‘মত ও পথ পরিবার’ এমন অনাকাঙ্খিত হত্যাকাণ্ডে গভীরভাবে শোকাহত। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এ হামলার কাছাকাছিই ছিল। বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় ওই মসজিদে নামাজ পড়তেও রওয়ানা হয়েছিলেন। কিন্তু সৌভাগ্য আমাদের, তারা পৌঁছার আগেই যা ঘটার ঘটে গেছে। আমাদের খেলোয়াড়রা প্রাণে বেঁচে গেছেন।
আজ শুক্রবার যে অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল তা আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারিনি। ২৮ বছর বয়সী অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ব্রেন্টন ট্যারান্ট নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে আল নূর মসজিদে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। এ হামলার ঘটনা ঘটে নিউজিল্যান্ডে দুপুর ২টায়, ঠিক জুমা নামাজে যখন মুসলমানরা উপস্থিত হয় তখন। হামলায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৪৯ জন নিহত এবং বহু লোক গুরুতর আহত হয়েছে বলে নিউজিল্যান্ড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। তাৎক্ষণিক সংবাদে জানা গেছে, ক্রাইস্টচার্চেই আল নূর মসজিদের অদূরেই আরো একটি মসজিদে হামলা চালানো হয়েছে। কিন্তু সে সম্পর্কে এখনো বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। দুটো স্থানে মোট ৪৯ জন নিহত হয়েছে।
‘মত ও পথ পরিবার’ এমন অনাকাঙ্খিত হত্যাকাণ্ডে গভীরভাবে শোকাহত। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এ হামলার কাছাকাছিই ছিল। বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় ওই মসজিদে নামাজ পড়তেও রওয়ানা হয়েছিলেন। কিন্তু সৌভাগ্য আমাদের, তারা পৌঁছার আগেই যা ঘটার ঘটে গেছে। আমাদের খেলোয়াড়রা প্রাণে বেঁচে গেছেন।
আপাতদৃষ্টিতে শান্ত এবং সন্ত্রাসী হামলা থেকে ঝুঁকিমুক্ত দেশটিতে নিরাপত্তায় অপ্রস্তুত পরিবেশে ট্যারান্ট ১৬ মিনিট ধরে মানুষ হত্যার বিভৎস উৎসবে মেতে ওঠে। নিজের গায়ের সঙ্গে ১৭ মিনিট ভিডিও চালু রেখে এ হামলা চালানোর সময় সে প্রথমে বলে, ‘এসো আমরা উৎসব শুরু করি’। কিছুক্ষণ চুপ থেকে অনলাইনে সে সবাইকে জনপ্রিয় ইউটিউব সাইট চবউিরবচরব সাবস্ক্রাইব করতে বলে। এরপর জিপিএস ব্যবহার করে দ্রুত পৌঁছে যায় মসজিদের সামনে।
এ সময় তার গাড়িতে মিউজিক বাজছিল। তার পাশেই ছিল একটি ব্ল্যাক অসল্ট রাইফেল। সেই রাইফেলের গায়ে সাদা কালিতে লেখা ছিল কয়েকজন ক্রুসেডারের নাম যারা অতীতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। বিশেষ করে অটোমান তুর্কিদের বিরুদ্ধে সার্বিয়ার ক্রুসেডারদের নাম রয়েছে। গাড়ি থামিয়ে সে অ্যাসল্ট রাইফেলটা টেনে নিয়ে সোজা মসজিদের দিকে হাঁটতে শুরু করে। এবং গুলি করতে করতে ভেতরে ঢোকে। ঠাণ্ডা মাথায়। যত মানুষ সামনে পরছে গুলি করছে। অ্যাসল্টের গুলি ফুরিয়ে গেলে সেটি ফেরে দিয়ে আরেকটি অস্ত্র তুলে নেয়। সেটা দিয়েও গুলি করতে থাকে। এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে ঢুকে নির্বিচারে পলায়নপর মানুষের উপর গুলি করতে থাকে। সেটাও যখন শেষ হয়ে যায় সে আবার বের হয়ে আসে এবং গাড়ি থেকে আরেকটি অস্ত্র বের করে গুলি চালাতে থাকে।
হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট অথবা হেইট ক্রাইম যাই বলুন, পশ্চিমা শেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি মুসলিম বিদ্বেষি সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে। আর মুসলিম মানেই আফ্রিকা এবং এশিয়ার জনগণকে তারা বুঝে থাকে। আইনের শাসনের ওই পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রায়ই এমন হামলার ঘটনা দেখা যাচ্ছে। মনে আছে ২০১১ সালে নরওয়েতে অ্যান্ডার্স ব্রেইভিক ৭৭ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছিল। তার সেই হত্যাকাণ্ডের কারণ ছিল ইসলাম বিদ্বেষ এবং ইসলামের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা। এ ছাড়াও প্রায়শই এরকম ছোটখাটো ঘৃণা দেখা যাচ্ছে। নিউজিল্যান্ডে ব্রেন্টন ৭৪ পাতার একটি নোট তৈরী প্রকাশ করেছে হামলার আগেই, যেখানে সে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডকে ইউরোপের আউটপোস্ট বলে মনে করে বলে জানিয়েছে। সে মনে করে, মাল্টি-কালচারিজম বা বহু জাতির মিশ্রণে শেতাঙ্গ এবং পশ্চিম ইউরোপের সংস্কৃতি ক্ষয়িষ্ণু হয়ে উঠেছে। নিজেকে ‘এথনো ন্যাশনাল ইকো ফ্যাসিস্ট’ দাবী করে ট্যারান্ট ২০০০ সালে সিডনিতে গণধর্ষণ এবং ব্রিটেনের রোদারহ্যামে ৮০, ৯০ এবং ২০০০ দশকে পাকিস্তানীদের হাতে ১৪০০ শিশু ধর্ষণের উল্লেখ করেছে। তা ওই ইশতেহারে সে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশংসা করেছে। ট্রাম্পকে সে শেতাঙ্গ পরিচয়য়ের প্রতীক বলে উল্লেখ করেছে।
অর্থাৎ যে ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠি ইউরোপ, আমেরিকা তথা পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলমান বিরোধী প্রচারণায় সক্রিয়, তারা ধীরে ধীরে শক্তিশালী এবং সক্রিয় হয়ে উঠছে। এটি শুভ লক্ষণ নয়। দীর্ঘকাল ধরে সারা বিশ্বের মুসলিম সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। সেই লড়াইয়ে লাখ লাখ মানুষ জীবন হারিয়েছে, লাখ লাখ মানুষ বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত হয়েছে। অফনেক শাসক ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন, নিহত হয়েছেন। কয়েকটি দেশ যুদ্ধে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। বিশ্বব্যাপি প্রতিটি নিরিহ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে। সেই অবস্থা যখন একটু প্রশমনের দিকে, তখনই একটি সম্প্রদায়ের উপর এ ধরনের নিষ্ঠুর হামলা ও হত্যাকাণ্ড আবার বিশ্বব্যাপি অশান্তি জাগিয়ে তুলতে পারে।
পশ্চিমারা এইসব সন্ত্রাসীর নাম দিয়েছে লোন ওলফ, বা একা নেকড়ে। অর্থাৎ এরা সংগঠিত নয়। সংগঠিত না হলেও এদের একটি অলিখিত স্কুল অব থট তৈরি হয়ে গিয়েছে। কমন চিন্তা করা কিছু মানুষ যে ইন্টারনেটের এই যুগে যখন-তখন এক হয়ে, সংগঠিত হয়ে ধ্বংসাত্মক কাজ করবে না তার কোনো নিশ্চয়তা কি আছে?
পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বহু এশিয়ান এবং মুসলমানের বসবাস। ব্রিটেন, ইউরোপ এবং আমেরিকায় বড় বড় মুসলিম কমিউনিটি তৈরী হয়েছে। তারা বেশ নিরাপদেই বসবাস করছে সেসব দেশে। কিন্তু এ ঘটনার পর এসব কমিউনিটির লোকেরা যে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যদিকে ঝিমিয়ে পড়া মুসলিম টেররিস্টরা যে আবার দ্বিগুণ প্রতিহিংসা নিয়ে জেগে উঠবে না, কে জানে!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সিনিয়র সাংবাদিক