আলোকপ্রাপ্তির যুগ ও অভিন্ন আলাদা প্রেম

রাজু আলাউদ্দিন

রাজু আলাউদ্দিন, ন্যানো কাব্যতত্ত্বের জনক, কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। জন্ম ৬ মে ১৯৬৫ সালে শরিয়তপুরে। লেখাপড়া এবং বেড়ে ওঠা ঢাকা শহরেই। কর্মজীবনের শুরু থেকেই সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে জড়িত। মাঝখানে বছর দশেকের জন্যে প্রবাসী হয়েছিলেন ভিন্ন পেশার সূত্রে। এখন আবার ঢাকায়। ইংরেজি এবং স্পানঞল ভাষা থেকে বিস্তর অনুবাদের পাশাপাশি দেশি ও বিদেশি সাহিত্য নিয়ে নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ছাব্বিশ।

জন্মদিন উপলক্ষে বাছাই করা তার তিনটি কবিতা মত ও পথ সাহিত্যে প্রকাশ করা হল।

আলোকপ্রাপ্তির যুগ

চারিদিক যতো বেশি আলোকিত হয়ে ওঠে
অন্ধকার তত বেশি আলোর গভীরে গিয়ে
ঘনীভূত হয়

তাই এতো আলোর বিকাশ
তাই এতো রাত্রি, দেখ,
নিহিত পাতালে বহমান।

তবু জানি, মানুষের সকল উদ্যম
আলোর গরিমা নিয়ে চিরন্তন আঁধারের
পিছে ধেয়ে আসে।

প্রেমের যমজ কবিতা: অভিন্ন আলাদা

প্রথম প্রথম আমি ‘প্রিয়তমা’ বলে তাকে জানিয়েছি আমার আবেগ,
ভালোবাসা ক্রমাগত প্ররোহী পথের মতো বিস্তৃত হতে থাকে বলে,
এখন কী করে আর এক নামে ডাকবো তাকে, বলি ‘তুমি,
তুমি যে শতধা। তুমি অগ্নি, তুমি ঐ নিঃসীম অম্বর, তোমার কথারা সব ভাষাতীত অতিরিক্ত ঢেউ।’

আমার আবেগ তাকে জানিয়েছিপ্রিয়তমাবলে আমি প্রখম প্রথম,
কিন্তু প্রেম বিস্তৃত হতে থাকে প্ররোহী পথের মতো তাই
কী করে ডাকবো তাকে এখন শুধুই এক নামে, বলি,
তুমি যে শতধা। তুমি অগ্নি, তুমি নিঃসীম অম্বর, তোমার কথারা সব ভাষাতীত অতিরিক্ত ঢেউ।

পরিচিত যত নাম, যত বিশেষণ একে একে জড়ো হলো স্বেচ্ছাবিলাসে।
তিনটি ভাষার প্রিয় অপ্রিয় শব্দে ডেকে ডেকে হৃদয়ের সিংহাসনে বসাতে
চেয়েছি আমি তাকে, কিন্তু আমার জানা সকল শব্দের চেয়ে আরও বেশি অতিরিক্ত বলে সে আমার নাগালের বাইরে থেকে যায়।

স্বেচ্ছাবিলাসে ক্রমে জড়ো হলো পরিচিত নাম আর বিশেষণগুলো
তিনটি ভাষার প্রিয় অপ্রিয় শব্দে ডেকে ডেকে
বসাতে চেয়েছি তাকে হৃদয়ের কোমল আসনে। কিন্তু আমার জানা সকল শব্দের চেয়ে অতিরিক্ত বলে সে আমার নাগালের বাইরে থেকে যায়।

তারপর আমি তাকে সীমা আর প্রথা ভেঙে ডেকেছি জননী, কারণ তার মনোজরায়ুতে আমি দেখেছি আমার অঙ্কুর।

তার মনোজরায়ুতে আমার সবুজ অঙ্কুর
জন্ম হয়েছিল বলে আমি তাকে সীমা আর প্রথা ভেঙে ডেকেছি জননী।

তারপর আমি তাকে বলেছি আত্মজা, কারণ আমার প্রেমের ঔরসে তার ভ্রূণ জন্মাতে দেখেছি।

আমি তাকে প্রথা ভেঙে আত্মজাও বলেছি , কারণ আমি জন্মাতে দেখেছি তার ভ্রূণ
আমার প্রেমের ঔরসে

যখন আমার সব শব্দ, অভিধা ও বিশেষণ শেষ হয়ে গেল
তখন সে অসীমের বোধ নিয়ে চলে গেল অন্য এক প্রেমিকের সাথে।।

এইভাবে আমরা পরস্পরকে জন্ম দিয়েছি। কিন্তু আমার দেয়া সব নাম উপচে সে ক্রমাগত বেড়েছিল আমার প্রেমের পলি পেয়ে।
তারপর ধীরে ধীরে আমি সব নাম ছেড়ে এগিয়ে গিয়েছি তার দিকে নৈঃশব্দের বোবা-কৌশলে, তাকে আমি পুরোপুরি হাতে পাব বলে।
তারপর আমি তাকে স্পর্শের আগুন দিয়ে ঝকঝকে করে তুলতে থাকি, বলি, ‘তুমি ভাষার অতীত।’
তারপর আমি তাকে শৃঙ্গারের ঢেউ দিয়ে বানিয়েছি অসীম দরিয়া। বলি তাকে, ‘তোমার দরিয়া-দর্পনে আমার শব্দাতীত অম্বর শীৎকারে প্রস্ফূটিত হয়।


তারপর আমি তাকে বেধেছি আলিঙ্গনে সঙ্গমের তীব্র কামনায়: চর্ব্য, চোষ্য, লেহন ও দংশনে তার দেহ নক্ষত্রের মতো জ্বলে উঠেছিল।
যতসব অভিধায় আমি তাকে ধরতে চেয়েছি, তারচেয়ে আরও বেশি অনুচ্চারণে তাকে পেয়ে গেছি পরিপূর্ণ রূপে।

নিজেকে উপেক্ষা করো না, প্রিয়তমা

মেক্সিকোয় থাকাকালে সুন্দরী এক মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—নিছক আলাপ জমাবার ফিকিরে—কবিতা কি তোমার পছন্দ? সে একেবারে নারীসুলভ সকল কমনীয়তা ঝেড়ে ফেলে অনেকটা রুক্ষভাবেই—যেন ওকে বিষাক্ত কিছু খাওয়ার প্রস্তাব করেছি আর তারই প্রতিক্রিয়ায় বলল, “নাহ, কবিতা আমার একদমই ভালো লাগে না।”

এই মেয়েটির চেয়েও আরেক কাঠি সরেস অন্য এক সুন্দরী মেয়েকেও জিজ্ঞেস করে পেয়েছিলাম অদ্ভুত এক উত্তর। বললাম, “কী, তুমি কি কবিতা পড়ো?” আমার এই প্রশ্নে সে এতই কৌতুক অনুভব করেছিল যে আমি প্রচণ্ড কৌতূহলী হয়ে অপেক্ষা করছিলাম ওর উত্তরের জন্য। মেয়েটি অট্টহাস্যে প্রায় বিস্ফোরিত হওয়ার মতো। ওর হাসির অনুবাদ করে বুঝেছিলাম, “কবিতা? ও আবার কেউ পড়ে নাকি? এত তুচ্ছ জিনিসের কথাও কেউ তুলতে পারে!”

—এই ছিল মূলের ইশারা। ইশারাই আসলে, কারণ হাসি ছাড়া সে আর কিছুই বলে নি। সে অবাক হয়েছিল আমার প্রশ্নের মূর্খতায়। বছর কয়েক পরে লক্ষ করলাম ফেসবুকে তার টাইম লাইনে একের পর এক বিখ্যাত সব কবিদের প্রেমের কবিতার উদ্ধৃতির ধুম। বুঝলাম মেয়েটি প্রেমে পড়েছে। প্রেম ওকে কবিতার কাছে নিয়ে গেছে। প্রেম ওকে মাতাল করে তুলেছে। কিন্তু কিভাবে এই মাতাল অবস্থার অনুভূতিকে সে ব্যক্ত করবে, যেহেতু সে বসবাস করে ভাষার দারিদ্র্যসীমার অতি নিচে?

ও যাকে উপেক্ষা করে এসেছে এত কাল—এখন এই প্রেমের মুহূর্তে—সেই উপেক্ষিতের সাহায্যই ওর দরকার হয়ে পড়েছে সবচেয়ে বেশি। কেননা কবিতা ছাড়া তার এই অনন্য ও অনির্বচনীয় অনুভূতি প্রকাশের আর কোনো উপায় নেই। তার প্রেমিকের কাছে আত্মোন্মোচনের ভাষা তার নেই, ফলে যোগাযোগের সেতুবন্ধন হিশেবে উপেক্ষিত কবিতাই হয়ে ওঠে তার একমাত্র সহায়, পরম আদরণীয়। কোনো নারী যে কারণে প্রসাধনে সুশ্রী হয়ে তারপর অন্যের মুখোমুখি হতে চায়, ঠিক তেমনিভাবে প্রেমিকের কাছে তার অভিব্যক্তির সুশ্রীতার প্রয়োজনে কবিতা নামক প্রসাধন সামগ্রীকে বেছে নেয়।

তবে শুধু প্রেমের জন্য কবিতাকে অল্প কিছুদিনের ‍মুখোশ না করে, বরং, হে নারী, তোমার অমূল্য জীবনেরই মুখ করে তোলো। কবিতা মুখোশ হতে চায় না, সে চায় তুমি ওর মুখপাত্র হয়ে ওঠো। মেয়ে, কবিতা ছাড়া তুমি বাঁচবে কিভাবে, বলো তো। উপেক্ষা নয়, প্রেমিকের মতোই তাকে আলিঙ্গন করো, করো সঙ্গম তার সাথে যখন ইচ্ছে হয়। তুমি হয়ে ওঠো আরও প্রেমময়, কেবল প্রেমিকের কাছেই নয়, অন্য সবার কাছে। এখন তো তুমি ভালো করেই জানো, কবিতা তোমার ইন্দ্রিয়কে করে তোলে তীক্ষ্ণ ও শাণিত, সংবেদনশীল ও সংরক্ত। এমন মুহূর্তে বলো, হে অনুত্তমা, তুমিই কি কবিতা নও? তাহলে কাকে তুমি, না বুঝে, উপেক্ষা করেছিলে? নিজেকে উপেক্ষা করো না, প্রিয়তমা।

অলংকরণ: মামুন হোসাইন ও মাসুক হেলাল

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে