রাজবাড়িতে বোরকা পরা চার ব্যক্তি দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক স্কুলছাত্রীকে (১৬) বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হাত, পা ও মুখ বেঁধে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই অভিযোগে গতকাল শনিবার সকালে মেয়েটির বাবা রাজবাড়ী থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। পুলিশ ঘটনা তদন্তের পাশাপাশি আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছে।
মামলার আসামিরা হলো রাজবাড়ীর সদর উপজেলার পাচুরিয়া ইউনিয়নের খোলাবাড়িয়া গ্রামের জাহাঙ্গীর মিজির স্ত্রী শিল্পী বেগম (৪০) এবং তার সহযোগী অজ্ঞাতপরিচয় আরো চারজন।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, গত এপ্রিল থেকে মেয়েটির ওপর কয়েকবার হামলা হয় এবং সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বোরকা পরা চার ব্যক্তি বাড়ি থেকে মেয়েটিকে ধরে পাশের পাটক্ষেতে নিয়ে আগুন ধরিয়ে হত্যার চেষ্টা চালায়।
ওই ছাত্রীর বাবা জানান, গত ১২ এপ্রিল দুপুরে তাঁর মেয়ে সদর উপজেলার খানখানাপুর থেকে একটি রিকশায় নিজ বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়। রিকশাটি বাড়ির পার্শ্ববর্তী দেওয়ানপাড়া মোড়ে পৌঁছলে অজ্ঞাতপরিচয় চার ব্যক্তি তাঁর মেয়েকে রিকশা থেকে নামিয়ে টেনেহিঁচড়ে পাশের জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে মারধর করে এবং চাকুর ভয় দেখিয়ে তার পোশাক লণ্ডভণ্ড করে মোবাইল ফোনে ছবি ধারণ করে এবং ওই ছবি আসামি শিল্পী বেগমের কাছে পৌঁছে যায়। পরবর্তী সময়ে আসামি শিল্পী ওই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তাঁর মেয়ের কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করে।
গত ৩ জুন দুপুরে শিল্পী ও তার দুই সহযোগী তাঁদের বসতবাড়িতে আসে এবং জানালা দিয়ে মেয়েকে ডেকে ঘরের বাইরে আনে। সেই সঙ্গে ওই সব ছবি আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মেয়েকে তার এক ছেলে বন্ধুর (২২) বাড়িতে নিয়ে যায় এবং ওই ছেলে বন্ধুর কাছে আসামিরা আড়াই লাখ টাকা দাবি করে মেয়েকে ওই বাড়িতে রেখে চলে যায়। পরবর্তী সময়ে ওই ছেলে বন্ধুর পরিবারের সদস্যরা মেয়েকে আসামি শিল্পীর বাড়িতে নিয়ে যায় এবং তাদের (মেয়ের) পরিবারের সদস্যদের ঘটনাটি জানায়। ওই সময়ই তিনি (বাবা) শিল্পীর বাড়ি থেকে মেয়েকে নিয়ে আসেন।
মেয়েটির বাবা জানান, গত ৫ জুন সকাল ১০টার দিকে তাঁর মেয়ে বাড়ির পাশের পুকুরে গোসল করে ফিরছিল। সে সময় অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি তাঁর মেয়ের মাথায় গাছের ডাল দিয়ে আঘাত করে। এতে সে অজ্ঞান হয়ে রাস্তার পাশে পড়ে যায়। পরে মেয়েকে উদ্ধার করে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ ঘটনার পরের দিন গত বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে তাঁদের বাড়িতে বোরকা পরিহিত অজ্ঞাতপরিচিত চার ব্যক্তি প্রবেশ করে। তারা মেয়ের মুখ চেপে ধরে বাড়ির পেছনে থাকা একটি পাটক্ষেতের মধ্যে নিয়ে যায়। দুর্বৃত্তরা মেয়ের ওড়না দিয়ে তার হাত, পা ও মুখ বেঁধে খুন করার উদ্দেশ্যে কামিজে ম্যাচের কাঠি দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে শরীরের সামনের অংশ সামান্য পুড়ে যায়। মেয়ে তখন জীবন রক্ষার্থে মাটিতে গড়াগড়ি করে। মেয়ের গোঙানির শব্দে তার মাসহ প্রতিবেশীরা এগিয়ে যায় এবং তার শরীরের আগুন নেভায়। পরে তাকে স্থানীয় চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
- আরও পড়ুন >> তৃণমূল আওয়ামী লীগ কখনো ভুল করে না: মোকতাদির চৌধুরী
প্রতিবেশীরা জানায়, ওই মেয়ে ও তার মায়ের চিৎকার শুনে তারা এগিয়ে আসে এবং মেয়েটিকে উদ্ধার করে। তারা আরো বলে, শিল্পী বেগম ভালো মানুষ নয়। তাকে এলাকার মানুষ ভয় পায়। দিনরাত তার কাছে নানা ধরনের মানুষ আসে, যে কারণে তাকে কেউ কিছু বলার সাহস পায় না।
সদর উপজেলার পাচুরিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাজী আলমগীর জানান, শিল্পী বেগমের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ভালো নয়। তা ছাড়া যে ঘটনা ঘটানো হয়েছে, তা একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা। অল্পের জন্য মেয়েটা প্রাণে বেঁচেছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটে।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মেয়েটির ভাই তাঁর ফেসবুকে বোনের সালোয়ার কামিজে আগুন দেওয়ার ছবি দিয়ে প্রচার করেন। ফলে বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত হয়। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে মেয়েটির ভাই বলেন, প্রধান আসামি শিল্পী বেগম একজন খারাপ নারী। এলাকায় তার নানা রকম অপকর্ম করার রেকর্ড রয়েছে। তাকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হলে ঘটনার মূল রহস্য ও কারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের নাম ও ঠিকানা জানা যাবে। তিনি আরো বলেন, ঘটনাটি রাজবাড়ী থানা-পুলিশকে জানানোর পর তারা তাদের লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে বলে। তাঁর বাবা লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন এবং এরপর রাজবাড়ীর পুলিশ সুপারসহ জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁদের বাড়িতে এসেছেন। তাঁদের সাহস জোগানোর পাশাপাশি আসামিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
- আরও পড়ুন >> নরসিংদীতে প্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণ
ওই স্কুলছাত্রী বলে, ‘এক ছেলে আমাকে পছন্দ করত। এই পছন্দের কথা শিল্পী বেগম জানতে পেরে তাকে সুকৌশলে বিপদে ফেলে। সেই সঙ্গে আমার কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করে। আমি বিষয়টি পরিবারকে জানাই। আর এ কারণেই শিল্পী আমার হাত-পা বেঁধে জামায় আগুন ধরিয়ে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে।’
রাজবাড়ী থানার ওসি স্বপন কুমার মজুমদার জানান, ঘটনাটি তাঁরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। থানায় এজাহার গ্রহণ এবং মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষা করানোর পাশাপাশি আসামিদের গ্রেপ্তার করতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার আসমা সিদ্দিকা মিলি বলেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর, যে কারণে তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে ঘটনার শিকার মেয়ে এবং তার পরিবারের সদস্যদের সাথে দীর্ঘ সময় কথা বলেছেন। পুরো ঘটনা ও ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছেন। আর সে অনুযায়ী রাজবাড়ী থানার ওসিকে আসামিদের গ্রেপ্তার করাসহ অন্যান্য নির্দেশ দিয়েছেন।