ফখরুলকে বাদ রেখে বিএনপির নির্বাচিতদের শপথ গ্রহণের নেপথ্যে

বিশেষ প্রতিনিধি

বিএনপির এমপিদের শপথ গ্রহণ
শপথ নিচ্ছেন বিএনপির চার এমপি। ফাইল ছবি


মির্জা ফখরুল সহসাই লন্ডনে যাচ্ছেন। তিনি তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করবেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলে ভাঙন ঠেকাতে এবং জিয়া পরিবারের কর্তৃত্ব বজায় রাখতেই দলের নির্বাচিত চারজনকে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিতে শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন।

অনুমতি না দিলেও ওই চারজন সংসদে গেলে সেক্ষেত্রে দলের নেতৃত্ব এবং নির্বাচনী প্রতীক হারানোরও এক ধরনের আশঙ্কা ছিল। পাশাপাশি জ্যেষ্ঠ নেতাদের ও তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মনোভাব-অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখাতে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে শপথের বাইরে রাখা হয়েছে।

universel cardiac hospital

সবমিলিয়ে উভয় কূল রক্ষার কৌশল হিসেইে ফখরুলকে বাইরে রেখে অন্যদের সংসদে পাঠিয়েছে বিএনপি।

বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবস্থানগত কারণে অনেককিছুই হজম করতে হয়েছে মির্জা ফখরুলকে। কারাবন্দি দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা, সংসদে যাওয়া না যাওয়ার প্রশ্নে সৃষ্ট মতপার্থক্য, শপথ নিতে নির্বাচিত অন্যদের আগ্রহসহ নানামুখী চাপসহ আগ-পিছ চিন্তা-ভাবনা করেই অনেককিছুই খোলামেলা বলতে পারেননি ফখরুল। ‘দলীয় সিদ্ধান্তে চারজনের শপথ গ্রহণ যেমন একটা কৌশল, তেমনি আমার শপথ না নেওয়াও দলীয় কৌশল’- এই বক্তব্যের মধ্য দিয়েই রাজনীতিতে অন্তর্নিহিত বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বিএনপি মহাসচিব।

সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ না নেওয়ায় এবং মির্জা ফখরুলের আসন (বগুড়া-৬) শূন্য ঘোষণা হওয়ায় তার প্রতি দলের ভেতর-বাইরে এক ধরনের সহানুভূতিও সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে, স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো একজন রাজনীতিবিদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েও দলের প্রতি সম্মান দেখিয়ে শপথ নেননি, অনেকেই তার এই অবস্থান সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করছেন।

বিএনপি নেতাদের, এমনকি বিএনপির বাইরেরও অনেকের মতে- ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই ধারাবাহিকভাবে মির্জা ফখরুল সংসদে না যাওয়ার কথা বলে আসছেন, এমপি হিসেবে শপথ গ্রহণের সাংবিধানিক সময়সীমার শেষ মুহূর্তেও তিনি তার অবস্থান বদল করেননি, এমনকি শেষ পর্যন্ত শপথ না নিয়ে এমপি পদ বিসর্জন দেওয়ার মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক নৈতিকতার পরিচয় দিয়েছেন।

দলের মহাসচিব ফখরুলকে বাইরে রেখে চারজনকে সংসদে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে বিএনপির দায়িত্বশীল অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সংসদ সদস্য পদ টিকিয়ে রাখতে শপথ গ্রহণের শেষদিন সোমবারের আগেরদিন রবিবার পর্যন্ত সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল বিএনপির।

রোববার অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্তই হয়েছিল। রাতে ওই বৈঠক শেষে তারেক রহমান স্কাইপিতে কথা বলেছিলেন দলের নির্বাচিত হারুন অর রশীদ ও উকিল আবদুস সাত্তারের সাথে। সংসদে না যাওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তারেক রহমান বারবার তাদের অনুরোধ করেন।

তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের এমপি হারুন উল্টো সংসদে যাওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। কোনোভাবেই হারুনকে বোঝাতে না পেরে পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য তারেক রহমান সোমবার বিকাল চারটা পর্যন্ত সময় নেন। এর মধ্যেই তারেক রহমানসহ বিএনপির শীর্ষ নেতারা জানতে পারেন, দল অনুমতি না দিলেও চারজন শপথ নিয়ে সংসদে যাবেন।

এমন পরিস্থিতিতে তারেক রহমান দলে নিজের বিশ্বস্তদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। তাতে সবাই মোটামুটি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করেই শপথ গ্রহণের বিষয়ে অনড় চার এমপি। অনুমতি না দিলেও তারা শপথ নিয়ে সংসদে যাবেন। সেক্ষেত্রে দল বহিষ্কার করলে তারা নিজেরা পরে দল ভাঙার উদ্যোগ নিতে পারেন। এমনকি আইনি মারপ্যাচে পড়ে দলের প্রতীক ‘ধানের শীষ’ও হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম হতে পারে। এক্ষেত্রে সংসদে যেতে তাদেরকে অনুমতি দেওয়ার চেয়ে না দেওয়ার ক্ষতি বেশি ও দীর্ঘমেয়াদী।


নেতৃত্ব ধরে রাখতেই শেষ মুহূর্তে অনুমতি

এসব কিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে এবং দলে নিজের নেতৃত্ব ধরে রাখতেই শেষ মুহূর্তে ইচ্ছার বিরুদ্ধেই চারজনকে শপথ গ্রহণের অনুমতি দেন তারেক রহমান।

জানা গেছে, দলীয় নেতৃত্ব ও মির্জা ফখরুলকে রাজি করাতে না পেরে সংসদে যাওয়ার জন্য দলের অপর চারজন নির্বাচিত এমপিকে সংগঠিত করেন হারুন। দলকে চাপে ফেলার কৌশল হিসেবে আগে ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের এমপি জাহিদুর রহমানকে দলীয় সিদ্ধান্ত ভেঙে শপথ নিতে পাঠানো হয়।

এতেও খুব একটা কাজ না হওয়ায় পরে সংসদে যেতে সরাসরি অনঢ় অবস্থান নেন হারুন। এমনকি সোমবার বিকালে শপথ গ্রহণের দিনে সকাল থেকেই বাকি তিনজনকে নিজের বাসায় ডেকে নেন হারুন। সেখান থেকে তার নেতৃত্বে চারজন সংসদ ভবনে স্পিকারের কার্যালয়ে গিয়ে শপথ নেন।

মির্জা ফখরুলকে সংসদের বাইরে রাখার বিষয়ে দুই ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে বিএনপিতে। কারও মতে, নানা কারণেই দলের চার এমপিকে সংসদে পাঠাতে হয়েছে। কিন্তু দলের মহাসচিবও সংসদে গেলে তখন রাজনৈতিক মহলে এটাই প্রতিষ্ঠা পেয়ে যেত যে, আসন যত কমই হোক মহাসচিবসহ বিএনপির সবাই সংসদে গেছেন। তখন একাদশ সংসদ নির্বাচন ও বর্তমান সংসদ নিয়ে সমালোচনা করার ক্ষেত্রে বিএনপির নৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠত।

আবার কারও মতে, ফখরুলকে কৌশলে শপথ নিতে দেওয়া হয়নি। ফখরুলও সংসদে গেলে তিনি দলের সংসদীয় পার্টির প্রধান হতেন, সেক্ষেত্রে দলের ভেতরে দুই ধরনের নেতৃত্ব সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিত। যে সময়ে খালেদা জিয়া কারাগারে, তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারছেন না- এই অবস্থায় সংসদে গিয়ে ফখরুলের ক্ষমতাবান হওয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হচ্ছিল। এসব বিষয় মাথায় রেখেই কৌশলে ফখরুলকে ক্ষমতাহীন করে রাখা হয়েছে।

এদিকে, মির্জা ফখরুল সহসাই লন্ডনে যাচ্ছেন। তিনি তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করবেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছে। জানা গেছে- দলের পাঁচ এমপির সংসদে যোগদানকে কেন্দ্র করে বিএনপির ভেতর-বাইরে উদ্ভুত পরিস্থিতি, ২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রতিক্রিয়া, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ও মুক্তি, দলের সাংগঠনিক অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করবেন মির্জা ফখরুল।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে