নারীর পা ছড়িয়ে বসার পোস্টার নিয়ে পাকিস্তানে বিতর্কের সৃষ্টি

ডেস্ক রিপোর্ট

পাকিস্তানে

রুমিসা লাখানি এবং রাশিদা সাব্বির হোসেন যখন পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে একটি প্ল্যাকার্ড তৈরি করেন তখন তাদের কোন ধারণাই ছিল না যে এটি সারা দেশে কতো বড়ো বিতর্কের সৃষ্টি করতে পারে।

নারী দিবসের একদিন আগে করাচীর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২ বছর বয়সী এই দু’জন শিক্ষার্থী পোস্টার তৈরির একটি সেশনে অংশ নিয়েছিলেন।

তারা এমন একটি পোস্টার বানাতে চেয়েছিলেন যাতে সবার দৃষ্টি পড়ে। এজন্যে নানা আইডিয়া নিয়ে তারা চিন্তাভাবনা করতে শুরু করেন।

সেসময় তাদের পাশের একজন বান্ধবী দুটো পা দু’পাশে ছড়িয়ে বসেছিল। এটা দেখেই তারা একটি পোস্টার বানানোর আইডিয়া পেয়ে যান।

রুমিসা মনে করেন, নারীরা কীভাবে বসবে তা নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা হয়। “আমাদেরকে খুব মার্জিত হতে হবে। আমাদের শরীরের আকার আকৃতি যাতে দেখা না যায় সেজন্যে সচেতন থাকতে হবে। পুরুষরা যখন পা ছড়িয়ে বসে তখন সেদিকে কেউ তাকিয়েও দেখে না।”

কিন্তু রুমিসা যে প্ল্যাকার্ডটি তৈরি করেছেন তাতে দেখা যাচ্ছে সানগ্লাস চোখে দেওয়া এক নারী নিঃসঙ্কোচে পা ছড়িয়ে বসে আছেন।

তার বান্ধবী রাশিদা তখন একটি শ্লোগান লিখে দিয়েছেন। মেয়েদেরকে যে “কীভাবে বসতে হবে, হাঁটতে হবে, কথা বলতে হবে” এসব নিয়ে উপদেশ দেওয়া হয় সেবিষয়েই তিনি লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন।

তারা তখন একটি শ্লোগানের ব্যাপারে একমত হয়ে লিখেন: “এই আমি ঠিকমতো বসেছি।”

হাবিব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দুজনের প্রথম দেখা হয়েছিল। তারপর একসময় তারা ভাল বন্ধু হয়ে যান। নিজেদের জীবনের সব অভিজ্ঞতা থেকে নারী অধিকারের ব্যাপারে তাদের মধ্যে একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছিল।

রুমিসা বলেন, তাকে প্রতিদিনই বিয়ে করার কথা শুনতে হয়। এজন্যে তাকে পরিবার থেকে চাপও দেওয়া হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত যে তিনি অবিবাহিত থাকতে পেরেছেন, সেটা তার কাছে “একটা ব্যক্তিগত বিজয়ের” মতো মনে হয়।

রাশিদা বলেছেন, রাস্তায় তাকে প্রতিদিনই নানা ধরনের হেনস্থার শিকার হতে হয়। এজন্যে তারা দুজনেই ‘আওরাত’ বা নারী সমাবেশে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

“চারদিকে এতো নারী তাদের অধিকারের জন্যে চিৎকার করছেন- এটা ছিল একটা দারুণ অভিজ্ঞতা। আমার ধারণা যারাই সেখানে অংশ নিয়েছিলেন তারা তখন নারীর শক্তি সম্পর্কে কিছুটা হলেও অনুভব করতে পেরেছিলেন,” বলেন রুমিসা।

পাকিস্তানে এর আগেও নারীরা এরকম বড় বড় সমাবেশে অংশ নিয়েছেন। বিভিন্ন দেশে নারী ও পুরুষের সমতা কতোখানি এবিষয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ১৪৯টি দেশের যে তালিকা তৈরি করেছিল তাতে পাকিস্তানের অবস্থান ছিল একেবারে নিচের দিক থেকে দুই নম্বরে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ইয়েমেনে।

পাকিস্তানে নারীদের পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়া, জোরপূর্বক বিবাহ, যৌন নির্যাতন এসব খুব সাধারণ ঘটনা। এমনকি পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে নারীদেরকে হত্যা করার খবরও মাঝে মাঝেই সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

নারীদের ওই সমাবেশে আরো অনেকেই নানা ধরনের প্ল্যাকার্ড নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু রক্ষণশীল এই দেশটিতে রুমিসা ও রাশিদার তৈরি পোস্টারটি ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

সমাবেশ আয়োজনকারীদের একজন মনিজা বলছেন, “নারীদের শরীরকে যৌনতা হিসেবে দেখা হয়। বলা হয় যে নারীদেরকে শরীর ঢেকে রাখতে হবে এবং তারা ঘরের বাইরে যাবে না। আমরা এর প্রতিবাদ করছি।”

রুমিসা মনে করেন সেদিন যে সাড়ে সাত হাজার নারী জড়ো হয়েছিল সেটা রক্ষণশীল পুরুষদের ভাবিয়েছে। অনেকেই হয়তো ব্যাপারটা ঠিকমতো নেয়নি যে নারীরা এভাবে চিৎকার করছে। “অনেকে মনে করে এটা ইসলামের বিরোধী। কিন্তু আমরা সেটাকে এভাবে দেখি না। আমার ধারণা ইসলামে নারীকে যথেষ্ট মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।”

ওদের তৈরি প্ল্যাকার্ডের ছবিটি ইন্টারনেটে পোস্ট করা হলে সোশাল মিডিয়াতে সেটি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এনিয়ে তখন প্রচুর আলোচনা শুরু হয়ে যায়।

একজন ফেসবুকে লিখেছেন, “আমি আমার মেয়ের জন্যে এধরনের সমাজ চাই না।” আরেকজন লিখেছেন, “আমিও একজন নারী। কিন্তু এই ছবিটার ব্যাপারে খুব একটা স্বস্তি বোধ করছি না।” আরেকজন লিখেছেন, “এটা নারী দিবস, দুশ্চরিত্রাদের দিবস নয়।”

রুমিসার পরিচিত অনেকে ব্যক্তিগতভাবে তাকে বার্তাও পাঠিয়েছেন। তারা বলেছেন, “আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না তোমার মতো কেউ একজন এটা করেছে। তুমি এমন একটি ভদ্র পরিবারের মেয়ে।”

তার পরিবারের কোন কোন সদস্য তার বাবা মাকেও বলেছেন, তাকে যেন আর এধরনের সমাবেশে যেতে দেওয়া না হয়।

কিন্তু সামাজিক এই চাপের পরেও রুমিসার পিতামাতা তাদের মেয়ের সিদ্ধান্তের সাথে একমত।

ওই সমাবেশে আরেকটি প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল- “আমার শরীর, আমার সিদ্ধান্ত।”

পাকিস্তানের একটি টিভি চ্যানেলের খবর অনুসারে, করাচীর একজন ধর্মীয় নেতা এই বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করে বলেছিলেন, “আমার শরীর আমার সিদ্ধান্ত.. তাহলে পুরুষের শরীর পুরুষের সিদ্ধান্ত….তারা যার উপরেই চায় তার উপরেই উঠে যেতে পারে।”

পরে অনেকে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ করেছেন।

নারীদের এই সমাবেশে পাকিস্তানে নারীবাদী আন্দোলনের মধ্যেও বিভেদ সৃষ্টি করেছে।

রুমিসা বলেন, “অনেকে বলছেন এসব কোন বিষয় না। নারীদের এরকম আচরণ করা উচিত নয়। আমার অনেক নারীবাদী বান্ধবীও মনে করে যে এই পোস্টারটা অপ্রয়োজনীয়।”

তারা মনে করেন যে এই পোস্টারের মাধ্যমে পাকিস্তানের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের প্রতি অসম্মান দেখানো হয়েছে।

একজন বলেছেন, “যারা মনে করে এরকম পোস্টারের মাধ্যমে নারীর অধিকার আদায় করা যাবে তারা বিভ্রান্ত জিহাদিদের মতো, যারা মনে করে নিরীহ লোকজনকে হত্যা করে বেহেশতে যাওয়া যায়।”

এই বিতর্কের পরেও রুমিসা মনে করেন তিনি ঠিক পোস্টারটিই বানিয়েছেন। এটা নিয়ে তার কোন দুঃখ নেই। আমি খুশি যে এটা এতো মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে।”

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে