দেশভাগ : দাস আর হোসেন পরিবারের বাড়ি বদলের করুণ কাহিনী

ডেস্ক রিপোর্ট

দেশভাগ : সাতচল্লিশে দাস আর হোসেন পরিবারের বাড়ি বদলের করুণ কাহিনী
বামে- পুরান ঢাকার লক্ষী ভিলা এবং ডানে- কলকাতার হোসেন পরিবারের বাড়ি। ছবি : দ্য গার্ডিয়ান

ধর্মের ভিত্তিতে সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় বহু সনাতন ধর্মালম্বীরা যেমন তৎকালীন পূর্ববাংলা ত্যাগ করেছিল, তেমনি পশ্চিমবঙ্গ থেকেও বহু মুসলিম পরিবার এপার বাংলায় এসেছিল। রাজনৈতিক রেষারেষির ফল হিসেবে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজেদের পূর্বপুরুষের ভিটা ছেড়ে চিরদিনের জন্য দেশ ছেড়ে যায়।

তেমনি একজন পুরান ঢাকার ‘লক্ষী ভিলা’র মালিক বি.কে. দাস। তার নাম অনুসারেই ওই রাস্তার নাম করা হয়েছে বি.কে দাস রোড। দেশভাগের সময় প্রাসাদতুল্য বাড়ি ছেড়ে ভারতে চলে যান তিনি। আর এখানেই শুরু হয় দারুণ এক গল্পের।

দেশ ছাড়ার আগে ঢাকায় বি.কে দাস পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাত হয় একটি মুসলিম পরিবারের। ব্যারিস্টার হোসেনের পরিবার নামে পরিচিত ওই মুসলিম পরিবারটিও একই কারণে পশ্চিমবঙ্গ থেকে এপার বাংলায় এসেছিলেন।

এই দুই পরিবার একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। সেই চুক্তি হলো বাড়ি বদলের! হ্যাঁ, ঢাকার বাড়িটি পাবে হোসেন পরিবার এবং তাদের কলকাতার বাড়িটিতে গিয়ে উঠবে বি.কে. দাসের পরিবার। ব্যাস ঝামেলা শেষ। কিন্তু, আসলেই কি তারা একে অপরের বাড়িতে উঠতে পেরেছিলেন?

দেশভাগের সময় শরণার্থীরা এভাবেই নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। ছবি : এপি

দুই বাংলার দুটি বাড়ির অবস্থানই ছিল একেবারে শহরের কেন্দ্রস্থলে। কলকাতার শেক্সস্পিয়ার সরণীতে এখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে হোসেন পরিবারের বাড়ি। তবে ঢাকার কেন্দ্রে থাকা ‘লক্ষী ভিলা’ এখন পরিত্যক্ত। ঢাকার ‘লক্ষী ভিলা’য় হোসেন পরিবার উঠতে পারলেও কলকাতার শেক্সস্পিয়ার সরণীর ওই বাড়িতে উঠতে পারেনি বি.কে. দাসের পরিবার। এর পেছনের কারণ ভারত ও পাকিস্তান সরকারের একটি বহুল বিতর্কিত আইন।

সেই ‘শত্রু সম্পত্তি’ আইনে দেশ ছেড়ে সম্পত্তির পূর্বের মালিকের অধিকার বাতিল করা হয়। এ ধরণের বাড়িগুলোর মালিক হয়ে যায় সরকার। হোসেন পরিবারের উত্তরাধীকার আজমাল হোসেন এখন সুপ্রিম কোর্টের একজন সিনিয়র ব্যারিস্টার।

তার পরিবার ‘লক্ষী ভিলা’য় ছিল ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত। এরপর সেই ভবনটিকে ল’ অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে এর নিচতলা একেবারেই পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। শুধু কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটি।

পুরান ঢাকার সেই লক্ষী ভিলার বর্তমান অবস্থা। ছবি : দ্য গার্ডিয়ান
 

অন্যদিকে দাস পরিবারের বর্তমান উত্তরাধীকারী আনজুম কুমার দাস কলকাতায় থাকেন। তিনি ওই পরিবারের শেষ ব্যক্তি যিনি পূর্ববাংলায় থেকেছেন। তবে বাড়ি বদলে তার কোনো লাভ হয়নি।

আনজুম বলেছেন, আমরা কখনই শেক্সস্পিয়ার সরণীর বাড়িটিতে প্রবেশ করতে পারিনি। শুধু দূর থেকে দেখেছি। আমরা আমাদের বাড়ি বদল করেছিলাম, কিন্তু আমি কিছুই পাইনি। বাড়িটি পেতে আমরা আইনী লড়াই করেছি। একের পর এক কেস ফাইল হয়েছে। কিন্তু কোনো লাভই হয়নি। এটি আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক ঘটনা।

কলকাতায় এখনও দাঁড়িয়ে আছে হোসেন পরিবারের ফেলে আসা আবাস্থল। ছবি : দ্য গার্ডিয়ান

ঐতিহ্য সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ তৈমুর রহমান জানান, এ ধরণের আইনের ফলে পুরান ঢাকার বহু পরিবার সর্বস্ব হারিয়েছে। বাংলাদেশে এই আইনটি বাতিল হলেও এখনও এর সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে অনেকেই। অন্যদিকে সম্প্রতি ৯৪০০ শত্রু সম্পত্তি নিলামে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে ভারত সরকার। শুধু দাস পরিবার আর হোসেন পরিবারই নয়; প্রকাশক কে. আনিসের পরিবার এবং বিখ্যাত কবি বুদ্ধদেব বসুর পরিবারও এভাবে তাদের বাড়ি বদল করেছিলেন। সেইসঙ্গে দাস পরিবারের মতো হৃদয়বিদারক পরিণতিও হয়েছে বহু পরিবারের।

সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে