দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জীবন বীমা সুবিধার আওতায় আনতে একটি খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।
এ নীতিমালার আওতায় বীমাকারী মৃত্যুবরণ করলে, দুর্ঘটনাজনিত স্থায়ী ও সম্পূর্ণ অক্ষমতা বা পঙ্গুত্ববরণ করলে মূল বীমার শতভাগ পরিশোধ করার বিধান রাখা হয়েছে। অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের ভিত্তিতে দাবি পরিশোধ করার কথাও বলা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আইডিআরএ সদস্য গকুল চাঁদ দাস স্বাক্ষরিত নীতিমালাটি সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে প্রজ্ঞাপন আকারে জারির জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ করা হয়েছে।
খসড়া নীতিমালার প্রারম্ভে বলা হয়েছে, প্রবাসী কর্মীদের বীমা সেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের বীমা সুবিধার প্রয়োজনীয়তা, কর্মীদের আর্থিক সক্ষমতা, কর্মকালীন সম্ভাব্য ঝুঁকিসহ অন্যান্য সম্পর্কিত বিষয় বিবেচনায় আনা হয়েছে।
বীমার প্রকারভেদের ক্ষেত্রে বলা হয়, এ নীতিমালার আওতায় প্রবাসী কর্মীদের জীবন বীমা সুবিধা প্রদান করা হবে।
সাধারণত মৃত্যুর ক্ষেত্রে বীমা সুবিধায় প্রিমিয়াম হার ও বীমা অঙ্ক বীমাগ্রহিতাদের বয়সভেদে পার্থক্য হয়ে থাকে। তবে প্রবাসী কর্মীদের একটি গ্রুপ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে বীমা পরিকল্পটি বা পলিসিটি সহজীকরণের লক্ষ্যে বীমা গ্রহিতাদের বয়স নির্বিশেষে অভিন্ন প্রিমিয়াম হার আরোপ করা হবে।
তাছাড়া এ সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনার পর বিদেশগামী কর্মীদের প্রয়োজনীয়তা ও আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় নিয়ে ৫ লাখ ও ২ লাখ টাকা বীমা অঙ্কের দুটি পরিকল্প বা পলিসি ডিজাইন করা হয়েছে।
বীমা চলাকালীন যেকোনো কারণে বীমাগ্রাহক মৃত্যুবরণ করলে তার বৈধ উত্তরাধিকারীকে বীমা অঙ্কের শতভাগ পরিশোধ করা হবে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়।
অঙ্গহানির সংক্রান্ত বীমা সুবিধা
সাধারণত দুর্ঘটনাজনিত বীমায় স্বাভাবিক মৃত্যুর সুবিধা প্রদান করা হয় না। পিডিএফবির (পার্মানেন্ট ডিজাবিলিটি অ্যাক্সিডেন্টাল বেনিফিট) আওতায় দুর্ঘটনায় আঘাতের ফলে ৯০ দিনের মধ্যে মৃত্যুসহ অন্যান্য ক্ষতি হলে নির্ধারিত বীমা অঙ্ক দেয়া হয়।
বর্তমানে বীমাকারীরা পিডিএবির আওতায় ঝুঁকিভেদে মূল বীমা অঙ্কের অংশ বিশেষ প্রদান করে থাকে। বীমাকারীরা প্রতি হাজার মূল বীমা অঙ্কের জন্য ৩ দশমিক ৫০ টাকা প্রিমিয়াম প্রাপ্তি সাপেক্ষে ঝুঁকি গ্রহণ করে থাকে।
অর্থাৎ ৫ লাখ টাকা মূল বীমা অঙ্কের জন্য দুই বছর মেয়াদে মোট প্রিমিয়ামের পরিমাণ দাঁড়াবে শুধু দুর্ঘটনাজনিত বীমার জন্য, ৯০ দিনের বিধিনিষেধ থাকা সাপেক্ষে, দু’বছরের জন্য ৩ হাজার ৫০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রবাসী কর্মীদের ওপর যাতে আর্থিক চাপ সৃষ্টি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে অঙ্গহানিতে আলোচ্য ক্ষেত্রে নিচে উল্লেখ করা পদ্ধতিতে বীমা সুবিধা দেয়ার সুপারিশ করা হলো-
দুর্ঘটনাজনিত স্থায়ী ও সম্পূর্ণ পঙ্গুত্ব (টিপিডি)
১. উভয় চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে গেলে বীমাকারীকে মূল বীমা অঙ্কের শতভাগ পরিশোধ করা হবে।
২. দুই কব্জির উপর থেকে উভয় হাত কাটা গেলে মূল বীমা অঙ্কের শতভাগ পরিশোধ করা হবে।
৩. হাঁটুর উপর থেকে উভয় পা কাটা বা খোয়া গেলে মূল বীমা অঙ্কের শতভাগ পরিশোধ করা হবে।
৪. কব্জির উপর থেকে এক হাত কাটা বা খোয়া গেলে এবং হাঁটুর উপর থেকে এক পা কাটা বা খোয়া গেলে মূল বিমার অঙ্কের শতভাগ পরিশোধ করা হবে।
৫. কব্জির উপর থেকে এক হাত কাটা বা খোয়া গেলে এবং এক চোখের দৃষ্টিশক্তি চিরতরে হারিয়ে গেলে মূল বীমা অঙ্কের শতভাগ পরিশোধ করা হবে।
৬. হাঁটুর উপর থেকে এক পা কাটা বা খোয়া গেলে এবং এক চোখের দৃষ্টিশক্তি চিরতরে হারিয়ে গেলে মূল বীমা অঙ্কের শতভাগ পরিশোধ করা হয়।
দুর্ঘটনাজনিত স্থায়ী ও আংশিক পঙ্গুত্ব (পিপিডি)
১. চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে গেলে মূল বীমা অঙ্কের ৫০ শতাংশ পরিশোধ করা হবে।
২. উভয় কানের শ্রবণশক্তি হারিয়ে গেলে মূল বীমা অঙ্কের ৪০ শতাংশ পরিশোধ করা হবে।
৩. শ্রবণ শক্তি হারিয়ে গেলে মূল বীমা অঙ্কের ২০ শতাংশ পরিশোধ করা হবে।
৪. নিচের চোয়াল সরে গেলে মূল বীমা অঙ্কের ২৫ শতাংশ পরিশোধ করা হবে।
৫. যদি হিউমেরাসের (কনুই থেকে স্কন্ধ সন্ধি পর্যন্ত হাড়) একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ক্ষয় হয়। যার কোনো চিকিৎসা নেই সে ক্ষেত্রে মূল বীমা অঙ্কের ২৫ শতাংশ পরিশোধ করা হবে।
৬. বৃদ্ধাঙ্গুলিসহ হাতের চার আঙ্গুল সম্পূর্ণরূপে কেটে গেলে মূল বীমা অঙ্কের ৪০ শতাংশ পরিশোধ করা হবে।
৭. বৃদ্ধাঙ্গুলি সম্পূর্ণরূপে কাটা গেলে মূল বীমা অঙ্কের ২৫ শতাংশ পরিশোধ করা হবে।
৮. শুধু তর্জনী আঙ্গুল সম্পূর্ণরূপে কাটা গেলে মূল বীমা অঙ্কের ১৫ শতাংশ পরিশোধ করা হবে।
৯. শুধু মাঝের আঙ্গুল সম্পূর্ণরূপে কাটা গেলে মূল বীমা অঙ্কের ১০ শতাংশ পরিশোধ করা হবে।
১০. শুধু অনামিকা আঙ্গুল সম্পূর্ণরূপে কাটা গেলে মূল বীমা অঙ্কের ১০ শতাংশ পরিশোধ করা হবে।
১১. শুধু ছোট আঙ্গুল সম্পূর্ণরূপে কাটা গেলে মূল বীমা অঙ্কের ৭ শতাংশ পরিশোধ করা হবে।
১২. উরুসন্ধির অনমনীয় অবস্থা হলে মূল বীমা অঙ্কের ২০ শতাংশ পরিশোধ করা হবে।
১৩. হাঁটুর অনমনীয় অবস্থায় মূল বীমা অঙ্কের ২০ শতাংশ পরিশোধ করা হবে।
১৪. পায়ের চার আঙ্গুল বড় আঙ্গুলসহ সম্পূর্ণরূপে কাটা গেলে মূল বীমা অঙ্কের ২৫ শতাংশ পরিশোধ করা হবে।
১৫. পায়ের বড় আঙ্গুল সম্পূর্ণরূপে কাটা গেলে মূল বীমা অঙ্কের ১০ শতাংশ পরিশোধ করা হবে।
বীমা গ্রাহকদের বয়স ও বীমার মেয়াদ :
খসড়ায় বীমার মেয়াদ দুই বছর রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে দুই বছর পর চাকরি থাকা সাপেক্ষে আরও দুই বছরের জন্য নবায়ন করা যেতে পারে। বীমা গ্রহিতার বয়স ১৮ থেকে ৫৮ বছর পর্যান্ত সুপারিশ করা হয়েছে।
খসড়ায় দুই ধরনের বীমা পলিসির কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- প্লাান-এ এবং প্লান-বি। প্লান-এ এর ক্ষেত্রে ১ হাজার টাকা প্রিমিয়ামের বিপরীতে ২ লাখ টাকার বীমা অঙ্ক ধরা হয়েছে। আর প্লান-বি এর ক্ষেত্রে ২ হাজার ৯২৫ টাকা প্রিমিয়ামের বিপরীতে ৫ লাখ টাকা বীমা অঙ্ক ধরা হয়েছে।
উল্লেখিত দুটি বীমা পলিসির মধ্যে আর্থিক সামর্থতা বিবেচনায় নিয়ে প্লান-এ বাস্তবায়ন করা যায়। অবশ্য এক্ষেত্রে বীমা অঙ্কের পরিমাণ বর্তমান প্রেক্ষাপটে অপেক্ষাকৃত কম হিসেবে চিন্তা করলে প্লান-বি বিবেচনায় নেয়া যায়। অথবা দুটি পলিসিই গ্রহণ করা যেতে পারে বলে বলা হয়।
খসড়ায় আরও সুপারিশ করা হয়, প্লান-এ’তে উল্লেখিত বীমা পরিকল্পটির সম্পূর্ণ প্রিমিয়াম বীমাগ্রহিতা পরিশোধ করবে। অন্যদিকে প্লান-বি’তে উল্লিখিত বীমা পরিকল্পটির প্রিমিয়াম আংশিক বিমা গ্রহিতা পরিশোধ করতে পারে এবং অবশিষ্ট অংশ সরকার ভর্তুকি আকারে প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।
খসড়ায় আরও বলা হয়, প্রবাসীদের জন্য জীবন বীমা সুবিধা চালুর পর প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে প্রিমিয়াম হার ও সুবিধাদি পরিবর্তন আনা যেতে পারে।
খাসড়ায় বলা হয়, মৃত্যু, দুর্ঘটনাজনিত অক্ষমতা বা পঙ্গুত্ব সম্পর্কিত বীমা সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করে একটি কাস্টমাইজড প্রোডাক্ট প্রণয়ন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার সময়ে সময়ে আরোপিত ভ্যাট, ট্যাক্স, সারচার্জ এবং অন্যান্য ফি বীমাকারীর প্রিমিয়াম হারের সঙ্গে যোগ করে আদায়যোগ্য হবে।
পলিসিটি শুধু জীবন বীমা কর্পোরেশনে বাস্তবায়িত করা যেতে পারে। পরবর্তীতে সরকারি সিদ্ধান্ত মতে এর সঙ্গে কোনো প্রক্রিয়ায় অন্যান্য কোম্পানিকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এ পলিসির জন্য একটা আলাদা তহবিল তৈরি হবে এবং প্রতিবছর একচুয়ারিয়াল মাধ্যমে লাভ-লোকসান নির্ধারণ করা হবে।
প্রণীত নীতিমালার আলোকে প্রবাসী কর্মীদের জন্য বীমা সেবা চালু এবং পরবর্তীতে যথাযথভাবে চলমান রাখার জন্য ‘ইমপ্লিমেন্টেশন, মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন’ নামে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। বীমা গ্রাহকদের দাবি পেশ এবং বীমা দাবি নিষ্পত্তি সংক্রান্ত বিষয়সমূহসহ অন্যান্য বিষয় নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
পলিসিটি বাজারজাতকরণের দুই বছর পর প্রিমিয়াম হার সুবিধাদি ও আনুষঙ্গিক বিষয়সমূহ পর্যালোচনা করা যেতে পারে। পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পলিসিটি প্রয়োজনবোধে পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা সংশোধন করা যেতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় যারা ভবিষ্যতে চাকরি নিয়ে বিদেশ গমন করবেন তাদের জন্য বীমা পলিসিটি প্রযোজ্য হবে। পরবর্তীতে বিদেশে কর্মরত সব বাংলাদেশির অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
দাবি নিষ্পত্তি অন্যান্য বিষয়ের ওপর একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ডাটাবেজ তৈরি করার সুপারিশ করা হয়।
এ বিষয়ে জানাতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব অজিত কুমার পাল এফসিএ গণমাধ্যমকে জানান, ‘প্রথমে প্রবাসীরা যে দেশে আছে সে দেশের বীমা কোম্পানিতে বীমা করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু বিভিন্ন দেশের আইন-কানুন ভিন্ন হওয়ায় সেটা বাস্তবায়ন হয়নি। তাই এবার এটা জীবন বীমা কর্পোরেশনে বাস্তবায়িত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। কর্পোরেশনেই বীমাকারী প্রিমিয়াম জমা দেবে। এখান থেকেই সব সুবিধা বুঝে নেবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রবাসীদের বীমার আওতায় আনার জন্য একটি নীতিমালার খসড়া প্রস্তুতের জন্য আইডিআরএকে বলা হয়েছিল। তারা ইতোমধ্যে নীতিমালার খসড়া আমাদের দিয়েছে। এখন দ্রুত এ বিষয়টি ফাইনাল করার জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, আইডিআরএ এবং এ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয় বৈঠক করে খুব শিগগিরই এটিকে প্রজ্ঞাপন জারি করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রাথমিক অবস্থায় যারা আগামীতে চাকরি নিয়ে বিদেশ যাবেন তাদের এ পলিসির আওতায় আনব। পরবর্তীতে বিদেশে কর্মরত সব বাংলাদেশিকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যে কোম্পানির মাধ্যমে বিদেশে যাবে তাদেরকেই বীমার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।’