একজন তারেক রহমান ও ব্রিটেনের দ্বিমুখী আচরণ

মহসীন হাবিব

মহসীন হাবিব। ফাইল ছবি


“তারেক রহমান কেবল দুর্নীতিবাজ এবং জঙ্গি পৃষ্ঠপোষকই নন, তিনি কুখ্যাত বেয়াদপও। যে ছেলে একাডেমিক শিক্ষা অর্জন করতে পারেননি, তিনি বারবার ইতিহাস বিকৃত করার ধৃষ্ঠতাও দেখিয়েছেন।”

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ দিনের সফরে লন্ডন গিয়েছেন। সেখানে তিনি চোখের চিকিৎসা নেবেন। কিন্তু পাবলিক ফিগার বলে কথা! লন্ডনে বাংলাদেশিরা এবং যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি তারেক রহমান সম্পর্কে বলেছেন, তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আশা করি শিগগির তাকে দেশে ফেরানো যাবে।

আমরা জানি না যে, এই প্রক্রিয়া চালাতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কতটা সক্রিয় আছে এবং কীভাবে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে দেন দরবার করছে। তবে আমরা এটুকু বুঝি যে তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনা এখন একটি অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে ব্রিটেনের সহযোগিতা আমরা আশা করতেই পারি। তবে আপাত দৃষ্টিতে কাজটি সহজ হবে না বলেই মনে হচ্ছে। আবার প্রায়ই মাথায় চিন্তা আসে, ব্রিটেন কি তারেক রহমানকে তুরুপের তাস হিসাবে বেছে নিয়েছে? কী যেন! 

পশ্চিমা দেশগুলো কখনো কখনো মানবতা দেখাতে গিয়ে এমনসব মানুষকে ডিফেন্ড করে, এমন সব আচরণ করে যা মানবতা পরিপন্থী কাজ হয়ে যায়। খোদ ইংল্যান্ডের বিচার ব্যবস্থায় কোনো অপরাধীকে শাস্তি ভোগ না করানোর বিধান তো নেই! বরং তারা শাস্তিযোগ্য প্রতিটি মানুষকে প্রয়োজনে কাঠ-খড় পুড়িয়ে হাতে এনে শাস্তি নিশ্চিত করে থাকে। তাহলে ব্রিটেন কেন  বাংলাদেশের একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে নিজ চরিত্রের বৈপরিত্য প্রকাশ করছে? প্রশ্ন থাকে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ এবং তারেক রহমানের ব্যাপারে ব্রিটেন কেন দুই ধরনের নীতি দেখাচ্ছে? সেটা কি বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ আর যুক্তরাষ্ট্র তাদের শক্তিশালী মিত্র দেশ—সে কারণে? জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে ধরার জন্য বছরের পর বছর একুয়েডরের দূতাবাসের সামনে পুলিশ দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। অবশেষে একুয়েডরের নতুন প্রেসিডেন্ট লেনিন মোরেনোর সঙ্গে লবিং করে তারপর অ্যাসাঞ্জকে জোরপূর্বক বের করে এনে ৩৫০ দিনের সাজা দেওয়া হয়েছে। এরপর তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে বিচারের জন্য হস্তান্তর করা হবে, যাকে ইংরেজিতে বলে এক্সট্রাডিশন।

ব্রিটেন বলে থাকে, যেসব দেশে মৃত্যুদণ্ড আছে সেসব দেশের কোনো আসামীকে তারা ফেরত পাঠায় না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অ্যলাবামা, কেনটাকি, ফ্লোরিডা, সাউথ ক্যারোলিনা, টেনেসি, ভার্জিনিয়া, আরিজোনা, ক্যালিফোর্নিয়া এবং উটাহ’র মতো বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ স্টেটগুলোতে মৃত্যুদণ্ড ব্যবস্থা চালু আছে। কোথাও বৈদ্যুতিক শকের মাধ্যমে,কোথাও লেথাল গ্যাস দিয়ে অথবা গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।  তাহলে অ্যাসাঞ্জকে সেখানে কেন পাঠানোর চিন্তা করছে যুক্তরাজ্য? অ্যাসাঞ্জোর নিজের দেশ অস্ট্রেলিয়ায় মৃত্যুদণ্ড নেই, তাকে কেন অষ্ট্রেলিয়ায় পাঠানোর চিন্তা করা হয় না? অন্যদিকে তারেক রহমানের বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে মৃত্যুদণ্ড হয়নি। তাহলে তাকে বাংলাদেশে পাঠাতে তাদের বাধা কোথায়? তারেক রহমান ব্রিটেনে রয়েছেন ইনডেফিনিট লিভ টু রিমেইন স্ট্যাটাসে। তারেকের শারীরিক অবস্থার বিবেচনায় তাকে যুক্তরাজ্যের ইমিগ্রেশন প্রথমে আড়াই বছর থাকার অনুমতি দেয়। পরে তারেক সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রার্থনা করে।

এখানেও একটি কথা আছে। ব্রিটেনের আইনেই আছে যে একজন রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী বাইরের কোনো দেশের রাজনৈতিক বিষয়ে নাক গলাতে পারবে না। অথচ কে না জানে যে তারেক রহমান ব্রিটেনে অবস্থান করেই বাংলাদেশের রাজনীতিতেই শুধু হস্তক্ষেপ করছেন না, তিনি বিএনপির মতো একটি মৌলবাদের প্লাটফর্মের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন! বিএনপি দলীয় নেতা-কর্মীরা, নির্বাচিত এমপিরা মিডিয়ার সামনে বারবার বলেছেন, তারেক রহমানের নির্দেশেই সংসদে গিয়েছেন নির্বাচিতরা। অর্থাৎ এটি সুস্পষ্ট যে তারেক রহমান লন্ডনে বসে কলকাঠি নাড়ছেন এবং ব্রিটেন সেটা জেনেও তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে! এক্ষেত্রে  রাজনৈতিক আশ্রয়ের শর্তগুলো ব্রিটেন মেনে চলা থেকে সরে থাকছে। ব্রিটেন কি ভুলে গেছে আয়াতুল্লাহ খোমেনীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে কীভাবে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বানিয়েছিল ফ্রান্স? এই ইরান এখন ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের অন্যতম শত্রুরাষ্ট্র!

তারেক-বিএনপি
তারেক রহমান। ছবি : সংগৃহিত

কে এই তারেক, কেনই-বা দেশের সচেতন নাগরিকেরা তাকে ফিরিয়ে এনে শাস্তি কার্যকর করার পক্ষে?

সেনাশাসক এবং পরবর্তী সময়ে জোরপূর্বক গণভোটের নাটকের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা রাষ্ট্রপতি, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দম্পতির জৈষ্ঠ্যপুত্র তারেক রহমান ওরফে পিনু। অবশ্য এই ডাকনামটি তাঁর ঘুঁচে গেছে। তিনি এখন তারেক জিয়া নামেও কুখ্যাত। কারো কারো কাছে নামটি একটি আতঙ্ক। এককালের লেখাপড়া বিমুখ পিনু ২০০৯ সালে মায়ের সুবাদে দলের পঞ্চম কাউন্সিলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন। এর আগে ২০০২ সালে তিনি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মনোনীত হন।

২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে তারেক রহমান ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির অভিযোগে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন। সে সময় সরকারের কোনো দায়িত্বশীল পদে না থেকেও বনানীর হাওয়া ভবন থেকে তারেক ‘ছায়া সরকার’ চালাতেন।

বিএনপি  ক্ষমতা ছাড়ার পর ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে দুর্নীতির অভিযোগে তারেক রহমানকে আটক করা হয়। দুর্নীতি ও অবৈধভাবে বিদেশে অর্থপাচার ও চাঁদাবাজির অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে ১৫টি মামলাও দায়ের করা হয়। সে সময় তাঁকে নির্যাতন করে মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে দেয়া হয়েছে বলে বিএনপি অভিযোগ করে আসছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সব মামলায় জামিন নিয়ে তিনি ‘চিকিৎসার জন্য’ লন্ডনে যান।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর একাধিক মামলায় তাঁর জামিন বাতিল করে পলাতক দেখিয়ে বিচার কাজ শুরু করে। তবে বহুল আলোচিত অর্থপাচার মামলায় নিম্ন আদালতে তারেককে বেকসুর খালাস প্রদান করে।

তারেক রহমান কেবল দুর্নীতিবাজ এবং জঙ্গি পৃষ্ঠপোষকই নন, তিনি কুখ্যাত বেয়াদপও। যে ছেলে একাডেমিক শিক্ষা অর্জন করতে পারেননি, তিনি বারবার ইতিহাস বিকৃত করার ধৃষ্ঠতাও দেখিয়েছেন। লন্ডনে ২০১৪ সালে এক বক্তব্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেন। ওই বছরের ২৬ মার্চ এক অনুষ্ঠানে তিনি দাবি করেন, তাঁর পিতা জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। পরবর্তী সময়ে তিনি তাঁর এই দাবির সপক্ষে বিভিন্ন ‘যুক্তি-তথ্য’ তুলে ধরে একটি বইও সম্পাদনা করেন।

১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত পারিবারিক গণ্ডির বাইরে তারেক রহমানের তেমন কোনো পরিচিত ছিল না। ১৯৮১ সালের মে মাসে সামরিক অভ্যুত্থান চেষ্টায় নিহত হন জিয়াউর রহমান। তারপর থেকেই দ্রুত জিয়ার ইমেজকে কাজে লাগিয়ে শুরু হয় খালেদা জিয়ার রাজনীতি। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার আড়ালেই ছিলেন তারেক। সেসময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনী লড়াইয়ে বিএনপির রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে প্রথমবারের মতো সরাসরি রাজনীতির ময়দানে তারেকের আবির্ভাব ঘটে।

বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহার থেকে শুরু করে কর্মপন্থা সব কিছুই হতে থাকে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনুযায়ী। ওই নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে নতুন ‘জিয়া’ হিসেবে সামনে আসেন তারেক রহমান। এরপরের কয়েক বছরের ইতিহাস বিএনপি ও সরকারের ওপর তারেক ও তার সঙ্গী-সাথীদের আধিপত্য, ক্ষমতার ব্যবহার-অপব্যবহার ও দুর্নীতির ইতিহাস। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর যে লুঠতরাজ, ধর্ষনের ঘটনা ঘটে তার কোনো বিচার না করে ওই সব ক্রিমিনালদের রক্ষা করেন এই তারেক। আজ ব্রিটেন যাকে দুধ কলা দিয়ে পুষে রাখছে!

পিতা বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বগুড়ার গাবতলি উপজেলার কমিটির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে যোগদান করে তারেক রহমান তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেন। অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠনে যোগ দেয়ার পূর্বেই তারেক রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি তার মা খালেদা জিয়ার সহচর হিসেবে সারা দেশের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। ২০০১ সালের নির্বাচনেও তারেক রহমান খালেদা জিয়ার প্রচারণা কার্যক্রমের পাশাপাশি পৃথক পরিকল্পনায় দেশব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণা চালান।

২০০২ সালে তারেক রহমান দলের ‘স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী’ বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। দলের উচ্চ পর্যায়ের পদ লাভের পরপরই তারেক দেশব্যাপী দলের মাঠপর্যায়ের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে ব্যাপক গণসংযোগ শুরু করেন। বিএনপিসহ সহযোগী সংগঠন যেমন জাতীয়তাবাদী যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল আয়োজিত বিভিন্ন মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে তারেক রহমান কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন ও মাঠপর্যায়ের নেতৃবৃন্দের বক্তব্য ও মতামত গ্রহণ করেন এবং অওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ আলো তীব্র করে তুলতে থাকেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশের প্রগতিশীল শক্তির বিরুদ্ধে মৌলবাদী চক্রকে দাঁড় করান। বাংলা ভাইয়ের মতো, শায়খ আব্দুর রহমানের মতো জঙ্গি, অত্যাচারী, খুনীরা তার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল এই সময়েই।

বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যারা ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিরোধীদলের দায়িত্ব পালন করেছিল, দলটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং কিছু সংবাদপত্রের প্রকাশিত খবরে বিভিন্ন সময় তারেকের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ দুর্নীতির অভিযোগ আনে। বিশেষ করে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ তারেক রহমানের কার্যালয় রাজধানীর বনানীতে ‘হাওয়া ভবন’কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অভিযোগ উচ্চারিত হয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! বাংলাদেশ তখন এক মধ্যযুগীয় শাসন কায়েম হয়। হাওয়া ভবনের দোতলায় একটি কক্ষে বসতেন তারেক। এই কার্যালয় খোলার পর রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাবেক রাষ্ট্রদূত, সাংবাদিক নামক ধান্দাবাজরা যাতায়াত শুরু করেন।

এক পর্যায়ে হাওয়া ভবনে টাকার বিনীময়ে পোস্টিং, পদোন্নতির এক বিশাল ব্যবসা গড়ে ওঠে। দেশের বড়বড় টেন্ডার নিয়ন্ত্রিত হয় ওই ভবন থেকে। এমনকি বাড়াবাড়ি করতে করতে আজীবন ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার লালসায় ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট তঃকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনার সভায় গ্রেনের হামলার মনো জঘণ্য অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল এই তারেক রহমানের নেতৃত্বে। অতি ভাগ্যের জোরে সেই হামলা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী। 

বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের বাইরে এক জায়গায় লিখে দেয়া হয়, জিয়া আমাদের নেতা ছিলেন, খালেদা জিয়া আমাদের নেতা ও তারেক রহমান আমাদের ভবিষ্যত নেতা। খালেদা জিয়ার ছেলে হিসেবে দলের মধ্যেও হঠাৎ করেই সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব করা হয় তাকে। সিনিয়র নেতারাও বুঝতে পারেন অভিজ্ঞতার ঝুলি তাদের যতই বড় হোক না কেন রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তারেকের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। তারাও নির্বিবাদে তারেকের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে থাকেন। তার পরিণতি দলটি এখন শতভাগ ভোগ করছে।

এই তারেক রহমানকে ঘিরে একদল লুটেরা দেশ লুট করতে থাকেন। এদের মধ্যে ছিলেন তারেকের দীর্ঘদিনের বন্ধু বিতর্কিত গিয়াসউদ্দিন মামুন, রুহুল কুদ্দুস দুলু, নাদিম মোস্তফা, আমিনুল হক ও আলমগীর কবির, রশীদুজ্জামান মিল্লাত, আশিক রহমান, নুরুদ্দিন অপু, বেলায়েত, বগুড়ার রুম্মনসহ বেশ কয়েকজন। দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে ইসলামি জঙ্গিদের উত্থানে এসব বিতর্কিতদের যোগাযোগ ছিল বলে অভিযোগ আছে।

তারেকের সহযোগীদের দুর্নীতি সেসময় এমনই মাত্রা ছাড়ায় যে উইকিলিকসেও তার কিছু নমুনা দেখা যায়। সেসময় খালেদা জিয়ার মুখ্য সচিব কামালউদ্দিন সিদ্দিকী যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাসের সঙ্গে ২০০৫ সালের ১৩ মার্চ আলাপে বলেছিলেন, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত তারেক রহমানকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করে চলেছেন।’ ২০১১ সালে উইকিলিকসের ফাঁস করা মার্কিন গোপন নথিপত্রে এই বিষয়টি উঠে এসেছিল।

২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর উইকিলিক্স ফাঁস করে, যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস বিশ্বাস করে, ‘গুরুতর রাজনৈতিক দুর্নীতির জন্য দোষী তারেক মার্কিন জাতীয় স্বার্থের জন্য অন্তরায়’।

এরপর যুক্তরাষ্ট্রের আরেক রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ারটি ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর ওয়াশিংটনে পাঠানো এক বার্তায় উল্লেখ করেন যে, তারেক দুর্নীতিগ্রস্ত ও উগ্র এমন একজন যে তার নিজের দেশের জনগণ ও সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। ২০১১ সালের ৩০ আগস্ট উইকিলিকস রাষ্ট্রদূতের পাঠানো এই বার্তাটি ফাঁস করে দেয়। ওই বার্তায় আরও বলা হয়, ‘তারেক রহমান সরকারি তহবিল থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার চুরি করে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যমপন্থী (মডারেট) এই দেশটিতে স্থিতিশীল সরকার ব্যবস্থা বজায় রাখার প্রচেষ্টা নষ্ট করে দিচ্ছে।’

মরিয়ারটি তার মত দিয়ে লিখেছিলেন, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় তারেক রহমানকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া উচিত। এর ছয় মাস পর যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স গীতা পাসির পাঠানো বার্তায় বলা হয়, তারেক রহমানের ভিসা বাতিলের কথা চিন্তা করছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর।

২০১৬ সালে একটি মামলায় তারেকের সাত বছরের কারাদণ্ড ও ২০ কোটি টাকা জরিমানা রায় দেন আদালত। এই মামলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি তার বন্ধু গিয়াসউদ্দিন মামুনকে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার করতে সহায়তা করেছেন।

একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যুৎ স্থাপনের কাজ পাইয়ে দেয়ার বিনিময়ে ঘুষ হিসেবে এই টাকা নিয়েছিলেন মামুন। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই অর্থপাচারের এই ঘটনাটি তদন্ত করে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় গেল বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ১০ বছরের কারাদণ্ড হয় তারেকের।

 বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় একটি জার্মান কোম্পানির সঙ্গে সব চুক্তির মোট অর্থের ২ শতাংশ তিনি ঘুষ হিসেবে নিয়েছিল মামুন।সে টাকা ছিল প্রকৃতপক্ষে তারেকের। মামুন বাহক মাত্র।  একটি চীনা কোম্পানি কাজ পাওয়ার বিনিময়ে সিঙ্গাপুরে সিটি ব্যাংকের একাউন্টের মাধ্যমে তারেককে সাড়ে ৭ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছিল। ক্ষমতার অপব্যবহার করে এ ধরনের অপকর্মের  অভিযোগ তার বিরুদ্ধে অসংখ্য।

শুধু তাই নয়, বিএনপি দিনে দিনে যে জঙ্গী সমর্থক একটি  দল হয়ে ওঠে তার পেছনেও ছিল তারেকের সমর্থন এবং ভূমিকা। বিএনপি দলটিকে কানাডার মত একটি স্বচ্ছ দেশের আদালত সন্ত্রাসী সংগঠন বলে অভিহিত করার পরও ব্রিটেনের এত প্রীতি কী জন্য তা বুঝতে আমাদের খুবই কষ্ট হয়। ব্রিটেন কি ভুলে গেছে তাদের হাই কমিশনার আনোর চৌধুরীর উপর ২০০৪ সালের ২১ মে আক্রমণ করা হয়েছিল তাকে হত্যা করার জন্য? সেই হামলা কারীরা কার পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠেছিল তা কি ব্রিটেনের অজানা? সুতরাং ব্রিটেনের কাছে অনুরোধ একটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব রাখার জন্য একজন ক্রিমিনালকে তুরুপের তাস বানাবেন না।  নিজের দেশের মতই অন্যদেশের বিচারের উপর শ্রদ্ধা রাখা ব্রিটেনের মতো একটি দেশের কর্তব্য বলে আমরা মনে করি। 


লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সিনিয়র সাংবাদিক

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে