বনানীর এফ আর টাওয়ারের ২৩ তলা পর্যন্ত উঠলেও তার অনুমোদন ১৮ তলা পর্যন্তই ছিল বলে জানিয়েছেন ভবনটির অগ্নিকাণ্ড তদন্তে গঠিত রাজউকের কমিটির এক সদস্য।
তার ভাষ্য অনুযায়ী, বহুতল এই বাণিজ্যিক ভবনের উপরের পাঁচটি তলা অবৈধভাবে তোলা হয়েছিল।
এই ভবনটি নির্মাণকারী রূপায়ন হাউজিং এস্টেট দাবি করেছিল, অনুমতি নিয়েই ভবনটি ২৩ তলা করা হয়েছিল।
কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের এই ভবনের জমির মূল মালিক প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুক। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভবনের অর্ধেকের মালিকানা ছিল রূপায়ন হাউজিং এস্টেট লিমিটেডের হাতে। মূল মালিকরা বিভিন্ন ফ্লোর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।
২০০৫ সালে নির্মিত এই ভবনে গত ২৮ মার্চ অগ্নিকাণ্ড ঘটার পর নানা অনিয়ম বেরিয়ে আসছে, যা তদন্তকারীদের চোখেও ধরা পড়ছে।
রাজউকের তদন্ত দলের সদস্য, বুয়েটের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বৃহস্পতিবার বলেন, রাজউকের যেসব কাগজপত্র তারা দেখেছেন তাতে ১৮ তলা পর্যন্ত অনুমতি থাকার প্রমাণ পেয়েছেন তারা।
তিনি বলেন, এই ভবন নিয়ে রাজউকের কাছে যেসব ডকুমেন্ট আছে, সব আমাদের কাছে নিয়ে এসেছি। তাতে দেখা গেছে বেইজমেন্টে দুই তলা এবং উপরে ১৮ তলার অনুমোদন আছে।
এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, রাজউক, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এছাড়া ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশও আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।
এরমধ্যে রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন) শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে প্রধান করে গঠিত রাজউকের কমিটি প্রথম প্রতিবেদন জমা দিল।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী আবদুল লতিফ হেলালী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ, বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী, অধ্যাপক ইশতিয়াক আহমেদ এবং অধ্যাপক ড. সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ।
এই কমিটির সদস্যরা গত ১ ও ২ এপ্রিল এফআর টাওয়ার ঘুরে দেখেন। অষ্টম, নবম ও দশম তলায় বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে সেসব তলায় নানা পরীক্ষা চালিয়েছেন। এসব কাজে বুয়েট থেকে আনা নানা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে বলেও জানান রাজউকের কর্মকর্তারা।
বৃহস্পতিবার তা রাজউকের চেয়ারম্যানের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কমিটি। পরে এটি গৃহায়ন ও গণপুর্তমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়া হবে বলে রাজউকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এ প্রতিবেদন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাজউকের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান। তবে বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলতে চাননি।
তদন্ত কমিটির দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই ভবনের পুড়ে যাওয়া সাত, আট ও নয় তলার কলাম, বিমে ফাটল রয়েছে। সেসব তলার ছাদে ফাটল ধরে রড বের হয়ে গেছে।
কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই ভবনের জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি সরু ছিল। এছাড়া সিঁড়িটি সবাই ব্যবহারের উপযোগীও ছিল না। যে কোনো কক্ষ থেকে জরুরি বহির্গমন সিড়িতে যাওয়ার সুযোগ থাকার কথা। কিন্তু ওই ভবনের এই সিঁড়িটি এমন ছিল না।
ভবনটির জরুরি নির্গমনের সিঁড়িটি অনেক জায়গায় কোনো একটা অফিসের ভেতর ঢুকে গেছে বলে দেখতে পেয়েছেন তদন্তকারীরা। ফলে চাইলেও তা অন্য কক্ষের কেউ তা ব্যবহার করতে পারত না।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই ভবনের ‘ফায়ার রেটেড ডোর’ও ছিল না। এ ধরনের দরজা দিয়ে লোকজন সিঁড়িতে যেতে পারবে। কিন্তু সিড়ি থেকে আসতে পারবে না। একইসঙ্গে এটা সিঁড়িতে ধোঁয়া যাওয়া আটকাবে। ফায়ার ডোর না থাকায়ও জরুরি বহির্গমন সিঁড়িটা নিরাপদ ছিল না।
কমিটির একজন সদস্য বলেন, এই দুটো বিষয় ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা হলো ফায়ার এক্সিটে লোকজনের একসেস ছিল না। আরেকটা হলো ফায়ার ডোর ছিল না। ফলে ওই ভবনের ম্যাক্সিমাম লোক ধোঁয়ায় মারা গেছে।
প্রতিবেদনে চারটি সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এগুলো হলো, বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৪৫ দিনের মধ্যে এফআর টাওয়ারের স্ট্রাকচারাল, ফায়ার অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল ডিটেইলড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট বা ডিইএ করতে হবে। ডিটিএ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ আগামী ১৫০ দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে।
প্রথম দুটি সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত ভবনটি ব্যবহার না করতে বলেছে তদন্ত কমিটি।
প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর এফআর টাওয়ার ব্যবহার করা যেতে পারে, বলেন অধ্যাপক মেহেদী আনসারী।
তিনি বলেন, ভবনের কয়েকটি ফ্লোর বেশ ক্ষতিগ্রস্ত। এজন্য আমরা কিছু রিপেয়ার ওয়ার্ক সুপারিশ করেছি তাদেরকে। সেগুলো হলো ইলেকট্রিক্যাল, ফায়ার ফাইটিংয়ের কিছু সমস্যা তো আছেই। এছাড়া ভবনটার স্ট্রাকচারাল কিছু প্রবলেম আছে। এজন্য আমরা পাঁচ মাসের সময় দিয়েছি। ওইগুলো সংস্কার করার পর যদি রাজউক স্যাটিসফায়েড হয় বা আমাদেরকে আবার দেখার সুযোগ দেয়।