মামলা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতি বছরই বাড়ছে বিচারপ্রার্থীর সংখ্যা। রয়েছে বিচারক ও এজলাস সংকট। মামলা হ্রাসে বিচারক নিয়োগের পাশাপাশি বৃদ্ধি পেয়েছে নিম্ন আদালতের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা। অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়লেও কমেনি মামলা জট।
বছরের পর বছর চলে গেলেও শেষ হচ্ছে না বিচার কাজ। বিচারপ্রার্থীরাও যেন অনেকটা অসহায়। মামলা চালাতে গিয়ে অনেককে হতে হচ্ছে নিঃস্ব। আবার আদালতে হাজিরা থেকে শুরু করে বিচারপ্রার্থীকে নানা দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে। যেমনটির দেখা মিলল ঢাকার নিম্ন আদালতে।
সেখানে প্রতিদিনই ভিড় করছেন হাজারো মানুষ। এদের মধ্যে অনেকে আসছেন মামলার হাজিরা দিতে। কেউ আসছেন কারাবন্দি আসামির সঙ্গে দেখা করতে। ফলে লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ছে আদালত প্রাঙ্গণ। অনেকে হাজতখানায় থাকা স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে অপেক্ষা করছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অথচ তাদের বসার জন্য নেই কোনো ব্যবস্থা। নেই পর্যাপ্ত টয়লেট সুবিধাও। রেবতী ম্যানশনে নারী ও শিশু বিচারপ্রার্থীর বিশ্রামাগার থাকলেও সেখানে যান না অনেকেই। চলতি সপ্তাহের একাধিক দিন ঢাকার নিম্ন আদালত ঘুরে এমন চিত্রই চোখে পড়ে।
শুধু তাই নয়, ঢাকার বিভিন্ন আদালত ভবনের সামনের চত্বরে নানা পণ্যের পসরা নিয়ে বসছেন হকাররা। কেউ বিক্রি করছেন ডাব, কেউবা শসা, সিগারেট, ছোলা মুড়ি। আবার অনেকে দালালদের খপ্পরে পড়ে হচ্ছেন নিঃস্ব। তবে এজলাস সংকট ও বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি দূর করতে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ১০ তলা এই ভবনটি আগামী মাসে উদ্বোধন করা হতে পারে।
ওই ভবনে সার্বক্ষণিক জেনারেটর সুবিধাসহ ৪টি লিফট রয়েছে। রয়েছে পর্যাপ্ত টয়লেটের ব্যবস্থাও। প্রতিবন্ধীদের জন্যও বিশেষ সুবিধা রাখা হয়েছে। রয়েছে পুরুষ ও নারী আসামিদের জন্য আধুনিক সুবিধা সম্বলিত পৃথক হাজতখানা। ঢাকার সিএমএম আদালত ভবন ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের ফলে বিচারকদের এজলাসসহ অন্যান্য অবকাঠামো এবং হাজতখানা-কাম-পুলিশ ব্যারাকের কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বিচারক, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী জনগণ এবং বিচার কাজে সংশ্লিষ্ট সকলে উপকৃত হচ্ছেন।
তুরাগ থানার একটি মাদক মামলায় সোমবার হাজির করা হয় তিন আসামিকে। তাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন ৮/৯ জন স্বজন। প্রতিদিনই হাজিরা দিতে আসা অসংখ্য আসামির সঙ্গে এভাবে দেখা করতে আসেন স্বজনরা। ফলে বাড়ছে ভিড়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিভিন্ন নাশকতার মামলায় হাজিরা দিচ্ছেন বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের অসংখ্য নেতা-কর্মী। যারা মামলার আসামি তাদের সঙ্গেও দেখা করতে আসছেন কর্মী ও সমর্থকরা। ফলে ভিড় বেড়েই চলছে আদালতে।
এ প্রসঙ্গে হাইকোর্টের স্পেশাল অফিসার ব্যারিস্টার মো. সাইফুর রহমান বলেন, আদালতে আসামি হাজিরা দিতে আসলে তার সঙ্গে দেখা করতে পরিবারের ৩/৪ জন লোক আসেন। এ কারণে আদালত লোকে লোকারণ্য থাকে। এই অহেতুক ভিড় করার জন্য বিনষ্ট হয় আদালতের পরিবেশ। এমনকি কর্মঘণ্টাও নষ্ট হওয়ায় আদালতের সহায়ক কর্মচারীরা ঠিকভাবে তাদের কাজটি করতে পারেন না।
তিনি বলেন, দেশের অনেক জেলা আদালতে জেলা ও দায়রা জজগণ নিজ উদ্যোগে বিচারপ্রার্থীদের বসার জন্য পৃথক শেডের ব্যবস্থা করেছেন। আছে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থাও। এছাড়া ওয়ান স্টপ ইনফরমেশন ডেস্কও রাখা হয়েছে। যেখান থেকে বিচারপ্রার্থীরা লিগ্যাল এইডসহ বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সুবিধা পেয়ে থাকেন। যদিও এই সুবিধা ঢাকার আদালতে নেই।
বাড়ছে অবকাঠামোগত সুবিধা :
২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচার বিভাগের জন্য অবকাঠামো তৈরির বিশেষ উদ্যোগ নেন। ওই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ৬৪টি জেলা সদরে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের আওতায় ৪টি জেলায় সম্পূর্ণ ভবন নির্মাণ শেষে বিচার কার্যক্রম চলছে। ৪টি জেলায় ভবনের কাজ প্রায় সম্পন্ন ও ব্যবহার উপযোগী। ১৬ জেলায় গত ডিসেম্বরের মধ্যে ভবন নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। ১০টি জেলায় চলতি বছরের জুনের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হবে।
জানা যায়, নতুন অন্তর্ভুক্ত ৮টি জেলার মধ্যে ৬টিতে ভবন নির্মাণ কাজ চলছে। এছাড়া ২২টি জেলায় আদালত ভবন নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। শুধু সিজেএম আদালত ভবন নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করে থেমে থাকেনি। ২৮টি জেলায় আনুষঙ্গিক সুবিধাসহ জেলা জজ আদালত ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলা ৩০ লাখ ৩২ হাজার ৬৫৬টি। কর্মরত বিচারক রয়েছেন ১ হাজার ৮১৯ জন। গত বছর নিষ্পত্তি হয়েছে ২ লাখ ৬৮ হাজার ৮৯৭টি মামলা। সর্বশেষ একশ জন বিচারক (সহকারী জজ) নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পথে রয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মামলা নিষ্পত্তিতে যে বিলম্ব সেটা যদি নিরসন করা যায় তা হলে বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তি অনেকাংশে লাঘব হবে।