নাবিলা

দিদার হাসান

গল্প

হাসিন মুরাদের মনে অনেক দুঃখ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রেম করে বিয়ে করেছিল এক রাজনৈতিক সহযাত্রীকে। কিন্তু সে বিয়ে এক বছরও টেকেনি। রাজনৈতিক আদর্শের মিল হলেও শেষ পর্যন্ত মনের মিল হয়নি। তাই যা হবার তা হয়েছে। নাবিলা ডিভোর্স দিয়েই দ্বিতীয় স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেরই সুপরিচিত ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র অগ্রজ রাহুল বিশ্বাসকে।

প্রেম করার সময় রাজনৈতিক আদর্শের মিলটাই বড় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বাস্তবতা যে বড় কঠিন এখানে দ্রুত ছন্দপতন ঘটতে পারে, তা হয়ত তখন কেউই ভাবেনি। শুধু রাজনৈতিক আদর্শই যে সংসার ধর্ম পালনের জন্য যথেষ্ট নয়, মনের মিল, সেই সঙ্গে চারিত্রিক সৎ গুণাবলিও থাকা জরুরি, তা নাবিলা বুঝেছে বিয়ের পরে। প্রেম করে বিয়ে করা মানুষটির মধ্যে কোথায় যেন এর খামতি রয়েছে। তাছাড়া তার প্রেমিক-স্বামী কেমন যেন সন্দেহপ্রবণ খুঁতখুঁতে এবং সংকীর্ণ। কোনো কিছুই সহজে গ্রহণ এবং বর্জন করতে পারে না।

universel cardiac hospital

সবকিছুতেই তার জটিলতা। এত জটিল মানুষের সঙ্গে কী ঘর করা যায়! তাছাড়া উদার না হলে, জীবন নানা আলোয় ভরাতে না পাড়লে, শুধুই সংসার করে কী লাভ! দুজন নর-নারীর যৈবিক ক্ষুধা নিবৃত্তের জন্যই কী শুধু বিয়ে-সংসার? তাছাড়া সেদিক থেকেও তো মুরাদের সক্ষমতা খুব যথেষ্ট নয়। সন্তান দেয়ার ক্ষমতা নিয়েও সংশয় আছে। চিকিৎসকদের কাছ থেকে এমনি অভিমত জেনে নাবিলার মন আর সায় দেয়নি মুরাদের সঙ্গে একত্রে থাকার।

দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে নাবিলার কখনও দেরি হয় না। বিয়েও করেছিল মুরাদকে মুহূর্তের সিদ্ধান্তে। পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়েই। আবার এখন বিয়েও ভেঙে দিচ্ছে মুহূর্তের সিদ্ধান্তেই। তাছাড়া যার সঙ্গে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিবে সে মানুষটা যদি এমন জটিল স্বভাবের হয় যা নাবিলার স্বভাব বিরুদ্ধ তাহলে একত্রে থাকা কি করে সম্ভব? জীবন তো ভাগাভাগির, উপলব্ধির, বোঝাপড়ার সর্বপরি আনন্দেরও; শুধু জটিলতা আর সংশয়-সন্দেহের নাম  তো জীবন নয়? নাবিলার দৃষ্টিভঙ্গি এমনই। ছোটবেলা থেকেই সে স্বাধীনচেতা এবং স্পষ্টভাষী। সবকিছুতেই নিজের ভালোলাগা পছন্দকে প্রাধান্য দিত, তা পরবর্তী সময়ে সঠিক না হলেও। কিন্তু ওর সবচেয়ে বড় গুণ সে সময় বাস্তবতার সঙ্গে খুব সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে।

ভুল করলে সে ভুল সংশোধনের চেষ্টাও করে খুব দ্রুতই। বাবার রাজনৈতিক প্রভাব কৈশোর থেকেই নাবিলার মধ্যে পড়েছে। স্কুলে সে কিছুটা চর্চাও করেছে। তবে পরিবেশ পরিস্থিতি এবং বয়সের কারণে তার প্রকাশ ও বিকাশ বিস্তৃত হতে পারে নি। কলেজে এর অন্যথা হয়নি। যেটা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলা বিভাগে ভর্তি হয়েই সে নিজের আদর্শ বিশ্বাসকে ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট ও সক্রিয় হয়েছে। সারাক্ষণ সভা-সমাবেশ, বক্তৃতা, পোস্টার, লিফলেট বিতরণ এভাবেই কাটছিল তার প্রথমবর্ষ।

দ্বিতীয় বর্ষে উঠেই নাবিলার সঙ্গে পরিচয় ফিন্যান্স বিভাগের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র হাসিন মুরাদের সঙ্গে। সেও একই আদর্শে বিশ্বাসী। সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের স্বপ্নে তখন দুজনেই বিভোর। আদর্শের জায়গাটা এক বলে সখ্যতা গড়ে ওঠে খুব তাড়াতাড়ি। এভাবেই এক সময় দুজনের অনুভূতি একসঙ্গে জড়ায়। মুরাদ একটু অন্তর্মুখী স্বভাবের বলে ওর ভালোবাসার প্রকাশ ভঙ্গিটা একটু অন্যরকম। তবে দায়িত্ব সচেতন। দলের আদর্শ প্রচারে আর কর্মসূচী বাস্তবায়নে ওর কোনো ঢিলেমি নেই। ক্লাসের ফাঁকে কিংবা ছুটির শেষে দলীয় কর্মসূচীর মধ্যে এবং এর বাইরেও ওরা দু’জনে একান্তে মিলিত হয়ে একে অপরের সহযাত্রী হতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। কিন্তু কে জানত কত সামান্য এ পথের যাত্রা!

এখন দুজনে দু’মেরুর বাসিন্দা। মুরাদ ঢাকায়, নাবিলা নিউজল্যান্ডে। নাবিলা স্বামী সন্তান নিয়ে সেখানে ভালোই আছে। ওর মাথা থেকে রাজনীতির পোকা ঝেরে ফেলে পুরো দস্তুর গৃহীনী হয়েছে। সংসার এখন ওর কাছে তীর্থস্থান। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ওকে যারা জানত তারা কে ভেবেছে ওর এই পরিবর্তন হবে? হ্যাঁ ও পারে, সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে। দ্রুত সবকিছু সামলে নিতে। তাছাড়া এখন তো ওর বয়সও কম হলো না! বিয়ের বয়স ১৬ বছর হতে চলল। দুই ছেলেমেয়ে ওর। ছেলে সাদ-এর বয়স ১৪, মেয়ে নিতুর বয়স ১১। একেবারে রিতিমতো দায়িত্বশীল, গর্বিত মা।

অতীত নিয়ে ওর কোনো মাথা ব্যথা নেই। ওর কাছে এখন বর্তমানই গুরুত্বপূর্ণ, সব। অতীতের ঘটনা যেন এক বিস্মৃত অধ্যায়। ও নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করার মন ওর নেই। কিন্তু মুরাদ অতীত মুখী। এভাবে ওকে ছেড়ে নাবিলার হঠাৎ চলে যাওয়া সহজে মেনে নিতে পারেনি। অনেক দিন স্মৃতি আগলে নিয়ে সঙ্গোপনে পথ চলেছে। প্রথম যৌবনের প্রেম তো! মুরাদ অনেকটা সময় একাই কাটিয়েছে। পরে নিজের মনকে শক্ত করে আবার নতুন করে প্রেমে জড়ায়। ওটা ঠিক প্রেম কিনা তা অবশ্য বলা ভার। কারণ, সে প্রেমিকার প্রতি শেষ পর্যন্ত ওর কোনো টান লক্ষ করা যায় নি। মুরাদকে বিয়ে করতে চেয়েছিল সে ডিভোর্সী নারী। কিন্তু মুরাদ কথা দিয়েও শেষ পর্যন্ত কথা রাখেনি। কেন রাখেনি সেটা ওই ভালো জানে। তবে ও ওর দুর্বলতার কথা কাউকে বুঝতে দেয় না। পাছে সবাই ওকে বিদ্রুপ করে! তবে, জীবনের ওই প্রথম ধাক্কাটা ওর সামলে নিতে কষ্ট হয়েছে খুব।

এটা সত্য নাবিলা যে অভিযোগে ওকে ত্যাগ করেছে তা সংশোধনের কোনোপ্রয়াসই ওর মধ্যে নেই। ওর সংকীর্ণতা, সন্দেহ প্রবণতা, খুঁত খুঁতে স্বভাব এখনও ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে। যে কারণে চেনাজানা অনেকেই ওকে অপছন্দ করে। ও অন্তর্মুখী স্বভাবের বলে ওকে সবাই ঠিক বুঝতেও পার না। তবে ও ধ্বংসাত্মক না। মাদকাসক্তও না। নিজের কাজ নিয়েই পড়ে থাকে। অফিস বাসা, বাসা অফিস। তবে মাঝে মাঝে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও বাংলা একাডেমীতে গিয়ে আড্ডা দেয়। ওখানে যাদের কাছে যায় সবারই একটা পরিচিতি আছে। ও যদি তাদের সঙ্গ পেয়ে আনন্দবোধ করে ক্ষতি কী? ওর লেখার হাত ভালো না। সাহিত্যজ্ঞান তো একেবারে নেই। তবে রাজনৈতিক জ্ঞান কিছুটা আছে। যদিও প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে ওর কোন যোগ নেই এখন। মুরাদের নিজের ঠিক আলো নেই তবে আলোকিত মানুষের সংস্রব পছন্দ করে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ওরা।

শিক্ষার প্রতি ওদের পরিবারের একটা দুর্বলতা আছে। ওর স্কুল শিক্ষক দাদা সে ব্রিটিশ আমলেই তার চার সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, নিজে হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন বলেই এই সচেতনতা তাঁর। বড় ছেলে মফিজ উদ্দিন এন্ট্রাস পাস করে সরকারি চাকরিতে ঢুকেছে। দেশ স্বাধীনের পর এজি অফিসের সিনিয়ির ক্লার্ক হিসেবে অবসর নিয়েছে। তার মেঝো ছেলে আমীর উদ্দিন আইন জীবী হিসেবে জেলা শহরে আইন ব্যবসা করতেন। বড়-মেঝো দু’জনেই এখন পরপারে। সেঝো ছেলে ফেনী সরকারি কলেজের অধ্যাপনা শেষে অবসর ভোগ করছেন। একমাত্র মেয়েকেও আইএ পাশ করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন কাস্টম ইন্সপেক্টরের সঙ্গে। তারা চাটগা সেটেল। তাদের দু’সন্তানই পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছে।

মুরাদ এর আব্বা মফিজউদ্দিন সাহেবও তার সন্তানের শিক্ষিত করে তুলেছেন মুরাদ ফিন্যান্সে এমএ করেছে, ওর বড় ভাই মোহনও লাইব্রেরি সাইন্সে এমএ করে গণগ্রন্থাগারে পরিচালক হিসেবে কাজ করছে। মেঝো ভাই রাজন মেনেজম্যান্টে এমএ করে সিনিয়র অফিসার হিসেবে চাকরি করছে ব্যাংকে। সবার ছোট বোন বন্যা অনার্স পড়ার সময়ই ওর সহপাঠীকে বিয়ে করে এখন ঘর-সংসার করছে। স্বামী সন্তান নিয়ে ও থাকে নারায়ণগঞ্জে। ওর স্বামী মাহফুজ পৈত্রিক সূত্রে সুতার ব্যাবসায়ী। মুরাদের পরিবারের সবাই বলাচলে সংসারী। শুধু মুরাদই সংসার বিমুখ। এখনও এই পঞ্চাশ উত্তীর্ণ জীবনেও; কতজন ওকে বুঝিয়েছে এভাবে আর কত দিন একা থাকবি, এবার সংসারী হ, বিয়ে কর। কে শোনে কার কথা। ওকে বসে আনতে না পেরে অনেকইে আড়ালে বলাবলি করছেন, বিয়ে করার মুরাদ আছে যে বিয়ে করবে? এই জামানায় কেউ এভাবে একা থাকে? নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা আছে। তা না হলে…! এতে কোনো ভাবান্তর নেই মুরাদের, ও চলে ওর মতো। তবে ও দারুণ হিসেবি।

পড়ার বিষয়টি ওর দারুণ কাজে লেগেছে। সবকিছুতেই হিসেব কষে। হিসেব না মিললে ও কোনোকাজে আগায় না। ঢাকায় ওদের পরিবারের কারও বাড়ি না থাকলেও ওর একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে। মা এখনও বেঁচে আছেন। তার সঙ্গেই থাকেন মিশন রোডের ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাটটি ওর মা পেয়েছেন পৈত্রিক সূত্রে। ওর দু’ভাই বিয়ে করে যে যার মতো থাকছেন।

আইবুড়ো ছেলে এখনও বিয়ে করেনি। বৃদ্ধা মা কতদিনই বা বাঁচবেন। কোনো দায়িত্ব নেই। এসব কথা ফ্ল্যাটের অন্য বসিন্দারা ওর মাকে বলাবলি করেন। ওর মা দুঃখ পান ছেলেকে বুঝান- মানুষের মুখ তো চেপে রাখা যায় না, বাবা তুই বিয়ে কর। কিন্তু ও আচ্ছা দেখা যাবে বলে মায়ের কথা এড়িয়ে যায়। মার মনেও প্রশ্ন জাগে ওর কী এমন সমস্যা! বয়সতো কম হলো না। আর কবে! মানুষ বাঁচেই বা ক’দিন। মা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলেন, কী যে ওর হলো? ওর জীবনটা কেন এমন হলো? মানুষ চিনতে ভুল করলে এমনই হয়।

কেন যে ছাত্র জীবনে ঐ শয়তান মেয়েটাকে ও বিয়ে করতে গেল? আসলে রাজনীতিতে জরিয়েই ওর সর্বনাশ হলো। তা না হলে এখন বৌ ছেলে মেয়ে নিয়ে আনন্দে থাকত। আমি বোধহয় আর ওর বউ, নাতি-নাতনি চোখে দেখে যেতে পারবো না। শরীরের যা অবস্থা?  ওর বাবা চলে গিয়ে ভালোই করেছেন। ছেলের জন্য দুঃখ করতে হয়না। আমার হয়েছে যত জ্বালা। আপন মনে এসব কথা বলতে বলতে বিছানায় শুয়ে ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে থাকেন। ও লেখাপড়ায় তো একেবারে খারাপ ছিল না। ওর হলো এই অবস্থা? ছেলের ছোট বেলার নানা স্মৃতির কথা  মনে করতে করতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন।

মুরাদ বিকেলে ছাদে গিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের এক বড় ভাইর সঙ্গে গল্প করে তারপর একের পর এক সিগারেট ফুকে ফুকে সন্ধ্যা লগ্নে নিচে নেমে দড়জা খুলে প্রথমে নিজের রুমে ঢুকে মোবাইল আর সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার রেখে মার রুমে আসে। আস্তে বলে আম্মা ঘুমিয়েছেন? ওষুধ খাবেন না? সময় হয়েছে, সাতটা বাজে! আম্মা, ও আম্মা? একটু ঝুঁকে আম্মার মাথায় হাত দিয়ে দেখে কেমন যেন! বুকটা ধক্ করে ওঠে। দ্রুত উপরের ফ্ল্যাটে গিয়ে ডাক্তার ভাবিকে ডেকে আনে। ভাবী কিছুক্ষণ হাতের পালস্ চেপে ধরে বলেন খালাম্মা নেই। এক ঘণ্টার বেশি হবে না। মুরাদ আম্মা বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠে। ডাক্তার ভাবী ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। মুহূর্তে ফ্ল্যাটে জানাজানি হয়ে যায়। নিকটস্থ সবাই ওদের ফ্ল্যাটে ছুটে আসে।

এ ভবনে খালাম্মাই ছিলেন সবচেয়ে বয়োজেষ্ঠ্য। ছেলে-বুড়ো সবাই ওনাকে শ্রদ্ধা করতেন। কেউ ডাকতো দাদু, কেউ নানু, কেউ খালাম্মা, কেউ চাচি। আজ তিনি চলে গেলেন! সবার মন বিষণ্ন। মুরাদ যেন শরীরে বল পাচ্ছে না। মা হীন এ শূন্য ঘরে মুরাদ একা! এতদিন মা ছিলেন তাই একাকিত্বের যন্ত্রণা অতটা বুঝতে পারেনি। মুরাদের সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। দাঁড়াতে পাড়ছে না। শক্তি, সাহস সব যেন মুহূর্তে লুপ্ত প্রায়।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে