বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফল বিপর্যয়ের পর এখনও হতাশা কাটেনি।
নির্বাচন ও কর্মসূচি নিয়ে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের ব্যপারে তাদের মধ্যে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কেন নির্বাচনে অংশ নেয়া হলো, সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল, ফল প্রত্যাখ্যানের পর কঠোর কোনো কর্মসূচি ঘোষণা হয়নি- এসব নিয়ে তৃণমূলে চলছে বিচার-বিশ্লেষণ।
তবে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে জোরালো আন্দোলন কর্মসূচি না দেয়ায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতাদের দোষারোপ করছেন তৃণমূল নেতারা; যা নিয়ে শুক্রবার অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে প্রকাশ্যে কথা বলেন ধানের শীষের প্রার্থীরা। তারা অবিলম্বে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কঠোর কর্মসূচির দাবি জানান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ও বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, নির্বাচন কেমন হয়েছে, ভোট ডাকাতি কিভাবে হয়েছে- দেশবাসীসহ বহির্বিশ্ব সবাই দেখেছে। ভোটের আগের দিন রাতে ভোট দেয়া হয়েছে। আমরা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছি, কর্মসূচিও পালন করেছি। তিনি বলেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। তার মুক্তির দাবিতে শিগগিরই ফের কর্মসূচি দেয়া হবে।
শুক্রবার ভোটে ‘অনিয়মের’বিষয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ধানের শীষের প্রার্থীদের নিয়ে গণশুনানির আয়োজন করে।
তবে গণশুনানিতে অধিকাংশ প্রার্থীই নির্বাচনের কৌশল নিয়ে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতাদের ব্যর্থতার কথা তুলে ধরেন।
শেরপুর-৩ আসনের প্রার্থী মাহমুদুল হক রুবেল বলেন, নির্বাচন নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে আমাদের নানা প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে। নির্বাচনের সময় কেন্দ্র থেকে যে নির্দেশগুলো এসেছে- ১০ ডিসেম্বরের পরে কোনো নেতাকর্মী গ্রেফতার হবে না, সুন্দরভাবে প্রচারণা চালাতে পারব। ১০ তারিখ শেষ হল, নির্দেশ এলো সেনাবাহিনী নামলে আমরা নির্বাচন করতে পারব। তারপর কেন্দ্র থেকে জানানো হল ৩০ ডিসেম্বর সুন্দরভাবে ভোট হবে। কেন্দ্রের নির্দেশগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তৃণমূল নেতাকর্মীদের আশ্বস্ত করেছিলাম। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, আমরা নির্বাকদৃষ্টিতে দেখলাম কেন্দ্র যা বলছে তার বিপরীত কর্মকাণ্ড মাঠে দেখছি। আমরা আশা করেছিলাম, কেন্দ্র জেলাওয়ারি না হলেও তিনশ’ প্রার্থী নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সামনে এক ঘণ্টার অনশন কর্মসূচি দেবে। তা করা হলে দেশবাসী এবং সারা বিশ্ব বিষয়টি দেখত। তাও হলো না। ঢাকায় সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়ে তা থেকে সরে আসা হলো।
তিনি বলেন, আমরা যে ন্যূনতম প্রতিবাদ করলাম না, ন্যূনতম কোনো প্রতীকী প্রতিবাদও করলাম না- এটা আমাদের তৃণমূলের সব নেতাকর্মীরই প্রশ্ন।
নোয়াখালী-২ আসনের প্রার্থী জয়নাল আবদিন ফারুক বলেন, সরকারপ্রধানের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টে সংলাপের পরও যখন খালেদা জিয়ার জামিন হলো না। নেতাকর্মীদের ওপর ‘হামলা-মামলা’ নিয়ে ইসির কাছে নালিশ জানিয়েও যখন সাড়া মিলল না। ২৭ ডিসেম্বর ঐক্যফ্রন্ট যখন ঢাকায় জনসভা করার অনুমতি পেল না, তখন ড. কামাল হোসেনের ‘শেষ পর্যন্ত ভোটে থাকার’ নীতি কতটা সঠিক ছিল? তখনই আপনাদের বোঝা উচিত ছিল আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে আপনারা পরাজিত হয়েছেন।
এ সময় মির্জা ফখরুলকে উদ্দেশ করে ফারুক বলেন, আর সহ্য হচ্ছে না। অনেকে বলে ঢাকা মহানগর (কমিটি) আছে কি না। আমি বিশ্বাস করি সবই আছে, পরিচালনার লোকও আছে; বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে- সেটা আগে নিজেরাই ঠিক করুন।
সূত্র জানায়, নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও পক্ষে-বিপক্ষে মত ছিল। স্থায়ী কমিটির তিনজন সদস্য নির্বাচনে যাওয়ার বিপক্ষে ছিলেন। পরে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে বিএনপির হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত দিলে তারাও তা মেনে নেন।
তবে নির্বাচনে ফল বিপর্যয়ের পর ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে বিএনপিতে এখন দুটি পক্ষ তৈরি হয়েছে। বিএনপি থেকে তিনজন স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যের মধ্যে দু’জন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলেন।
এমনকি ফ্রন্টের কোনো বৈঠকেও যোগ দিতে অনীহা প্রকাশ করেন তারা। পরে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে তাদের পরিবর্তে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও ড. আবদুল মঈন খানকে স্টিয়ারিং কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর থেকে ঐক্যফ্রন্টের কোনো বৈঠক কিংবা কর্মসূচিতে খন্দকার মোশাররফ ও ব্যারিস্টার মওদুদকে অংশ নিতে দেখা যায়নি।
সর্বশেষ ঐক্যফ্রন্ট আয়োজিত গণশুনানিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ড. আবদুল মঈন খান ছাড়া কোনো স্থায়ী কমিটির সদস্যই অংশ নেননি। সেখানে ছিলেন না ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, বরকতউল্লাহ বুলু, মো. শাহজাহান, যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ারসহ অনেক সিনিয়র নেতা, যারা নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন।
শুক্রবার গণশুনানিতেও বিএনপির প্রার্থীরা খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি না দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অধিকাংশ প্রার্থীই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিই এখন প্রধান এজেন্ডা হওয়া উচিত বলে মত দেন। তারা বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া কিছুই সম্ভব হবে না। তাই কর্মসূচি দিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান নেতারা।
তবে কয়েকজন প্রার্থী বলেছেন, আবেগ দিয়ে রাজনীতি হয় না। আরও সময় নিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করে বড় ধরনের কর্মসূচি দিতে হবে। তবেই আশানুরূপ ফল আসবে। নইলে এ মুহূর্তে বড় কোনো কর্মসূচি দিলে তা সফল হবে না।