আনন্দময় শৈশবের প্রথম ধাপ

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

মুহম্মদ জাফর ইকবাল


“তাহলে কেন একটি ছোট শিশুকে প্রতিযোগিতা করে একজন আরেকজনকে হারিয়ে দিতে শেখাব? অবশ্যই প্রতিযোগিতা হবে; কিন্তু সব সময়ই সেটি হবে নিজের সঙ্গে, আগেরবার যেটুকু করেছি এবার তার থেকে একটুখানি ভালো করার চেষ্টা।”

আমাদের জাতীয় সংগীতের একটা লাইন হচ্ছে, ‘মা তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো।’ সত্যি সত্যি কিছু কথা আছে, যেগুলো শুনলে মনে হয় কানের ভেতর সুধা বর্ষণ হচ্ছে। যেদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের বাচ্চাদের জন্য তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকবে না, সেদিন আমার সে রকম মনে হয়েছে। আমাদের শিক্ষানীতিতে আমরা এই প্রস্তাব রেখেছিলাম; কিন্তু কেউ মনে হয় এত দিন সেদিকে ঘুরেও তাকায়নি। কিভাবে কিভাবে এ দেশে সবাই ধরে নিয়েছে, লেখাপড়া মানে হচ্ছে পরীক্ষা। কাজেই পুরো লেখাপড়াটাই হয়ে গেছে পরীক্ষাকেন্দ্রিক। কাজেই পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য দুধের বাচ্চাদের ওপর পর্যন্ত কী ভয়াবহ চাপ! প্রাইভেট ও কোচিংয়ের সে কী রমরমা ব্যবসা। কাজেই প্রধানমন্ত্রী যদি শিক্ষানীতির হারিয়ে যাওয়া একটি প্রস্তাব এবং আমাদের মনের কথাটি বলেন, সেটি আমাদের কানে সুধার মতো লাগতেই পারে।

তবে আমি ভয়াবহভাবে ঘর পোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখতে হয় না—এমনিতেই ভয় পাই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সময় এ দেশের ছেলে-মেয়েদের কী ভয়ংকর এক ধরনের কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হয়, সেটি দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় না। তাই বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ই অবলীলায় অত্যন্ত নিম্নমানের ভর্তি পরীক্ষার নামে এক ধরনের প্রহসন করেই যাচ্ছে, হয়তো তার বিনিময়ে বাড়তি উপার্জন হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চোখে ছাত্র-ছাত্রীদের কষ্টটুকু ধরা পড়ে না; কিন্তু আমাদের মাননীয় রাষ্ট্রপতির চোখে সেটি ঠিকই ধরা পড়েছিল। তিনি ব্যথিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে বলেছিলেন। তাঁর সেই বক্তব্যটিও আমার কানে সুধা বর্ষণ করেছিল। কিন্তু তারপর কয়েক বছর কেটে গেছে, এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। আরেকটি এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে পরীক্ষাটি শেষ হয়ে যাবে এবং কোচিং ব্যবসায়ীরা এই পরীক্ষার্থী ছেলে-মেয়েদের নিয়ে টানাটানি-কাড়াকাড়ি শুরু করে দেবে। অথচ যদি আগে থেকে পরিকল্পনা করা থাকত, তাহলে এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলে একটি দিন ভর্তি পরীক্ষার জন্য আলাদা রুটিন করে রাখা যেত। এইচএসসির অন্যান্য বিষয়ের পরীক্ষার মতোই তারা সেই একই কেন্দ্রে একই রোল নম্বরে পরীক্ষা দিতে পারত। পার্থক্য হতো প্রশ্নপত্রে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মিলে সেই প্রশ্নপত্র করতেন। সেই ভর্তি পরীক্ষার নম্বরটি ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি করতে পারত। যেহেতু মূল এইচএসসি পরীক্ষার শেষে এই পরীক্ষা নেওয়া হতো, তাই ছেলে-মেয়েদের জন্য ব্যাপারটি হতো সবচেয়ে সহজ ও স্বাভাবিক। অবশ্যই এর জন্য আরো কিছু খুঁটিনাটি বিষয় ঠিক করে নিতে হতো; কিন্তু সেটি মোটেও বড় সমস্যা নয়। আমরা এখন এর থেকে শত গুণ বেশি জটিল সমস্যা সমাধান করতে শিখে গেছি। হ্যাঁ, মেনে নিচ্ছি কোচিং ব্যবসায়ীরা মাতম করতে করতে আমাদের অভিশাপ দিত; কিন্তু আমি বুকে থাবা দিয়ে বলতে পারি তাদের অভিশাপ থেকে লাখো গুণ বেশি পেতাম আশীর্বাদ। পরীক্ষার্থী ছেলে-মেয়েদের আশীর্বাদ, তাদের মা-বাবার আশীর্বাদ।

universel cardiac hospital

যা হোক সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি এখনো একটি দিবাস্বপ্নই রয়ে গেছে। এটি পূরণ হওয়ার আগেই তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা তুলে দেওয়ার বিষয়টি এসেছে এবং আমি আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি।

ভর্তির চাপে শিশুরা। ফাইল ছবি

আমি জানি, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা তুলে দেওয়ার ঘোষণাটি শুনে এ দেশের অসংখ্য মা-বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। যেহেতু তাঁরা জানেন, লেখাপড়া মানেই হচ্ছে পরীক্ষা, তাই তাঁরা ধরেই নিয়েছেন পরীক্ষা তুলে দেওয়ার অর্থই হচ্ছে লেখাপড়া তুলে দেওয়া! তাঁরা প্রায় নিশ্চিত হয়ে ভাবছেন এই জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার এবং এখন এ দেশে অশিক্ষিত ও মূর্খ একটি জাতি গড়ে উঠবে! পরীক্ষার ব্যাপারটি নিয়ে যাদের প্রায় মৌলবাদীদের মতো বিশ্বাস, তাদের বিশ্বাস টলানো সম্ভব নয়। কাজেই আমি সেই চেষ্টা করব না। তবে যারা স্বাভাবিক মানুষের মতো চিন্তা করতে পারে, তাদের পরীক্ষা তুলে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করা যেতে পারে।

প্রথমত, বিষয়টি হুট করে নেওয়া সিদ্ধান্ত নয়। এ দেশের শিক্ষানীতি কমিটিতে দেশের অনেক শিক্ষাবিদ ছিলেন, তাঁরা সবাই অনেক চিন্তাভাবনা করে প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর অনেক শিক্ষাবিদ, শিক্ষা গবেষক লেখালেখি করেছেন এবং তাঁরা সবাই বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন। এ দেশে বেশ কিছু শিশুবান্ধব স্কুল আছে, সেই স্কুলগুলোতে অনেক ভালো লেখাপড়া হয় এবং তারা অনেক দিন থেকেই ছোট ক্লাসগুলো থেকে পরীক্ষা তুলে দিয়েছে, সে জন্য লেখাপড়ার কোনো ক্ষতি হয়নি। বাচ্চাগুলো এক ধরনের আনন্দ নিয়ে নিজের মতো করে লেখাপড়া করে।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি ঘোষণা এসেছিল। তারা বলেছিল ছাত্র-ছাত্রীদের কিভাবে মূল্যায়ন করা হবে, সেটি ঠিক করার পর পরীক্ষা তুলে দেওয়া হবে। ঘোষণাটি পড়ে আমি যথেষ্ট দুর্ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলাম। ‘মূল্যায়ন’ মানে কি আরেক ধরনের পরীক্ষা? পরীক্ষা শব্দটি না বলে ‘মূল্যায়ন’ শব্দটি ব্যবহার করে আবার নতুন করে বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের ওপর যন্ত্রণা চাপিয়ে দেওয়া হবে? মূল্যায়নের জন্য প্রাইভেট আর কোচিং শুরু হবে? মা-বাবা ভালো মূল্যায়নের জন্য ছেলে-মেয়েদের ওপর চাপ দেওয়া শুরু করবেন? মূল্যায়নের জন্য গাইড বই বের হয়ে যাবে?

আমার ধারণা, ব্যাপারটি আরো অনেক সহজভাবে দেখা সম্ভব। আমরা ধরে নিই, ছেলে-মেয়েদের আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু হবে চতুর্থ শ্রেণি থেকে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত আমরা ছেলে-মেয়েদের প্রস্তুত করব, যেন তারা চতুর্থ শ্রেণি থেকে ঠিকভাবে লেখাপড়া শুরু করতে পারে।

ঠিকভাবে লেখাপড়া শুরু করার জন্য কী ধরনের প্রস্তুতি দরকার, সেটিও আমরা আলোচনা করতে পারি। একেবারে কমনসেন্স থেকে আমরা বলতে পারি—

ক. ছেলে-মেয়েদের স্বচ্ছন্দে বাংলা পড়া শিখে যেতে হবে। তারা যেন যেকোনো বাংলা বই পড়তে পারে।

খ. ছেলে-মেয়েদের বাংলা লেখা শিখে যেতে হবে। হাতের লেখা দেখতে খুব ভালো না হতে পারে, বানান সব সময় শুদ্ধ না হতে পারে; কিন্তু যা ইচ্ছা হয় সেটি লিখতে যেন সমস্যা না হয়। গ. ছেলে-মেয়েদের দুটি সংখ্যা যোগ-বিয়োগ এবং গুণ করা ভালোভাবে শিখে যেতে হবে। ছোটখাটো ভাগ করা শিখতে হবে। তবে যন্ত্রের মতো যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ করলে হবে না। এ বিষয়গুলো আসলে কী বোঝায়, সেটি জানতে হবে। ঘ. সহজ ইংরেজি বাক্য শুনে এর অর্থ বোঝা শিখতে হবে। ছোটখাটো বাক্য ইংরেজিতে পড়া এবং লেখা শিখতে হবে।

যদি এই চারটি দক্ষতা মোটামুটি শিখে যায়, তাহলে সেগুলো ব্যবহার করে বাচ্চারা কিছু কবিতা-ছড়া মুখস্থ করে সেগুলো আবৃত্তি করা শিখে যাবে, তাদের বয়সের উপযোগী অনেক বই পড়ে ফেলতে পারবে, ১ থেকে ১০ কিংবা ১২ পর্যন্ত নামতা মুখস্থ করে ফেলতে পারবে (যেন পরে চট করে বড় বড় গুণ-ভাগ করে ফেলতে পারে)। নিজের মতো করে গল্প-কবিতা লিখতে পারবে, চিঠি লিখতে পারবে। তাদের শ্রেণির জন্য নির্ধারিত সমাজ পাঠ বা বিজ্ঞানজাতীয় বইগুলো পড়ে ফেলতে পারবে। ক্লাসে শিক্ষকরা বাচ্চাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতে পারেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার কথা বলতে পারেন, এক ধর্মের ছেলে-মেয়েদের অন্য ধর্মের ছেলে-মেয়েদের সম্মান করা শেখাতে পারেন। পুরুষ ও মহিলারা যে সবাই সব ধরনের কাজ করতে পারে, সেটি মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পারেন। বাচ্চারা ক্লাসে আনন্দ করার জন্য ছবি আঁকতে পারে, হাতের কাজ করতে পারে, গান গাইতে পারে, নাচতে পারে, বিজ্ঞানের ছোটখাটো প্রজেক্ট কিংবা এক্সপেরিমেন্ট করতে পারে। এ বয়সী ছেলে-মেয়েদের শরীরে যে প্রচণ্ড প্রাণশক্তি থাকে, সেই প্রাণশক্তি ব্যবহার করার জন্য ছোটাছুটি খেলতে পারে। এর চেয়ে বেশি আমরা আর কী চাইতে পারি?


“সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি এখনো একটি দিবাস্বপ্নই রয়ে গেছে। এটি পূরণ হওয়ার আগেই তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা তুলে দেওয়ার বিষয়টি এসেছে এবং আমি আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। ”

ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে যখন ‘পরীক্ষা’ শব্দটি বানান পর্যন্ত করতে পারে না, তখন থেকে তাদের পরীক্ষার ভয় দেখিয়ে আমরা লেখাপড়া শেখাতে চেষ্টা করে এসেছি। ফলাফল খুব ভালো হয়নি। যতবার যত ধরনের জরিপ নেওয়া হয়েছে আমরা দেখেছি, তাদের যে বয়সে যেটি শেখা দরকার, তারা সেটি শিখতে পারেনি। যত উঁচু ক্লাসে উঠেছে অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। কাজেই আমাদের নিশ্চিতভাবেই ‘পরীক্ষাপদ্ধতি’ থেকে বের হয়ে আসার সময় এসেছে।

সাধারণভাবে পরীক্ষা বলতে আমরা যে ভয়ংকর বিষয়টি বোঝাই, সেটি অবশ্যই নেওয়া হবে না; কিন্তু এই ছেলে-মেয়েদের কি পুরোপুরি নিজেদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে? তাদের কি কোনো ধরনের মূল্যায়নের প্রয়োজন আছে? ‘মূল্যায়ন’ শব্দটি ব্যবহার করতে আমার ভয় হয়। তবে ছেলে-মেয়েরা যখন যেটি শেখার কথা, সেটি শিখছে কি না, তা অবশ্যই নজরে রাখতে হবে। এটি বোঝার জন্য কোনো একটি পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। শিক্ষকরা যদি টের পান কোনো একটি শিশু পিছিয়ে পড়েছে, তাকে আলাদাভাবে একটু সাহায্য করতে হবে। যদি দেখা যায় কোনো একটি শিশু এগিয়ে গেছে, তার মনের ক্ষুধা মেটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সবাই পাশাপাশি বসে একসঙ্গে শিখবে, কারো সঙ্গে কারো কোনো প্রতিযোগিতা নেই। আমাদের সত্যিকারের জীবনে আমরা যখন সত্যিকারের কাজ করি তখন কিন্তু আমরা কখনোই একজনের সঙ্গে আরেকজন প্রতিযোগিতা করি না। সবাই মিলেমিশে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে কাজ করি। যে যেটি ভালো করতে পারে তাকে সেই কাজটি করতে দিই। তাহলে কেন একটি ছোট শিশুকে প্রতিযোগিতা করে একজন আরেকজনকে হারিয়ে দিতে শেখাব? অবশ্যই প্রতিযোগিতা হবে; কিন্তু সব সময়ই সেটি হবে নিজের সঙ্গে, আগেরবার যেটুকু করেছি এবার তার থেকে একটুখানি ভালো করার চেষ্টা। প্রতিযোগিতায় হেরে গেলে অবশ্য মন খারাপ হয়। শুধু নিজের কাছে হেরে গেলে কখনো মন খারাপ হয় না!

যেহেতু ছোট শিশুদের আনন্দময় একটি শৈশব উপহার দেওয়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, আমরা তাহলে আরো একটি বিষয়ের কথা বলতে পারি। বাচ্চাদের গণিত শেখানোর জন্য আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডের পদ্ধতিটি ব্যবহার করা যায় কি না, সেটি নিয়ে এই মুহূর্তে একটি পাইলট প্রজেক্টের কাজ চলছে। যদি পাইলট প্রজেক্টটি ভালোভাবে শেষ হয়, তাহলে শিশুদের নতুনভাবে এবং যথেষ্ট আনন্দের সঙ্গে গণিতের পরিচয় করানোর একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে। প্রজেক্টের অংশ হিসেবে সারা দেশ থেকে অনেক প্রাইমারি শিক্ষক এসে ট্রেনিং নিয়ে যাচ্ছেন এবং তাঁদের একাধিক গ্রুপের সঙ্গে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তাদের কাছে আমি সম্পূর্ণ নতুন একটি বিষয় জানতে পেরেছি। সেটি হচ্ছে সারা দেশে হুবহু ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য ‘কিন্ডারগার্টেন’ গজিয়ে উঠছে। একটি ছোট বিল্ডিং এবং একটি চটকদার ইংরেজি নাম সম্বল নিয়ে সেই স্কুলগুলো চলছে। আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েদের মা-বাবারা  সরকারি প্রাইমারি স্কুল থেকে সরিয়ে এই কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে ছেলে-মেয়েদের দিতে শুরু করেছেন। এর মূল কারণ সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোতে ক্লাসের সময় অনেক দীর্ঘ এবং মোটেও ছোট শিশুদের বয়সের উপযোগী নয়। এটি একটি খুবই গুরুতর বিষয়। ছোট বাচ্চাদের স্কুলজীবনের শুরুতেই আমরা যদি তাদের দীর্ঘ ক্লান্তিকর এবং আনন্দহীন জীবনে ঠেলে দিই, তাহলে কেমন করে হবে? আমার ধারণা, বিষয়টি নিশ্চয়ই বিবেচনা করা দরকার। বেশি পড়ানোই ভালো পড়ানো নয়। শিক্ষায় বাজেট নেই, স্কুলগুলোতে শিক্ষকের অভাব, তার পরও যদি আমরা শিশুদের অহেতুক পড়াশোনা করানোর নামে ক্লাসে আটকে রাখি, তাহলে কেমন করে হবে?

এ দেশে যখন সৃজনশীল পদ্ধতি শুরু হয়েছিল আমি তখন খুব আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু এখন বেশির ভাগ সময়েই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে হয়। কারণ সৃজনশীল প্রশ্নের গাইড বই বের হয়েছে এবং পরীক্ষায় সেখান থেকে প্রশ্ন আসছে। আগে শিশুরা শুধু বই মুখস্থ করত, এখন তার সঙ্গে সৃজনশীল গাইড বই মুখস্থ করে। এর চেয়ে হৃদয়বিদারক ব্যাপার আর কী হতে পারে? অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ সমস্যার খুব কার্যকর সমাধান আছে এবং আমি নিজের কানে সেই সমাধান নিয়ে আলোচনা হতে শুনেছি; কিন্তু সেটি বাস্তবায়িত হতে দেখছি না।

শুধু যে গাইড বইয়ের প্রশ্ন দিয়ে ছেলে-মেয়েদের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে তা নয়, ছেলে-মেয়েদের বোঝানো হয়েছে পরীক্ষার খাতায় সব কিছু বেশি বেশি করে লিখতে হবে। কাজেই ছেলে-মেয়েদের কাছে পরীক্ষাটি একটি আতঙ্ক। আমি বুঝে পাই না কেন ছাত্র-ছাত্রীদের আমাদের প্রতিপক্ষ মনে করে লেখাপাড়া শেখানোর নামে তাদের ঘায়েল করার চেষ্টা করছি? তাদের দিক থেকে কেন একটিবার পুরো ব্যাপারটি বিবেচনা করি না?

ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পরীক্ষা তুলে দেওয়ার উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে অনেক বড় একটি উদ্যোগ। ভাগ্যিস, এটি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে এসেছে। তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত না হওয়া পর্যন্ত এ দেশে কিছু হয় না। কাজেই আমরা আশা করে আছি আমাদের দেশের শিশুদের শৈশবটি হয়তো প্রথমবারের মতো একটু আনন্দময় হবে।

একটি শিশুকেই যদি আমরা আনন্দময় শৈশব উপহার দিতে না পারি, তাহলে আমাদের বেঁচে থেকে কী লাভ?

লেখক : কথাশিল্পী। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে