বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে কৃষির জন্য বিপজ্জনক ফসলবিধ্বংসী পোকা ‘ফল আর্মিওয়ার্ম’। এ পোকা এর আগে আফ্রিকা মহাদেশের কৃষিতে চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশে এ পোকার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কার্যকর অস্ত্র কী হতে পারে, সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। যার জন্য এই খবরকে কৃষির জন্য বিপদসঙ্কেত হিসেবে দেখছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা।
পোকাটি আমেরিকা মহাদেশে প্রথম শনাক্ত হয়। তবে এরা দ্রুত অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। ভয়ঙ্কর এ পোকা ২০১৭ সালের প্রথম দিকে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে ফসলহানি করে সে অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। মূলত ২০১৬ সালের প্রথম দিকে এ পোকার আক্রমণ শুরু হয় আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিতে।
কৃষিবিদরা জানান, এ পোকার সংক্রমণ দেখা দিলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফসলের ক্ষেত পুরোটাই ক্ষতি হয়ে যায়। আর বাংলাদেশের আবহাওয়া আর যে ধরনের ফসল এখানে চাষ হয়, তাতে এ দেশটি ভয়ঙ্কর এ পোকার বংশবিস্তারের জন্য আদর্শ জায়গা হতে পারে। ভুট্টাসহ বেশকিছু ফসলের ক্ষেতে এ পোকার আক্রমণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মেহেরপুরের কৃষি কর্মকর্তারা। এই পোকা নিধনে কীটনাশক প্রয়োগ করেও মিলছে না সুফল। সম্প্রতি ভারতের কর্নাটক এবং তামিলনাড়ু রাজ্যে এ পোকার আক্রমণ দেখা যায়।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, এ পোকা দিনে ১০০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে পারে। তাদের বংশবিস্তার হয় দ্রুত। এটি ভুট্টা, তুলা, বাদাম, তামাক, ধান, বিভিন্ন ধরনের ফলসহ প্রায় ৮০টি ফসলে আক্রমণ করে থাকে। তবে ভুট্টা ফসলে এর আক্রমণের হার সর্বাধিক।
কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের মতে, ভয়ানক এই পোকা গত বছর থেকে দেশের বেশকিছু জায়গায় প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে। এরই মধ্যে মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ এবং চুয়াডাঙ্গাতে এ পোকার হাতে ফসল ধ্বংস করার খবর পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আবহাওয়া এবং ফসলের ধরনের কারণে এই পোকার আদর্শ স্থান হতে পারে বাংলাদেশ।
পোকাগুলো শুককীট থাকা অবস্থায় গাছের পাতা ও ফল খেয়ে থাকে। এই পর্যায়ে এদের খাদ্য চাহিদা অনেক কম থাকে, তবে তারা বড় হলে খাদ্য চাহিদা প্রায় ৫০ গুণ বাড়ে। যে কারণে তাদের শারীরিক গঠন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য চাহিদাও কয়েক গুণ বেড়ে যায় এবং তারা রাক্ষুসে হয়ে ওঠে। যার ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে। এক রাতের মধ্যেই তারা সব ফসল বিনষ্ট করে ফেলতে পারে।
পোকাটি সঙ্গনিরোধ বালাই হিসেবে পরিচিত। ডিম ও পুত্তলি অবস্থায় বিভিন্ন উদ্ভিদজাত উপাদান যেমন বীজ, চারা, কলম, কন্দ, চারা সংলগ্ন মাটি ইত্যাদির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করতে পারে। পূর্ণাঙ্গ পোকা অনেক দূর পর্যন্ত উড়তে পারে এমনকি ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে কয়েক শত কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তারলাভ করতে পারে।
সম্প্রতি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষা তেঁতুলবাড়িয়া গ্রামের ভুট্টা ক্ষেতে দেখা মিলেছে ‘ফল আর্মিওয়ার্ম’ পোকার। তারা গাছের পাতা থেকে শুরু করে কাণ্ড পর্যন্ত খেয়ে ফেলছে। যেসব গাছে ইতোমধ্যে আক্রমণ করেছে সেই গাছগুলোতে আর ভুট্টা হবে না।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এই পোকাটি আমেরিকা ও কানাডায় শনাক্ত হলেও কীটনাশক দিয়ে দমন করা সম্ভব হয়নি। দেশের কয়েকটি অঞ্চলের কৃষকরা ফসল বাঁচাতে সুচ ও স্বর্ণা দিয়ে এই পোকা খুঁজে বের করে মেরে ফেলছে। এ পোকা নিধনে এ ছাড়া অন্য কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না তারা।
এদিকে মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক আখতারুজ্জামান বলেন, বিধ্বংসী এ পোকাটি ফসলের শতভাগ ক্ষতি করতে পারে। এ পোকা কীটনাশক দিয়ে দমন করা বেশ কষ্টকর। দেখা মাত্রই হাত দিয়ে মেরে ফেলতে হবে, না হলে দ্রুত বংশবিস্তার করে। অথবা জমিতে প্লাবন সেচ দিতে হবে।
মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি নেই
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আর্মিওয়ার্ম’ প্রতিরোধে উল্লেখ করার মতো কোনো প্রস্তুতি নেই বাংলাদেশের। এই অবস্থায় যদি কোনোভাবে দেশজুড়ে এ পোকার বিস্তার ঘটে, তাহলে সে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় এ পোকার কারণে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়েছে। এই পোকা দমনে শিগগিরই কার্যকর উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে যেকোনো সময় কৃষিতে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।