ফেনীতে মাদ্রাসাছাত্রী হত্যা চেষ্টার ঘটনা ধামাচাপা দিতে বিশেষ মহলের চাপ

বিশেষ প্রতিনিধি

দগ্ধ নুসরাত জাহান
দগ্ধ নুসরাত জাহান। ছবি : সংগৃহিত


“আগুন দেওয়া সেই দুর্বৃত্তরা পুলিশ-দারোয়ানকে এড়িয়ে কিভাবে প্রবেশপথ দিয়ে বের হয়ে গেল, সেটাই অবাক হওয়ার বিষয়।”

মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টার ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে একটি প্রভাবশালী মহল চাপ দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সোনাগাজী থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে এ কথা বলেন।

তিনি বলেন, ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে প্রভাবশালী একটি মহল চাপ সৃষ্টি করছে। ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরো বলেন, মাদ্রাসার একটি মাত্র প্রবেশপথ। ঘটনার দিন গেইটে দারোয়ান ছিল, পুলিশ ছিল, পরীক্ষা কেন্দ্রে বহিরাগত কোনো লোকই ছিল না। নুসরাত জাহানের গায়ে কে বা কারা আগুন লাগিয়েছে, তার চাইতে বড় কথা হলো, আগুন দেওয়া সেই দুর্বৃত্তরা পুলিশ-দারোয়ানকে এড়িয়ে কিভাবে প্রবেশপথ দিয়ে বের হয়ে গেল, সেটাই অবাক হওয়ার বিষয়।

universel cardiac hospital

ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করায় নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। নুসরাতকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসা হয়েছে।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, নুসরাতের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। তার শরীরের ৭৫ শতাংশ পুড়ে গেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে দগ্ধ নুসরাতকে ভর্তি করার পর ওই ছাত্রীর একটি অডিও রেকর্ড সাংবাদিকদের হাতে এসেছে।

রেকর্ডে ওই ছাত্রী বলেন, সকালে আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষায় অংশ নিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে যান তিনি। মাদ্রাসায় পৌঁছলে এক ছাত্রী তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদের উপর কেউ মারছে বলে ডেকে নেয়। সেখানে আরও চার-পাঁচজন মুখোশধারী ছাত্রী ছিলেন। তারা বলেন, প্রিন্সিপালের উপর যে অভিযোগ করেছিস তা মিথ্যা, বল। আমি বলি না, আমি যা বলেছি সব সত্যি। তারা বলে, তোকে এখনই মেরে ফেলবো। আমরা তোর সব খবর নিছি। তোর প্রেম সম্পর্কিত সব তথ্য আমাদের কাছে আছে। আমি বলি, আমি সব সত্য বলেছি। আমি শিক্ষকদের সম্মান করি, কিন্তু যে শিক্ষক আমার গায়ে হাত দিছে আমি তার প্রতিবাদ করেছি। সঙ্গে সঙ্গে তারা আমার হাত-পা চেপে ধরে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।

এই ভবনেই নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়া হয়। ছবি : সংগৃহিত

এলাকাবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এই ঘটনার দুই দিন হতে চললেও পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। তারা গেইটের দারোয়ান মো. মোস্তফা, যার বাম হাত পুড়ে গেছে এবং পুলিশ কনস্টেবল মো. রাসেল, যার ডান হাত পুড়েছে ও অফিস দফতরী আবুল কাশেমের ছেলে আবু ইউসুফকে জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা বলছেন। এলাকাবাসী মনে করছেন, এতে ঘটনার অনেক সত্যতা বের হয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

নুসরাত জাহানের বান্ধবী আলীম ছাত্রী নিশাত সাংবাদিকদের বলেন, আমার নাম বলে যারা নুসরাত জাহান রাফীকে পরীক্ষার হল থেকে বের করে এনেছে, তাদেরকে গ্রেফতারের দাবি জানাচ্ছি।

নুসরাতের আরেক বান্ধবী আলীম পরীক্ষার্থী নাসরিন সুলতানা ফুর্তি বলেন, অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজউদ্দৌলা একজন লম্পট প্রকৃতির লোক। নুসরাতের গায়ে হাত দেওয়ার ঘটনায় তিনি নিজেও অধ্যক্ষের কাছে প্রতিবাদ করেছিলেন।

এদিকে বেলা ১১টায় এডিশনাল ডিআইজি মোহাম্মদ আবুল ফয়েজ সোনাগাজী থানায় নুসরাতের সহপাঠীদের ডেকে আনেন। সেখানে তাদের কাছ থেকে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চান, এবং প্রত্যেকের বক্তব্য রেকর্ড করেন।

এরপর বিকাল ৫টার দিকে এডিশনাল ডিআইজি সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন।

তিনি জানান, ছাত্রী ও শিক্ষকদের বক্তব্যের পর বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত পেয়েছেন। কিছু ঘটনা আঁচ করতে পেরেছেন, যা তদন্তের স্বার্থে তিনি প্রকাশ করতে রাজী নন। মাদ্রাসায় দলীয় কোন্দল, উপদলীয় কোন্দল যাই থাকুক, তদন্ত শেষে এ ঘটনায় জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানান তিনি।

সোনাগাজীর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার সার্কেল সাইকুল আহমেদ ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, এ ঘটনার সবকিছু সময় মতো বের হয়ে আসবে, তবে একটু ধৈর্য ধরতে হবে।

সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, ইতিপূর্বে ওই ছাত্রীর মা শিরিনা আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী থানায় অভিযোগ করেন। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজউদ্দৌলা সবসময় তার মেয়ে নুসরাত জাহানকে যৌন হয়রানির চেষ্টা করতেন। এ অভিযোগে গত ২৭ মার্চ অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়।


সেই অধ্যক্ষকে বরখাস্ত করা হয়েছে

ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার এক ছাত্রীর গায়ে আগুন ধরিয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় মাদ্রাসাটির অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজউদ্দৌলাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

রোববার  দুপুর ১২টার দিকে ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পিকেএম এনামুল করিমের নেতৃত্বে তার কার্যালয়ে মাদ্রাসার গভর্নিং বডির জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

আরও ৬ সিদ্ধান্ত


মাদ্রাসার গভর্নিং বডির জরুরি সভায় অধ্যক্ষকে সাময়িক বরখাস্ত করা ছাড়াও সভায় আরও ছয়টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সিদ্ধান্তগুলো হলো- ওই ছাত্রীর চিকিৎসা সহযোগিতার জন্য মাদ্রাসা তহবিল এবং শিক্ষকদের পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা অনুদান দেওয়া; অগ্নিসংযোগকারী দুর্বৃত্তদের গ্রেফতার এবং আদালতে সোপর্দ করার জন্য মাদ্রাসার পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করা; মাদ্রাসার নিরাপত্তার জন্য দ্রুত সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা; মাদ্রাসার জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া; আলিম পরীক্ষা চলার সময় শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ রাখা এবং পরীক্ষা কেন্দ্রের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য উপজেলা প্রশাসনকে অনুরোধ করা হবে।


কে এই অধ্যক্ষ?


অভিযুক্ত অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ উদ দৌলা

জানা গেছে, অভিযুক্ত অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ উদ দৌলা জামায়াতের একজন রুকন ছিলেন। ফেনী জেলা জামায়াতের আমীর মো. সামছুদ্দিন বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে গণমাধ্যমকে বলেন, অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ উদ দৌলাকে বিভিন্ন অপকর্মের জন্য ২০১৬ সালে জামায়াত থেকে বহিস্কার করা হয়েছে, তিনি বর্তমানে আমাদের কোনো সদস্য নন।


অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আরও যত অভিযোগ

অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ওই মাদরাসার বিপুল পরিমাণ অর্থ-আত্মসাতের অভিযোগও উঠে তার বিরুদ্ধে। বহু ছাত্রীকে যৌন হয়রানির কেলেঙ্কারিতেও তার নাম জড়িয়েছে। চেক জালিয়াতি, প্রতারণা ও নাশকতার অভিযোগে ৪টি মামলা হলেও মাদরাসায় স্বপদে বহাল ছিলেন সাবেক এই জামায়াত নেতা।

স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর বলেন, অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজদ্দৌলা মাদরাসার এক ছাত্রীকে অন্তসত্তা করে ফেলেন। পরে তিনি স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতার হাত-পা ধরে বেঁচে যান। ২০১৬ সালে একবার চেক জালিয়াতি মামলায় জেল খেটেছেন, এরপরও উক্ত মাদরাসায় অধ্যক্ষ পদে বহাল ছিলেন।

তার বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতি, প্রতারণা, নাশকতা ও যৌনহয়রানিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ফেনী ও সোনাগাজী থানায় চারটি মামলা রয়েছে। চেক জালিয়াতির মামলায় ২০১৭ সালেও জেল খেটেছিলেন তিনি।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে