মূলত উনবিংশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর থেকেই ক্রমান্বয়ে বাংলা একটি আধুনিক, রুচিশীল ও পরিমার্জিত নাগরিক ভাষা হিসেবে গড়ে ওঠে। জ্ঞাত ইতিহাস অনুযায়ী এর প্রায় আট শতাব্দিকাল পূর্ব থেকেই বাংলা ভাষা লিখিত হয়ে আসছিল।
যুগবিন্যাসের নানা পর্যায়ে সেগুলোকে আমরা ‘সান্ধ্য’, মধ্যযুগীয়’ নানা নামে চিহ্নিত করি। এগুলো সবই পদ, পদ্য বা কাব্যরূপে প্রকাশিত। সুতরাং বাংলা গদ্য-সাহিত্যের ইতিহাস মোটামুটি দু’শ বছরের বলে ধরে নেওয়া যায়। মধ্যযুগে বাংলার সামন্ত নৃপতিদের পৃষ্ঠপোষকতায় এক ধরনের বাংলা কাব্যের চর্চা হলেও বাংলা ভাষা তার জন্য নিজস্ব ভূ-খণ্ড আর স্বাধীন ভাষার মর্যাদা অর্জন করেছে অল্পকাল। এমনকি সেটা অর্ধশতাব্দিও নয়।
এই স্বল্পতম সময়ের মধ্যে আকারে-প্রকারে ও ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ উপন্যাস আমরা কতগুলো পেয়েছি, কতগুলোই বা পাওয়া সম্ভব। জাতীয়তাবাদী উন্মেষের কালে রচিত উপন্যাসসমূহের মৌল প্রবণতার অনুসন্ধান করলে এর ভেতর মানবিক ক্রিয়াকলাপের বাইরে আমরা মূলত দেশভাগের অভিঘাত ও সাম্প্রদায়িক নিষ্ঠুরতার কবল থেকে জাতি ও ভাষাকে মুক্ত করার প্রচেষ্টার দিকটি বিশেষভাবে দেখতে পাই।
উপন্যাসের ইতিহাসও খুব বেশি প্রাচীন নয়। ধরা হয় মার্কেন্টাইল ক্যাপিটালিজমের সাথেই এই বিশেষ ধরনের শিল্পরীতির আবির্ভাব। ফলে তা কিছুতেই চারশ বছরের বেশি নয়। এর মধ্যে ক্লাসিক হিসেবে মর্যাদা পাওয়া উপন্যাসের সংখ্যা ঠিক কত?
যদি আমরা ক্লাসিক বলতে তাই বুঝি, যা সময়ে-সময়ে, যুগে-যুগে নতুন কিংবা পুরাতন পাঠকের ভেতর পাঠস্পৃহা জাগিয়ে থাকে। আমরা আবারও তা পাঠ করি আর নবতর বাস্তবতার সাথে সাযুজ্য খুঁজি, পুনরাবিষ্কার করি। এর বাইরে রয়েছে অসংখ্য পুরাণ আর মহাকাব্য, যেগুলোর অধিকাংশই তৈরি হয়েছে একটি দীর্ঘ কিংবা স্বল্পকালীন যুদ্ধ ও প্রাণক্ষয়ের ইতিহাসকে উপজীব্য করে।
জনজীবনের স্বাভাবিক ভাষা থেকে আধুনিক-লেখ্যরূপ পরিগ্রহ করতে বাংলা ভাষাকে পাড়ি দিতে হয়েছে সহ্রাব্দকালেরও অধিক সময়। এই সুবিশাল কালপর্বের একেবারে শেষে অর্থাৎ আমরা যখন এসব কথা বলছি, তখন থেকে মাত্র অর্ধশতাব্দিরও কম সময়পূর্বে বাংলা ভাষা একটি সর্বগ্রাসী ভয়াল যুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।
সেই যুদ্ধের অভিঘাত কী, কতদূর বিস্তৃত এবং সাহিত্যে তার প্রতিফলন ইত্যাদি বিষয় প্রত্যক্ষ করার মতো সময় আমাদের হয়েছে কিনা সেটিও বিশেষভাবে লক্ষ্য করার বিষয় বলে মনে হয়। ফরাসি বিপ্লবের দেড় শতাব্দি অতিক্রান্ত হবার পরও যখন মাও সে তুং মনে করেছিলেন, এতদ্রুত নাকি ঐ ঘটনার মূল্যয়ান করা সম্ভব নয়।
ঠিক একইভাবে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ১৯৯০-৯২ সালের দিকে অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের দুই দশক কেটে যাবার পর, যখন শওকত ওসমানকে প্রশ্ন করেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখনও কোনো মহৎ উপন্যাস রচিত হলো না কেন’, উত্তরে শওকত ওসমান আমেরিকার গৃহযুদ্ধ আর নেপোলিয়নের রুশ অভিযানকে কেন্দ্র করে রচিত দুটি মহৎ উপন্যাসের নাম করে বলেন, ‘এগুলো ওসব ঘটনার প্রায় সত্তর-আশিবছর পরে লিখিত, সাধারণত দেশের কোনো বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনার ওপর উপন্যাস অনেক পরে লেখা হয়, উত্তেজনা থিতিয়ে গেলে।’
ড. আজাদ ও শওকত ওসমানের সেই আলাপচারিতারও কুড়ি-পঁচিশ বছর পর এই বিষয়ক একটি লেখা তৈরির প্রয়োজনে আমি যখন একজন মাঝবয়েসি লেখকের নিকট মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে লেখা পাঁচটি উপন্যাসের নাম জানতে চাইলাম তখন, তিনি একটু ভেবে মাত্র তিনটি উপন্যাসের নাম করতে সক্ষম হলেন। তাই বলে মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে আসলেই কি কোনো মহৎ সাহিত্য রচিত হয়নি।
এই প্রশ্নের উত্তর সত্যিই খানিকটা দুরূহ। দালিলিক কাজ ও স্মৃতিচারণ পর্যাপ্ত না হলেও যা হয়েছে তা-ও নিছক কম নয়। সেগুলো নিশ্চয় পরবর্তীকালের উপন্যাস রচয়িতাদের সহয়তা করবে।
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে রচিত সাহিত্যের ভঙ্গিমা ও বিষয়সূচক এক আলোচনায় ঐতিহাসিক মুনতাসীর মামুন মতপ্রকাশ করেন যে, বাঙালির বীর কাহিনির অভাব থেকেই মুক্তিযুদ্ধ ঘিরে তৈরি উপন্যাসগুলো নিছক বীর কাহিনিতে পরিণত হয়েছে এবং যেগুলোর অধিকাংশই অপ্রস্তুত অবস্থায় লেখা। তিনি মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যতখানি বীরত্বের তার চেয়ে অধিক হলো বিসর্জনের, ত্যাগের। এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত সাহিত্যে এই ত্যাগ-তীতীক্ষার বিষয়টি মূর্ত হয়ে ওঠা বাঞ্ছনীয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে এ পর্যন্ত লেখা হয়েছে যে অসংখ্য গ্রন্থাবলি তার নির্ঘন্ট তৈরি না করে আমরা বরং একটি শ্রেণিকরণের সাহয্যে বিষয়টিকে আর একটু সুস্পষ্টতাদানের চেষ্টা করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন যুদ্ধের ভয়াবহতায় পালিয়ে যাওয়া অধ্যাপক, বিজয় অর্জনের প্রারম্ভে আল-বদরের গুলিতে প্রাণ দানকারী সাতিহ্যিক-অধ্যাপক, লিখেছেন যুদ্ধে সাংগঠনিক নেতৃত্ব প্রদানকারী ব্যক্তিবর্গ, লিখেছেন প্রত্যক্ষ যোদ্ধা, গেরিলা ও সমরনায়কবৃন্দ।
যুদ্ধকালে প্রতিদিনের দিনপঞ্জি লিখেছেন অনেক কবি-সাহিত্যিক, যুদ্ধে স্বামী-সন্তান হারানো মা, প্রাগ্রসর গৃহবধু ছাড়াও অবরুদ্ধ ঢাকায় আটকে পড়া মধ্যবিত্তের অনেকেই। লিখেছেন দেশের বাইরে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত বুদ্ধিজীবীগণ। প্রবাসী সরকারের নানা পর্যায়ে যোগদানকারী কর্মকর্তাবৃন্দ লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকলীন সুতীব্র কূটনৈতিক সংগ্রামের বিবরণ।
লিখেছেন মিত্রবাহিনির একাধিক জেনারেল, ট্রেনার। মুক্তিযুদ্ধকালে ভারত-বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ায় দায়িত্বপালনকারী সাংবাদিকবৃন্দ এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী দালালচক্র ছাড়াও দখলদার-হানাদার বাহিনির জেনারেলরাও সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে বই-পুস্তক রচনা করেছেন। আমাদের পূর্বসূরি মহান সাহিত্যিকরা তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অভিজ্ঞতা আর কল্পনা শক্তির মিশেল দিয়ে যে পরিমাণ গল্প-উপন্যাস রচনা করেছেন তার পরিমাণও কম নয়।
এছাড়া প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত কয়েক হাজার নতুন বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বইপত্র প্রকাশিত হয়ে আসছে মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে। তবু কী আমরা আমাদের মহান যুদ্ধের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে লেখা স্বার্থক এক বা একাধিক উপন্যাস রচনা করতে সক্ষম হইনি? হয়তো হইনি।
হয়তো আংশিক সফল হয়েছি, নিদেনপক্ষে আমরা ঐ মহান পটভূমিকার ওপর আঁচড় কাটছি প্রতিদিন, প্রতিবছর। আলোচনার প্রারম্ভে উল্লেখ করা হয়েছিল, পুরাণ কিংবা মহাকাব্যসমূহের কথা; যা প্রায় সবগুলিই কোনো না কোনো যুদ্ধের পটভূমিকায় রচিত। সবশেষে আমরা যদি পৃথিবীতে রচিত সর্বশেষ দু-একটি ক্লাসিকের ওপর দৃষ্টি ফেরাই, সেটা হোক ল্যাটিন কিংবা আফ্রিকার, সেগুলোর অন্তরালেও আমরা খুঁজে পাই তাদের জাতীয় জীবনে ঘটে যাওয়া দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ অথবা এমনতর কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার অভিঘাত।
সুতরাং আশাপোষণ করা যায়, অনীহা, বিমুখিনতা ও জাতিগত হীনম্মন্যতার নাগপাশ কাটিয়ে বাংলা ভাষাও তার কাঙ্খিত উপন্যাসটি রচনা করে নেবে অচিরেই। কেননা আমরা শওকত ওসমান নির্দেশিত সময়ের মুখোমুখি চলে এসেছি। আর সে উপন্যাসে বর্ণিত কালপর্ব কয়েক দশক কিংবা শতবর্ষে ব্যাপৃত হলেও মূল অভিঘাতটি হবে মুক্তিযুদ্ধ উৎসারিত, একথা নিঃসংশয়ে বলা যায়।
লেখক পরিচিতি
খালিদ মারুফ, মূলত কথাসাহিত্যিক। সমকালীন বিভিন্ন বিষয়ে কলামও লিখে থাকেন, প্রবন্ধ রচনাতেও প্রসিদ্ধ। তিনি ১৯৮৫ সালের ১০ আগস্ট, বাগেরহাট জেলার বেশরগাতী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
পুরো কৈশোর আর যৌবনের কিয়দংশ কেটেছে নড়াইল-গোপালগঞ্জে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিভাগের ছাত্র হিসেবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। বুনোকুলির রক্তবীজ, শীতার্থ পৌষ অভিমুখে,সাপ ও শাপসংক্রান্ত গল্পাবলি তার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিকর্ম । তিনি বর্তমানে বাংলা একাডেমিতে কর্মরত।
অলংকরণ: মীর রবি