যে ৫ কারণে জিতল লিভারপুল

ক্রীড়া ডেস্ক

লিভারপুল
জোড়া গোলের পর উইনালডামকে নিয়ে সতীর্থদের উল্লাস। ছবি: এএফপি

প্রথম লেগে পাওয়া ৩-০ গোলের জয়টাও যথেষ্ট হলো না বার্সেলোনার জন্য। কাল দ্বিতীয় লেগে উদ্যমী লিভারপুলের কাছে ৪-০ গোলে হেরে আত্মসমর্পণ করল মেসির দল। চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে চলে গেল ইয়ুর্গেন ক্লপের দল।

অবিশ্বাস্য এই জয়ের পেছনে কাজ করেছে বেশ কিছু কারণ। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি নিয়ে একটু আলোচনা করা যেতেই পারে।

বার্সেলোনার দুর্বল রক্ষণভাগ

গত ম্যাচে বার্সার রক্ষণভাগের সঙ্গে এই ম্যাচে তাদের রক্ষণভাগের মধ্যে ছিল বিস্তর ফারাক! অথচ দুই ম্যাচেই খেলেছেন একই চারজন। লিভারপুলের ক্রমাগত ‘প্রেসিং’ এর শিকার হয়ে একের পর এক ভুল করে গেছেন জেরার্ড পিকে, ক্লেমেন্ত লংলে, সার্জি রবার্তো, ও বিশেষ করে জর্ডি আলবা।

ম্যাচের প্রথম মিনিটেই জর্ডি আলবার ভুলের সুযোগ নিয়ে গোল প্রায় করেই ফেলেছিলেন লিভারপুল অধিনায়ক জর্ডান হেন্ডারসন। সে ভুল থেকেও শিক্ষা নেননি আলবা। কিছুক্ষণ পরেই বাঁ প্রান্ত থেকে উড়ে আসা এক বল সামাল না দিতে পেরে সাদিও মানের পায়ে তুলে দেন তিনি। সেই বল হেন্ডারসনের পা ঘুরে চলে আসে স্ট্রাইকার ডিভক অরিগির কাছে। অরিগি গোল করতে ভুল করেননি।

তৃতীয় গোলেও আলবাকে বোকা বানিয়ে ওপরে উঠে গিয়েছিলেন লিভারপুলের ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার আরনল্ড। মাপা ক্রসে জর্জিনিও ভাইনাল্ডামকে একরকম গোল করতে বাধ্যই করেন এই ২০ বছর বয়সী রাইটব্যাক। তৃতীয় গোলে সেই ভাইনাল্ডামেরই বুলেটগতির হেড শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছেন ক্লেমেন্ত লংলে।

পুরো ম্যাচে বেশ কয়েকটা ভালো সেভ করলেও দ্বিতীয় গোলের জন্য দায়ী গোলরক্ষক মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগেন। তাঁর হাতের নিচ দিয়ে দৃষ্টিকটুভাবে বল গলেই গোলটা হয়।

ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার আরনল্ড

গত রাতের আগে এই মৌসুমে সব মিলিয়ে ১৩টি অ্যাসিস্ট ছিল লিভারপুলের তরুণ রাইটব্যাক ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার-আরনল্ডের। এই রাইটব্যাকের সমস্যা একটিই—যে উদ্যমে আক্রমণে উঠে যেতে পারেন, একইভাবে রক্ষণটা করতে পারেন না। আর একজন ডিফেন্ডার হিসেবে তাঁর মূল দায়িত্ব হওয়া উচিত রক্ষণকাজ।

বার্সেলোনার কুতিনহো বা ডেম্বেলেকে আটকানোর জন্য এমন কাউকে লাগবে, যিনি সবার আগে রক্ষণের কথা চিন্তা করেন। এই কারণে প্রথম লেগে আরনল্ডকে বসিয়ে আরেক তরুণ জো গোমেজকে খেলিয়েছিলেন কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। এর কারণ আরনল্ডের চেয়ে গোমেজ অপেক্ষাকৃত রক্ষণাত্মক।

গোমেজ সেদিন মোটামুটি ভালো খেললেও লিভারপুলকে হারের হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি। ফাইনালে ওঠার জন্য দ্বিতীয় লেগে লিভারপুলকে গোল করতেই হতো। তাই এই লেগে গোমেজের চেয়ে আরনল্ডের আক্রমণাত্মক মানসিকতার বেশি দরকার ছিল। তাতে দলের রক্ষণভাগ যদি সামান্য ঝামেলায় পড়ে পড়ুক। অতটুকু ঝুঁকি নেওয়ার জন্য রাজি ছিলেন ক্লপ।

বাজিটা কি অসাধারণভাবেই না কোচকে জিতিয়ে দিলেন আরনল্ড! দ্বিতীয় গোলে তাঁর মাটিঘেঁষা ক্রস আটকানোর সাধ্য ছিল না কোনো বার্সা ডিফেন্ডারের। ভাইনাল্ডামকে শুধু পা ঠেকিয়ে গোল করতে হতো, সে কাজটা বেশ ভালো করেই করেছেন তিনি।

চতুর্থ গোলটার কথা চিন্তা করুন। ফাউল হয়েছে বলে বার্সা খেলোয়াড়েরা ছিলেন দায়সারা মেজাজে। কর্নারের বাঁশি বাজার পরেও তাঁরা ঠিক প্রস্তুত হয়ে উঠতে পারেননি। তাঁদের এই গা-ছাড়া অবস্থার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন আরনল্ড। অপ্রস্তুত বার্সা ডিফেন্সকে বোকা বানিয়ে চুলচেরা ক্রস দেন অরিগির পায়ে। পা ঠেকিয়ে গোল করতে বেলজিয়ান স্ট্রাইকারের মোটেও সমস্যা হয়নি। সামান্য কিছুক্ষণের জন্য বার্সা রক্ষণভাগকে অমনোযোগী দেখে আরনল্ড যেভাবে সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন, অনেক পোড় খাওয়া খেলোয়াড়ও পারেন না!

ক্লপের খেলোয়াড় পরিবর্তন

ক্লপ যে কোচ হিসেবে কতটা উঁচুমানের, সেটা বিভিন্ন ম্যাচের মধ্যে বোঝা যায়। ম্যাচের মধ্যে একদম ঠিক ঠিক কিছু ‘বদল’ আনেন, পরে দেখা যায় সেই বিকল্প খেলোয়াড়ই লিভারপুলকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছেন। এই তো কিছু দিন আগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে এক লিগ ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে জের্দান শাকিরিকে নামিয়েছিলেন তিনি, সেই শাকিরি দুই গোল করে দলকে ম্যাচ জেতান।

এভারটনের বিপক্ষে ম্যাচের শেষ দিকে অরিগিকে নামান, সেই অরিগিকে গোল করে দলকে এনে দেন তিন পয়েন্ট। গত দিনও নিউক্যাসলের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে অরিগিকে এনেছিলেন, সেই অরিগিই জয়সূচক গোল এনে দেন।

সাউদাম্পটনের বিপক্ষে দ্বিতীয়ার্ধে জর্ডান হেন্ডারসনকে নামানোর পর থেকেই লিভারপুল ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। গতকালও এমন এক অসাধারণ ‘সাবস্টিটিউশন’ ক্লপ করেছেন। দ্বিতীয়ার্ধে লেফটব্যাক অ্যান্ড্রু রবার্টসনের জায়গায় মিডফিল্ডার জর্জিনিও ভাইনাল্ডামকে নামিয়েছিলেন তিনি। তিন মিনিটের মধ্যে দুই গোল করে অ্যানফিল্ডকে আনন্দের সাগরে ভাসান ভাইনাল্ডাম।

ফাবিনহো তাভারেস

মেসিকে নিয়ে একটা কথা খুব বেশি প্রচলিত। কোনো একজন খেলোয়াড়কে দিয়ে মেসিকে আটকে রাখা সম্ভব নয়। মেসিকে আটকানোর জন্য একাধিক খেলোয়াড় লাগবেই। কিছুদিন আগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও চেলসির সাবেক কোচ হোসে মরিনহোও এই কথা বলেছিলেন।

কোয়ার্টার ফাইনালে মেসিকে আটকানোর দায়িত্বে ছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার ফ্রেড। মেসিকে আটকে রাখতে পারেননি তিনি। তাই সবাই ভেবেছিলেন সেমিফাইনালে মেসির জন্য দুই-তিনজন খেলোয়াড় বরাদ্দ রাখবেন ক্লপ। কিন্তু না, নিজের দলের ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ফাবিনহো তাভারেসের প্রতি তার প্রত্যাশা ছিল আকাশছোঁয়া। দুই লেগ মিলিয়ে কোচকে হতাশ করেননি ফাবিনহো।

প্রথম লেগেও মেসিকে এক রকম বোতলবন্দী করে রেখেছিলেন। প্রথম লেগে একটুর জন্য মেসিকে নজর ছাড়া করেই তো দলের বিপদ ডেকেছিলেন তিনি। আর মেসি এমনই এক খেলোয়াড়, এক সেকেন্ড মেসিকে ফাঁকা ছেড়ে দিলেই গোল দিয়ে বসবে সে। তাই দ্বিতীয় লেগে মেসিকে কোনোভাবেই চোখের আড়াল হতে দেবেন না, এমনটাই পণ করেছিলেন এই ব্রাজিল তারকা।

ফলাফল, গোটা ম্যাচে নিষ্প্রভ থাকলেন মেসি। ম্যাচের শুরুতে একটা হলুদ কার্ড দেখলেও গোটা ম্যাচে ফাবিনহোর খেলায় প্রভাব পড়েনি সেটার।

ভালভার্দের নেতিবাচক মানসিকতা

গতবার চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে ৪-১ গোলে জিতে আসার পরেও রোমাকে হারিয়ে সেমিতে উঠতে পারেনি বার্সা। আর এর পেছনে অনুঘটক ছিল বার্সা কোচ আর্নেস্তো ভালভার্দের রক্ষণাত্মক মানসিকতা। গতকালও সেটাই হয়েছে। তিন গোলে এগিয়ে থেকেও লিভারপুলের মাঠে আক্রমণাত্মক কৌশলে দলকে মাঠে নামাননি। দলে গতিময় কোনো খেলোয়াড় রাখেননি। নেলসন সেমেদোর জায়গায় সার্জি রবার্তোকে নামিয়েছেন রাইটব্যাক হিসেবে। গোটা ম্যাচে অরিগি আর মানে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছেন এই তারকাকে। দলে গতিময় কোনো খেলোয়াড় না থাকার কারণে লিভারপুলের ক্রমাগত ‘প্রেসিং’ এর কোনো জবাব ছিল না বার্সার কাছে। ফলাফল, টানা চার বছর এই নিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে ওঠার আগেই বিদায় নিল বার্সা।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে