আবারও ভয়াবহ ধসের পথে শেয়ারবাজার। গত ২৭ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া লাগাতার দরপতন ১২তম সপ্তাহে গড়িয়েছে। স্মরণকালের মধ্যে এত দীর্ঘ দরপতনের রেকর্ড নেই। এর আগে ২০০৮ সালের জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত টানা এগারো সপ্তাহ দরপতন হয়েছিল। দরপতন ভয়াবহ রূপ নিলেও এ পতন রুখতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।
গত সপ্তাহে এ নিয়ে স্টেকহোল্ডার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থায় কয়েক দফায় বৈঠক হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন বাজার-সংশ্নিষ্টদের সহায়তা চান। বিএসইসির চাপে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সহায়তায় সূচক কিছুটা বেড়েছিল। কিন্তু চলতি সপ্তাহে আবারও দরপতনের ধারায় বাজার।
গতকাল মঙ্গলবার কমিশনের চেয়ারম্যান তার কার্যালয়ে সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে কেউই দরপতনের যুক্তিগ্রাহ্য কোনো কারণ জানাতে পারেননি। এ অবস্থায় কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠকটি শেষ হয়।
এমন প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার শেয়ারবাজারে বড় দরপতন হয়েছে। প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইতে ১৭ শতাংশ শেয়ারের দর বৃদ্ধির বিপরীতে ৭৩ শতাংশেরও বেশি শেয়ার দর হারিয়েছে। দ্বিতীয় শেয়ারবাজার সিএসইতে ৬৮ শতাংশ শেয়ারের দরপতন হয়েছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জানুয়ারির পর থেকে চলতি দরপতনে তালিকাভুক্ত ৩৫৩ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৩১৫টিই দর হারিয়েছে। দর হারানো শেয়ারগুলোর গড়ে প্রায় ১৫ শতাংশ দরপতন হয়েছে। এর মধ্যে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দরপতন হয়েছে ১৩৬ কোম্পানির শেয়ারের।
মঙ্গলবার বাজারের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫২৪৮ পয়েন্টে নেমেছে। এর মধ্যে গতকালই সূচকটি ৬০ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ১৪ শতাংশ পতন হয়েছে। যদিও সকাল সাড়ে ১০টায় লেনদেনের শুরু থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত টানা শেয়ারদর কমায় সূচকটি ৮৪ পয়েন্ট হারিয়ে ৫২২৫ পয়েন্টে নেমেছিল। গত বছরে ১৮ ডিসেম্বরের পর সূচকের এ অবস্থান সর্বনিম্ন। ওই দিন সূচকটির সর্বশেষ অবস্থান ছিল ৫২৩৩ পয়েন্ট।
এদিকে, দরপতনের প্রেক্ষাপটে গতকাল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এক ব্যাখ্যায় জানিয়েছে, শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের জন্য টিআইএন গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়নি, এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তও হয়নি। এ নিয়ে বিভ্রান্ত না হতে সকলের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে সংস্থাটি। চলতি দরপতন উস্কে দেওয়ার ক্ষেত্রে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের জন্য টিআইএন গ্রহণ বাধ্যতামূলক হচ্ছে- একাধিক গণমাধ্যমে এমন একটি খবর প্রকাশের পর এনবিআর এমন ব্যাখ্যা দিয়েছে।
একটি সূত্র জানিয়েছে, গত ২৭ জানুয়ারি লেনদেনের শুরুতে ৪২ পয়েন্ট বেড়ে ডিএসইএক্স সূচক ৫৯৯২ পয়েন্টে উঠলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগ সংস্থা আইসিবি আগ্রাসী শেয়ার বিক্রি করলে ওই দিন সার্বিকভাবে শেয়ারবাজারে দরপতন হয়, শুরু হয় সূচকের পতন। প্রতিষ্ঠানটি ওই দিনের পরও শেয়ার বিক্রি করলে সূচকের পতন ত্বরান্বিত হয়, যা এখনও চলছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার একটি সূত্র জানিয়েছে, বাজারে গুজব আছে, অর্থ মন্ত্রণালয় চায় না এ বছর বাজারসূচক (ডিএসইএক্স) ৬০০০ পয়েন্টের ওপরে যাক। বিষয়টি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণেও কিছু বিনিয়োগকারীর মধ্যে ভীতি কাজ করছে। বড় বিনিয়োগকারীদের একটা অংশ নিষ্ফ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। এটিও দরপতনের একটি কারণ হতে পারে।
এদিকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের এক পরিচালক জানান, কয়েক বছর ধরে বাজারে ভালো কোম্পানির আইপিও আসছে না; বরং এমন সব কোম্পানি আসছে, সেগুলোর দরপতন বাজারের স্বাভাবিক গতিধারাকে নষ্ট করছে। কোম্পানিগুলো যে শত শত কোটি টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করেছিল, সেসব শেয়ার বিক্রি করে প্লেসমেন্ট ব্যবসায়ীরা বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়ে গেছেন। নিশ্চিত মুনাফার কারণে ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীরাও প্লেসমেন্ট ব্যবসায় ঢুকে গেছেন। অনেক মার্চেন্ট ব্যাংক ও মিউচুয়াল ফান্ডের বড় বিনিয়োগ যাচ্ছে প্লেসমেন্ট শেয়ার ব্যবসায়। ফলে হঠাৎ করে বাজারে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে।
চলতি এ দরপতনের শেষ কোথায়- এমন প্রশ্নে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনালের অধ্যাপক মোহাম্মদ মূসা বলেন, সমস্যা চিহ্নিত না হলে সমাধান আসবে না। শেয়ারবাজারের এ বিশ্নেষক বলেন, অর্থবাজারের তারল্য সংকট সমাধানে শেয়ারবাজারকে ঢাল করা কোনোভাবেই উচিত হবে না।