নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা: বিচারের বদলে ওরা করে উপহাস

ডেস্ক রিপোর্ট

বিচারের বদলে ওরা করে উপহাস
বিচারের বদলে ওরা করে উপহাস। ছবি-সংগৃহিত
ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করা হলেও নুসরাত জাহান রাফিসহ ভুক্তভোগী ছাত্রীদের পাশে দাঁড়াননি পুলিশ কর্মকর্তা ও মাদরাসা পরিচালনা কমিটির কর্তারা। উল্টো ছাত্রীদের হেনস্তা করেছিলেন তাঁরা। অধ্যক্ষ সিরাজের ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’ ওই সব ব্যক্তির অবহেলা ও দুর্ব্যবহারেরও শিকার হয়েছিল প্রতিবাদী শিক্ষার্থী রাফি। জেরা করার নামে তাকে হয়রানি করে মোবাইল ফোনে সেই দৃশ্য ধারণ করেছিলেন সোনাগাজী থানার তখনকার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ভুক্তভোগী রাফির সঙ্গে বিতর্কিত আচরণ নিয়ে চারদিকে নিন্দার ঝড় বইছে।

অনুসন্ধান চালিয়ে জানা যায়, অধ্যক্ষকে অভিযোগ থেকে রেহাই দিতে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চেয়েছিলেন সোনাগাজী থানার ওসি। এ কারণে রাফির শরীরে আগুন দেওয়ার পরও তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। রাফি অভিযোগ করেনি বলে দাবি করলেও ঘটনাস্থল থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে হাসপাতালে নেওয়ার পথে আড়াই মিনিটের বক্তব্যে রাফি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন। হাসপাতালে চিকিৎসকের কাছে দেওয়া শেষ বয়ানের সঙ্গে ওই বক্তব্য মিলে গেছে। প্রথম বয়ানের অডিও স্বজনদের মাধ্যমে পৌঁছেছে গণমাধ্যমের হাতে।

রাফির পরিবারসহ ভুক্তভোগী পরিবারগুলো জানায়, তারা অধ্যক্ষ সিরাজের অপকর্মের ব্যাপারে ওসি ছাড়াও মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি পি কে এম এনামুল করিম, সহসভাপতি রুহুল আমিন, সদস্য মাকসুদ আলম ও জামশেদ আলমের কাছে অভিযোগ করেছিল। মাকসুদ ও জামশেদের কাছে অভিযোগ করলে তাঁরা সিরাজের পক্ষ নিয়ে উল্টো ভুক্তভোগীদের মুখ বন্ধ রাখতে হুমকি দিয়েছিলেন।

universel cardiac hospital

পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পি কে এম এনামুল করিমের কাছে রাফির স্বজনরা পরিস্থিতি জানাতে গেলে মামলা করেছে কেন, সে প্রশ্ন তুলেছিলেন। রাফির সহপাঠী নাসরিন সুলতানা ফুর্তিকে নিপীড়নের ঘটনায় একটি বেনামি অভিযোগ পেলেও তা তদন্ত না করে ধামাচাপা দিয়েছিলেন তিনি। কমিটির সহসভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন আগে থেকে অধ্যক্ষ সিরাজের অপকর্মের খবর জানলেও কোনো পদক্ষেপ নেননি। ২৭ মার্চ রাফিকে নিপীড়নের ঘটনায় এলাকাবাসী মাদরাসা ঘিরে রাখলে পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি সিরাজকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। তবে পরে রাফির নিরাপত্তায় ভূমিকা না রেখে সিরাজের মুক্তির দাবিতে সক্রিয় গ্রুপের পাশে ছিলেন রুহুল। ৬ এপ্রিল রাফিকে পুড়িয়ে দেওয়ার পর কৌশলে অবস্থান বদল করেন তিনি।

গতকাল শুক্রবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) আল-মাহামুদ ফয়জুল কবির সোনাগাজীতে এসে বলেন, ‘২৭ তারিখের ঘটনায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ায় ৬ তারিখের নৃশংস ঘটনাটি ঘটেছে। এমন ঘটনা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘটে। কেউ সাহস করে প্রতিবাদ জানায় না। মামলা করার সাহস পায় না। নুসরাত জাহান রাফি এটা করেছে। এ জন্য আমরা তাকে স্যালুট জানাই।’

রাফিকে ওসির জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, ওসির বিব্রতকর প্রশ্নে রাফি লজ্জায় পড়ে। নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে রাফি কেঁদে বলে, প্রথম বর্ষে তার গায়ে হাত দেয় একজন (নূর উদ্দিন)। অধ্যক্ষ সিরাজ পিয়নের মাধ্যমে তাকে ডাকেন। এরপর শরীরে হাত দেয়। ওসি রাফিকে তখন বলেন, ‘হাত দেওয়ার চেষ্টা করেছে?’ রাফি বলে, ‘না, দিয়েছেন।’ ওসি তখন বলেন, ‘তুমি নিজে গেছো?’

২০১২ সালে ছাগলনাইয়ার কাশিপুর গ্রামের একটি বাড়িতে মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ ভাঙচুর করে বলে অভিযোগ ওঠে। ওই বাড়ি থেকে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া ১৩ বছরের এক শিশুকে আটক করে ১৮ বছর বলে গ্রেপ্তার দেখায়। অভিযোগটি প্রমাণিত হওয়ায় ওসিকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়।

ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ঘটনা জানার পর আমি রাফিকে এনে কী হয়েছে, সে স্টেটমেন্ট নিয়েছি। এখানে খারাপ কিছু বলিনি। আর ভিডিও করে আমি সেটা অনলাইনে দিইনি। রাফির কথা শুনে আমি তো ব্যবস্থা নিয়েছি।’

এদিকে স্থানীয় ভুক্তভোগীরা বলছে, সিরাজকে রক্ষা করতে তাঁর সহযোগীদের পক্ষ নিয়ে বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন দমন করেন ওসি মোয়াজ্জেম। সোনাগাজীতে ১৫ মাস ওসি থাকা অবস্থায় চাঁদাবাজি ও অপকর্মের সিন্ডিকেট তৈরি করেছিলেন তিনি। এর আগে তিনি ফেনীর ছাগলনাইয়া ও সদর থানায় ওসি ছিলেন। ছাগলনাইয়া থানায়ও অভিযোগ ওঠায় তাঁকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। সেখানে সোনার বার উদ্ধার করে গায়েব করে ফেলার অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে।

২০১২ সালে ছাগলনাইয়ার কাশিপুর গ্রামের একটি বাড়িতে মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ ভাঙচুর করে বলে অভিযোগ ওঠে। ওই বাড়ি থেকে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া ১৩ বছরের এক শিশুকে আটক করে ১৮ বছর বলে গ্রেপ্তার দেখায়। অভিযোগটি প্রমাণিত হওয়ায় ওসিকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়।  

কয়েকজন ভুক্তভোগী জানায়, সোনাগাজী শহরে ব্যাটারিচালিত প্রতিটি রিকশার কাছ থেকে মাসে ২০০ টাকা করে চাঁদা নিতেন ওসি মোয়াজ্জেম। দরিদ্র রিকশাচালকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদ করেছিলেন পৌরসভার মেয়র রফিকুল ইসলাম খোকন। তখন ওসি সাফ জানিয়ে দেন, টাকা না দিলে রিকশা চলবে না। রিকশাচালকরা এতে ক্ষুব্ধ হয়ে এক দিন ধর্মঘটও ডেকেছিল। শেষে উপায় না পেয়ে টাকা দিয়েই রিকশা চালু করে তারা।

সোনাগাজীতে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স নিতে সরকারি খাতে ৫০০ টাকা জমা দেওয়ার পরও দুই হাজার ৭০০ টাকা বেশি দেওয়ার নিয়ম চালু করেছিলেন ওসি মোয়াজ্জেম। তিনি নিজেই নিতেন এক হাজার। বাকি টাকা অন্য অফিসাররা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিতেন।

এদিকে মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি পি কে এম এনামুল করিম অধ্যক্ষ সিরাজের অপকর্ম ঢাকা দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ তুলেছেন কয়েকজন অভিভাবক। রাফির ঘটনা নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হলেও তিনি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেননি। রাফির সহপাঠী নাসরিন সুলতানা ফুর্তির হয়রানির ঘটনায় একটি বেনামি অভিযোগ পাওয়ার পর সিরাজের কথায় তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। সিরাজ তখন তিন শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন।

রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, শ্লীলতাহানির চেষ্টার ঘটনার পর রাফিকে নিয়ে তিনি ও তাঁর মা শিরিন আক্তার মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পি কে এম এনামুল করিমের কাছে গিয়েছিলেন। তখন তিনি রাফির সামনেই তার মায়ের সঙ্গে বিরক্তি নিয়ে কথা বলেন। তাঁর কিছু করার নেই বলে জানান। নোমানের ভাষ্য মতে, ‘উনি বলেন, মামলা করে কেন দেখা করতে এসেছেন? আগে আসতেন, আমি একটা কিছু করতে পারতাম।’

২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষায় সোনাগাজীর মোহাম্মদ ছাবের সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে সহকারী কেন্দ্রসচিব জয়নাল আবেদীনকে তুচ্ছ কারণে লাঞ্ছিত করেছিলেন এনামুল। চরসাহাভিকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জয়নালকে মারধরের ওই ঘটনায় ব্যাপক তোলপাড় হয়েছিল। পরে জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে ওই শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চেয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন এনামুল। রাফির শরীরে আগুন দেওয়ার পর তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন, যার প্রধান করা হয়েছে এনামুল করিমকেই। তাই তদন্ত নিয়েও শঙ্কা আছে অনেকের মনে।

পি কে এম এনামুল করিম গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সবার একটা বিষয় ক্লিয়ার হওয়া দরকার যে আমি এখন এডিএম নেই। তবে ওই কর্মকর্তা প্রশিক্ষণে থাকায় এখনো দায়িত্বে আছি। আমি আগের সেই স্বাক্ষরবিহীন অভিযোগটি পাইনি। রাফির ঘটনার পর মামলা হওয়ায় ত্বরিত ব্যবস্থার কিছু ছিল না।’ তিনি আরো বলেন, ‘উপজলা নির্বাচন থাকায় সভা ডেকে অন্য ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। আগুনের ঘটনা না ঘটলেও আমরা অধ্যক্ষকে বরখাস্ত করতাম।’

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে এলাকায় দাপট দেখিয়ে বেড়ান জামশেদ। তিনি জমি বিক্রির ব্যবসা করে মানুষকে হয়রানি করেন বলে অভিযোগ করেন চরগণেশ গ্রামের দুলাল মিয়া। রাফির ঘটনায় তোলপাড় শুরু হলে তিনি প্রকাশ্যে সিরাজের পক্ষ নেন।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে