কোনো সমর্থন নেই। দু ক্ষেত্রেই জনগণকে জোরপূর্বক মুখ বন্ধ করে রাখা হয়েছে সহিংসতার ভয় দেখিয়ে। নিরাপদে ভোট প্রদানের নিশ্চয়তা দেওয়ার ফলে কিন্তু কাশ্মীরের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক ভোটার উপস্থিত হতে দেখা গেছে।

universel cardiac hospital

এই সময়ে সারাবিশ্বব্যাপি সন্ত্রাসী হামলা একটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সন্ত্রাসীরা অন্তর্ঘাতমূলক আক্রমণ চালাতে সক্ষম হচ্ছে। সন্ত্রাসী হামলার হাত থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপও রেহাই পাচ্ছে না। কানাডাতেও সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কাশ্মীরে হামলা এবং ইউরোপ-আমেরিকায় হামলার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। সেসব দেশে যারা সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িতে তাদের পেছনে সরাসরি কোনো একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্র নেই। কিন্তু কাশ্মীরের বেলায় এটা এখন আর গোপন কিছু নয় যে পাকিস্তানের মাটি ব্যবহার করেই সন্ত্রাসীরা অপারেশন চালাচ্ছে। সবচেয়ে বড় দুঃখের বিষয় হল, পাকিস্তান নিজেই একের পর এক সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েও কাশ্মীরে হামলার জন্য নিজেদের ভূখন্ড ব্যবহার করতে দিচ্ছে! বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানের সরকার এবং সিনিয়র রাজনীতিবিদরা কাশ্মীরের সন্ত্রাসী হামলাকে স্বাধীনতা আন্দোলন বলে উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তান প্রকাশ্যে বলেছে, তারা এইসব কর্মকা- সমর্থন করে।
কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলা এবং চীনের প্রকাশ্যে জইশ-ই-মুহাম্মদকে সমর্থন এটাই প্রমাণ করে যে তারা তিব্বতে আগ্রাসনকে জায়েজ করতে চায়। জইশ-ই-মুহাম্মদের মোটিভ হল তারা কাশ্মীরকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাকিস্তানের সঙ্গে একত্রিত হতে চায়। তারা জম্মু এবং কাশ্মীরে অনেকগুলো হামলা চালিয়েছে। এরা আফগানিস্তানের তালিবান এবং আল-কায়দার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখে এবং তাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে চায়। বিশ্বব্যাপি জইশ-ই-মুহাম্মদকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে ভারতের উদ্যোগকে চীন অস্বীকার করে আসছে। চীনের এই অস্বীকার থেকেই দেশটির প্রকৃত চেহারা বোধগম্য।

চিন যখন তিব্বত দখল করে তখন সারাবিশ্ব চুপ করে ছিল। যখন নিরিহ তিব্বতীদের উপর আক্রমণ দেখেও বিশ্ব চুপ করে থাকায় চীন এবং অন্যকিছু সন্ত্রাসে মদদদাতা দেশ ধরে নিয়েছে যে উদ্দেশ্য সাধনে সহিংসতাই হল সর্বোত্তম পন্থা। সে তারা যত ঘৃণ্যই হোক।
দৃশ্যত ভারত সরকারের মধ্যে একটা অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে যে শক্তি প্রয়োগ করে সন্ত্রাস দমনে তারা কতটা দূর যেতে পারে। এখনো ভারতে এবং দেশটির বাইরে গান্ধীর অনুসারি এমন কিছু মানবাধিকার কর্মী আছেন যারা সন্ত্রাস দমনে শক্তি প্রয়োগ করে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে সন্ত্রাসী হত্যা করা অনুমোদন করেন না।

গৌতম বুদ্ধ এবং মহাত্মা গান্ধী অহিংসার প্রবক্তা হলেও তারা দুজনই বারবার ব্যক্ত করেছেন যে অহিংসা মানে সহিংসতার কাছে আত্মসমর্পন নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মহাত্মা গান্ধী ব্রিটেনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন হিটলারের বিরুদ্ধে। কারণ হিটলার ছিল অশুভ শক্তি। যে সমস্যায় ভারত ভুগছে তা হল, সন্ত্রাসীদের উপর হামলা করতে হলে পাকিস্তানের ভূমিতে আক্রমণ করতে হবে। কারণ তারা পাকিস্তানের ভূমি থেকে সন্ত্রাস পরিচালনা করে থাকে। এর প্রকৃত অর্থ দাড়াবে পাকিস্তানকে হামলা করা।

এটা অনেকেই জানেন যে পাকিস্তানের একটি বড় জনগোষ্ঠি সন্ত্রাসের ব্যাপারে ভীষণ অসন্তোষ্ট এবং তারা চায় যেকোনোভাবে সন্ত্রাসীদের দমন করা হোক। সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের উপর হামলা করার মানে হল পাকিস্তানের জনগণের উপর হামলা করা। এমন পরিস্থিতি ভারত সৃষ্টি করতে চায় না।

অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা ভয়াবহ রকমের খারাপ। আর্ত-সামাজিক সূচকে পাকিস্তান খুবই ভুগছে এবং নিকট ভবিষ্যতে সমাধানের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। পাকিস্তান আইএমএফ-এর কাছ থেকে বিশাল পরিমান ঋণ গ্রহণ করেছে টিকে থাকার জন্য। সুতরাং পাকিস্তানের ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে টিকে থাকার কোনো সামর্থ্য নেই।
যদি পাকিস্তান ভেবে থাকে যে তারা একটি যুদ্ধের ঝুঁকি নিয়েও অব্যাহতভাবে সন্ত্রাসে মদদ দিয়ে যাবে এবং তাতে চীনের সমর্থন পাবে, তাহলে ভয়ানক ভুল করছে। পাকিস্তান সরকারের বাস্তবতা বিবেচনা করে দেখা উচিত।
পাকিস্তানের এ কথাও বোঝা উচিত যে আজকের বিশ্ব পরিস্থিতিতে তারা যদি ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে চীন তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসতে পারবে না। এর কারন চীনের ভারতের সঙ্গে এখন বিশাল ব্যবসায়ি স্বার্থ রয়েছে এবং বর্তমানে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বাণিজ্য যুদ্ধে জড়িয়ে আছে।

কাশ্মীরে সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রনে ভারত এখন চাইবে যে পাকিস্তানের বোধদয় ঘটুক। কাশ্মীরের সন্ত্রাসে মদদ দিয়ে তাদের কোনো লাভ নেই। যদি পাকিস্তান তা বুঝতে না পারে, তাহলে একটি রক্তাক্ত যুদ্ধ অপহিার্য হয়ে উঠতে পারে। দু দেশেরই পরিণত এবং দায়িত্বশীল নাগরিকরা শান্তি চায়, কিন্তু সেজন্য দু দেশেরই হাতে হাত মেলানো প্রয়োজন।

শ্রীলঙ্কান গার্ডিয়ানে প্রকাশিত নিবন্ধ মত ও পথে অনুদিত।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে