ডাকসু নির্বাচনে পর্যবেক্ষণকারী বিশ্ববিদ্যালয়টির ৮ শিক্ষক অনুষ্ঠিত হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন সর্বাঙ্গীন সুষ্ঠু হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন।
সোমবার এক বিবৃতিতে এ কথা বলেন তারা। বিবৃতিতে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজনে ব্যর্থ হওয়ার কারণ তদন্তের পাশাপাশি দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা এবং নির্বাচন স্থগিত করে নতুন তফসিল ঘোষণার দাবিও জানান তারা।
প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষক ডাকসু নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য আবেদন করেন প্রশাসনের কাছে। অনুমতি পাওয়া এই ১০ জন শিক্ষকের মধ্যে ৮ জন শিক্ষক আজ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন।
পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বিবৃতিতে শিক্ষকরা বলেন, আমরা সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ছাত্রদের স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, সূর্যসেন হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, স্যার এফ রহমান হল, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হল এবং ছাত্রীদের রোকেয়া হল ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল পরিদর্শন করি। আমরা কুয়েত মৈত্রী হল থেকে আমাদের পর্যবেক্ষণ শুরু করি। কারণ, আমরা শুরুতেই এই হলে ভোটদানে অনিয়মের কথা জানতে পারি।
শিক্ষকরা বলেন, আমরা জানতে পারি, ভোটগ্রহণ শুরু হবার আগে ছাত্রীরা নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা শিক্ষিকাদের কাছে শূন্য ব্যালট বাক্স দেখতে চান। কিন্তু তাদের এই ন্যায্য দাবি অগ্রাহ্য করা হয়। এতে ছাত্রীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং এক পর্যায়ে কেন্দ্রের পাশের কক্ষ থেকে একটি বিশেষ ছাত্র সংগঠনের পক্ষে পূরণ করা প্রচুর ব্যালট পেপার উদ্ধার করে। সেগুলোর বেশকিছু আমরা শিক্ষকরাও দেখতে পেয়েছি। এরকম অবস্থায় স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে ভোট গ্রহণ স্থগিত হয়ে যায়। এই ঘটনায় প্রভোস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সমর্থ না হলেও আমরা রিটার্নিং অফিসারদের লজ্জিত ও মর্মাহত দেখতে পাই।
শিক্ষকরা বিবৃতিতে বলেন, রোকেয়া হলে সরকারি ছাত্রসংগঠনের বাইরের একাধিক প্যানেলের শিক্ষার্থীরা ভোটকেন্দ্রের পাশের রুমে ব্যালট পেপারের সন্ধান পান এবং সেগুলোকে দেখানোর জন্য কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেন। কিন্তু সেগুলো ছিল সাদা ব্যালট পেপার। এরপর পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবং সরকারি ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা বিরোধীদের ওপর চড়াও হয়। এসময় বিরোধী পক্ষের কয়েকজন আহত হন। উভয় পক্ষের উত্তেজনায় এরকম অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে রোকেয়া হলে, যার নিন্দা জানাই আমরা।
ছাত্রদের হলে তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে দেখা গেছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেন পর্যবেক্ষক শিক্ষকরা। তবে ভোটকেন্দ্রের বাইরে ভোটারের আইডি চেক করার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের সদস্যদের সক্রিয় থাকা, অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোট দিতে নিরুৎসাহিত করা ও বাধা দেওয়া, ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য প্রার্থীদের ভোটকেন্দ্রের বাইরে অবস্থানে বাধা দেওয়া, ভোটকেন্দ্রের বাইরে কৃত্রিম জটলা তৈরি করে ভোটগ্রহণের গতি স্লথ করে দেওয়া, বুথের ভেতরে ভোটারদের ৫ থেকে ২৩ মিনিট পর্যন্ত সময় নেওয়া, ভোট চলাকালে রোকেয়া হলের সামনে শোডাউনের মতো অনিয়মের কথা উল্লেখ করেন শিক্ষকরা।
তারা বলেন, একটি বড় অসঙ্গতি মনে হয়েছে, ব্যালট পেপারে কোনো সিরিয়াল নম্বর ছিল না। ৪৩ হাজার ভোটারের একটি নির্বাচনের ব্যালট পেপারে সিরিয়াল নম্বর না থাকাটা আমাদের কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। কারণ এতে নির্বাচনের ফলাফলে গুরুতর অনিয়ম ঘটানো অনেক সহজ হয়ে যায়। কোন হলে কোন সিরিয়াল গেল, তাও ট্র্যাক রাখার উপায় থাকার কথা না।
শিক্ষকরা বলেন, আমরা এটাই বলতে চাই— এই বহুল প্রতীক্ষিত ডাকসু নির্বাচনের অনিয়মের ঘটনাগুলো আমাদের খুবই লজ্জিত করেছে। এই ঘটনা জনগণের করে পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভাবমূর্তিকে চরমভাবে বিনষ্ট করেছে। এতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে যা সার্বিকভাবে একাডেমিক পরিবেশ বিঘ্নিত করবে। এত বছর পরে অনুষ্ঠিত এই ডাকসু নির্বাচন সফলভাবে না করতে পারার ব্যর্থতার দায়ভার প্রশাসন থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষক সবার এবং এই ব্যর্থতা সমগ্র শিক্ষক সম্প্রদায়ের নৈতিকতার মানদণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা চাই এই ব্যর্থতার একটি সুষ্ঠু তদন্ত হোক এবং দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা হোক। সেই সঙ্গে এই নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করে অবিলম্বে নতুন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হোক।
বিবৃতিদাতা শিক্ষকরা হলেন— গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম, ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাহমিনা খানম এবং অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অতনু রব্বানী।