নার্স তানিয়া হত্যা : আসামিদের রিমান্ডে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য

ডেস্ক রিপোর্ট

চলন্ত বাসে নার্সকে ধর্ষণের পর হত্যা!
নিহত নার্স (বামে) আটক চালক ও হেলপার (ডানে)। ছবি : সংগৃহিত

কটিয়াদীতে নার্স শাহিনুর আক্তার তানিয়া ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় রিমান্ডে থাকা পাঁচ জন আসামিরা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মুখ খুলতে শুরু করেছে। গুরুত্বপূর্ণ নানা তথ্য দিচ্ছে তারা।

ঘাতকদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, ঢাকা বিমানবন্দর বাসস্টেশন থেকেই তারা টার্গেট করে তানিয়াকে। এরপর নির্জন জায়গায় নিয়ে ধর্ষণ করে। বাসটি কটিয়াদীতে আসার পর চালক পরিবর্তন হয়। সেখান থেকে হেলপার লালন বাসটি চালাতে থাকে। আর মূল চালক নুরুজ্জামান হেলপারের দায়িত্ব পালন করতে থাকে।

universel cardiac hospital

জানা যায়, সর্বশেষ যাত্রী হিসেবে এক মধ্যবয়সী ব্যক্তি উজানচর নামক স্থানে নামার পর চালক, হেলপার ও তাদের সহযোগীর ভাবভঙ্গি দেখে ভয়ে বাসের মধ্যে কাঁপতে থাকেন তানিয়া। বাসের দ্বিতীয় আসনে বসা তানিয়া তার সিট থেকে উঠে পড়েন। মালপত্র গোছানোর চেষ্টা করছিলেন।

এমন দৃশ্য দেখে দরজা-জানালা বন্ধ করার পর তারা তানিয়াকে বাসের মাঝামাঝি নিয়ে যায়। সেখানে ধস্তাধস্তির পর তানিয়া বাসের মেঝেতে পড়ে যান। এরপর তাকে ধর্ষণ করে তিন আসামি।

পুলিশ জানায়, বাসের হেলপার লালন মিয়া তরুণীকে হত্যা করে ঘটনাস্থলে ফেলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। তবে এতে আপত্তি করে চালক নুরুজ্জামান।

তার ভাষ্য ছিল, তানিয়াকে হত্যার পর ফেলে গেলে ধরা পড়ার আশঙ্কা থাকবে। বরং তাকে বাসের দরজা থেকে ফেলে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে দুর্ঘটনার নাটক সাজাতে হবে।

এর পাল্টা যুক্তি দিয়ে চালক ও হেলপারের সহযোগী বলে, দুর্ঘটনার পর মেয়েটিকে বেঁচে গেলে সব ফাঁস করে দেবে। তাই দুর্ঘটনার নাটক সাজানোর পাশাপাশি মেয়েটির মৃত্যু নিশ্চিত করতে হবে।

এখন পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদে চালক ও হেলপার গণধর্ষণের কথা স্বীকার করলেও মেয়েটির হত্যার ব্যাপারে দুই ধরনের ভাষ্য পাওয়া গেছে।

একজন বলছে, গণধর্ষণের পর তানিয়াকে গাড়ির দরজা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।

আরেকজনের দাবি, গণধর্ষণের পর তাকে বাস থেকে অচেতন অবস্থায় নামানোর পর পড়ে যান তানিয়া। এতে তিনি মাথায় আঘাত পান।

তবে তদন্ত সংশ্নিষ্টদের ধারণা, গণধর্ষণের পর তানিয়াকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, দুর্ঘটনার নাটক সাজাতে মেয়েটিকে যখন রাস্তার ওপর ছুড়ে ফেলা হয়েছে তখন মোটরসাইকেল ও অন্যান্য বাসের চালক এগিয়ে যান। আহত অবস্থায় একটি মেয়ে পড়ে আছে, এটা দেখে তারা উদ্ধার করতে গেলে তিন ধর্ষক জানিয়েছিল- নামতে গিয়ে বাস থেকে মেয়েটি পড়ে গেছে। তারাই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদের সাহায্যের দরকার নেই।

এরপর অচেতন অবস্থায় মেয়েটিকে পিরিজপুর বাজারের সততা ফার্মেসিতে নিয়ে যায় বাসের চালক ও তার এক সহযোগী। আর হেলপার লালন পিরিজপুরে তাদের বাস কাউন্টারে গিয়ে সাজানো বক্তব্য দিয়ে বলতে থাকে- তাদের বাসের এক নারী যাত্রী রাস্তায় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। তাকে সততা ফার্মেসিতে নেওয়া হয়েছে। এটা জানার পর কাউন্টার থেকে লোকজন সততা ফার্মেসিতে যান।

ততক্ষণে পিরিজপুর থেকে সটকে পড়ে হেলপার লালন। সততা ফার্মেসির লোকজন মেয়েটিকে দেখে জলদি কটিয়াদী হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলেন। তখন বাসের চালক ও অন্যরা একটি সিএনজি অটোরিকশা ডেকে মেয়েটিকে কটিয়াদী হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করে।

তবে সিএনজি অটোরিকশা চালক একজন অচেনা মেয়েকে এমন অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার ঝুঁকি নিতে রাজি হননি। তখন চালক ও তার সহযোগী গুরুতর আহত অবস্থায় মেয়েটিকে নিয়ে পিরিজপুর থেকে আবার গাজীপুরের দিকে রওনা হচ্ছিল।

কিছুদূর আসার পর বাসের মালিক চালককে ফোন করে জানায়— দুর্ঘটনার শিকার মেয়েটিকে কাছাকাছি হাসপাতালে না নিয়ে আবার গাজীপুরের দিকে আনা হচ্ছে কেন। মেয়েটিকে কটিয়াদী হাসপাতালে নেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি।

তখনও বাসের মালিক জানতেন না, গণধর্ষণের পর তার লোকজন দুর্ঘটনার নাটক সাজিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে।

একাধিক সূত্র জানায়, পিরিজপুর থেকে একটি অটোরিকশা করে স্বর্ণলতা পরিবহন কাউন্টারের লোকজন তানিয়াকে কটিয়াদী হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আর কটিয়াদী থেকে বাস নিয়ে রাতেই গাজীপুরের দিকে চলে আসে চালক নুরুজ্জামান ও তার এক সহযোগী।

টোক নামক এলাকায় পৌঁছার পর তাদের কাছে খবর পৌঁছে মেয়েটি মারা গেছে। এরপর বাসচালক ও সহযোগী গা ঢাকা দেয়। পরে পুলিশ প্রযুক্তিনির্ভর তদন্তের মাধ্যমে তাদের গ্রেপ্তার করে।

পুলিশ জানায়, এখন পর্যন্ত ড্রাইভার নুরুজ্জামান ও হেলপার লালন ছাড়া আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তারা হলেন বকুল মিয়া ওরফে ল্যাংড়া বকুল, রফিকুল ইসলাম ও খোকন মিয়া। তবে শেষের তিন সন্দেহভাজন ব্যক্তি গণধর্ষণের পর হত্যায় জড়িত ছিল এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তারা মূলত ঘটনার পর তানিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল।

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের তিনজনের দাবি- ঘটনার পর তারা বিষয়টি দুর্ঘটনা বলেই জানত।

লোহাজুরি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আতাহার আলী ভূইয়া রতন জানান, তানিয়া অত্যন্ত বিনয়ী ও ঘর ঘুছানো একটি মেয়ে ছিল।

এদিকে তানিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যার বিচারের দাবিতে আজ শনিবার বিকেলে কটিয়াদী ‘আশ্রায়ন’ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাস্থল জামতলি এলাকায় মানববন্ধন করেছে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে