শেয়ারবাজারে পতন ঠেকাতে পারছে না পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বিএসইসির কোনো উদ্যোগই বাজারে পতন ঠেকাতে কার্যকর হচ্ছে না। কিছুদিন পরপর অনিয়ন্ত্রিত উত্থান–পতন বাজার নিয়ন্ত্রণে বিএসইসির ব্যর্থতাকে বারবার সামনে নিয়ে এসেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতার পাশাপাশি সংস্থাটি কারসাজি রোধেও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চরম আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
বাজার–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পতন ঠেকাতে গতকালও বিএসইসির পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ফোন করে শেয়ার কেনার কথা বলা হয়। কিন্তু সেই চেষ্টার কোনো সুফল মেলেনি। কিছুদিন পরপর বাজারের উত্থান–পতনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। মুনাফার আশায় বিনিয়োগ করে বারবার লোকসানের মুখে পড়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাজারবিমুখ হয়ে পড়ছেন।
সাম্প্রতিক বাজার পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছে যে ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করেও লোকসান গুনতে হচ্ছে। এ কারণে বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি লোকসানের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। বাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সাম্প্রতিক টানা দরপতনের কারণে শেয়ারের বিক্রির চাপ অনেক বেশি বেড়ে গেছে। অন্যদিকে আছে চরম ক্রেতাসংকট।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বাজারের বারবার উত্থান–পতনের ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি অনেক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীও বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছেন। এতে তাঁদের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে গেছে। নিয়ন্ত্রণ দুর্বলতার কারণে কিছু কোম্পানির শেয়ারের দামের অস্বাভাবিক উত্থান–পতন ঘটেছে। কিন্তু বিএসইসির দিক থেকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে বাজার আর স্বাভাবিক আচরণ করছে না।
মার্চেন্ট ব্যাংকের ওই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, শেয়ারবাজারে কারসাজির ঘটনা ঘটিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাওয়ার কোনো নজির নিকট অতীতে নেই। কিছু কারসাজির ঘটনায় কারসাজিকারীরা নামমাত্র জরিমানা দিয়ে দায়মুক্তি পেয়েছেন, যা কারসাজিকে আরও বেশি উৎসাহিত করেছে। ফলে সব মিলিয়ে বাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থায় চিড় ধরেছে। বাজারের সাম্প্রতিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে বিএসইসির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁদের কেউই আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার কারণে গতকালও বড় ধরনের দরপতন ঘটেছে বাজারে। এদিন প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫৭ পয়েন্ট বা ১ শতাংশ কমে নেমে এসেছে ৫ হাজার ২৬২ পয়েন্টে। গত ১৯ ডিসেম্বরের পর এটিই ডিএসইএক্স সূচকের সর্বনিম্ন অবস্থান। ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, গত সাত কার্যদিবসে ঢাকার বাজারের প্রধান সূচকটি ২৫০ পয়েন্টের মতো কমে গেছে। সূচকের পাশাপাশি ঢাকার বাজারে লেনদেনেরও বড় ধরনের পতন ঘটেছে। তাতে লেনদেন কমে এক বছর আগের অবস্থায় ফিরে গেছে।
ঢাকার বাজারে গতকাল লেনদেন নেমে এসেছে ২৭৫ কোটি টাকায়, গত বছরের ২৫ মার্চের পর এটিই সর্বনিম্ন লেনদেন। অথচ গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর ২৭ জানুয়ারি ঢাকার বাজারের লেনদেন প্রায় ১২০০ কোটি টাকায় উঠেছিল।
মার্চেন্ট ব্যাংক আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতকাল সূচকের পতনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, স্কয়ার ফার্মা, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, অলিম্পিক ও ব্র্যাক ব্যাংকের মতো মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিগুলোর।
অব্যাহত দরপতনের প্রতিবাদে গতকাল দুপুরেও টানা চার দিনের মতো বিক্ষোভ করেছেন বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে একদল বিনিয়োগকারী।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসইর সাবেক এক পরিচালক বলেন, অর্থনীতিতে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি, যার কারণে বাজার এভাবে তলানিতে নেমে যাবে। আস্থার সংকটও বাজারের পতনের প্রধান কারণ। এ কারণে অর্থমন্ত্রীসহ কারও আশ্বাসই কোনো কাজে আসছে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থাও বাজারের মূল অনিয়মগুলোকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে পারছে না। বিশ্বস্ত একটি সূত্রে জানা গেছে, বাজার–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ থেকে কিছু অনিয়মের বিষয় বিএসইসির কাছে তুলে ধরা হলে সংস্থাটি সেসব বিষয়ে কথা বলতেই নারাজ।
বাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, সেকেন্ডারি বাজারে বিনিয়োগ করে বারবার ক্ষতির মুখে পড়ায় বিনিয়োগকারীদের বড় একটি অংশ সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কোম্পানির প্লেসমেন্টে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তাতে শেয়ারবাজারের বাইরে প্লেসমেন্টের অনানুষ্ঠানিক একটি বাজার গড়ে উঠেছে। সেখানে সেকেন্ডারি বাজারের মতো প্লেসমেন্ট শেয়ারেরও কয়েক দফা হাতবদল ঘটছে।
২০১০ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর পুনর্গঠন করা হয় বিএসইসিকে। বিএসইসি পুনর্গঠিত হলেও বাজারের গুণগত কোনো পরিবর্তন হয়নি, বরং দিনে দিনে বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীর আস্থা যেমন কমেছে, তেমনি বাজারে বেড়েছে মানহীন কোম্পানির সংখ্যা। যার অনেকগুলোর দাম ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে গেছে।
জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, বাজারে বিনিয়োগকারীরা বারবারই আর্থিকভাবে প্রতারিত হচ্ছেন। সাধারণভাবে দেখলেই বোঝা যায় বাজারে কারসাজিকারীরা অনেক বেশি শক্তিশালী। নীতি ধারাবাহিকতার বড় ঘাটতি রয়েছে। আইপিও ব্যবস্থা, লেনদেন—কোনোটিতেই স্বচ্ছতা নেই। এত সমস্যা বাজারে জিইয়ে থাকলে সেই বাজার কখনো স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে না। ২০১০ সালের ধসের পর নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত সাধারণ মানুষ ও বিনিয়োগকারীর মধ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সম্পর্কে ভালো ধারণা তৈরি হয়নি। ফলে বাজারের প্রতি মানুষ আস্থাশীল হতে পারছে না।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আরও বলেন, ‘যেকোনো ধরনের সুশাসনের ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নের চেয়ে বাস্তবায়নটি খুব জরুরি। কিন্তু শেয়ারবাজারে সেখানেই বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। বিভিন্ন সময় আমরা কারসাজির তদন্তে বিভিন্ন কমিটি গঠনের কথা জানতে পারি। কিন্তু সেই তদন্তের বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই জানা যায় না। কতটুকু অপরাধ করে কার কতটুকু শাস্তি হচ্ছে, তা জানা যাচ্ছে না। এ ছাড়া ২০১০ সালের ধসের পর বাজারে এমন কিছু বাজে কোম্পানি এসেছে, যেগুলো বাজারকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মানহীন কোম্পানি বাজারে আনার চেয়ে না আনাই মঙ্গলজনক ছিল।
এদিকে বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারের দরপতনের কারণে গতকাল এক দিনেই ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। এদিন লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৬৬ শতাংশেরই দাম কমেছে।