দুদক পরিচালককে ঘুষ দেওয়ার অডিও ফাঁস

ডেস্ক রিপোর্ট

মিজানুর রহমান ও খন্দকার এনামুল বাসির
মিজানুর রহমান ও খন্দকার এনামুল বাসির । ছবি - সংগৃহিত

নারী নির্যাতনের অভিযোগে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার হওয়া পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমানের অবৈধ সম্পদের তদন্ত শুরু করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু এই তদন্ত করতে গিয়ে দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাসির ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন মিজানুর রহমান।

মাস ছয়েক ধরে দুজনের মধ্যে এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রথমে ২৫ লাখ ও পরে ১৫ লাখ টাকা দিয়েছেন মিজানুর। কিন্তু ২ জুন খন্দকার এনামুল বাসির মিজানুরকে জানান, তিনি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। তবে দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনারের চাপে তাঁকে অব্যাহতি দিতে পারেননি।

এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মিজানুর টাকাপয়সা লেনদেনের সব কথা ফাঁস করে দেন। প্রমাণ হিসেবে হাজির করেন এনামুল বাসিরের সঙ্গে কথোপকথনের একাধিক অডিও রেকর্ড। এ বিষয়ে গতকাল রোববার প্রতিবেদন প্রচার করে বেসরকারি টিভি চ্যানেল এটিএন নিউজ।

ডিআইজি মিজানুর ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গত জানুয়ারির শুরুর দিকে তাঁকে প্রত্যাহার করে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। বিয়ে গোপন করতে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে দ্বিতীয় স্ত্রী মরিয়ম আক্তারকে গ্রেপ্তার করানোর অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। তখন তাঁর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে।

মিজানুরের বিরুদ্ধে এক সংবাদ পাঠিকাকে প্রাণনাশের হুমকি ও উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে বিমানবন্দর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) রয়েছে। গত বছরের ৩ মে অবৈধ সম্পদসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে মিজানুরকে দুদক কার্যালয়ে প্রায় সাত ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে মিজানুর রহমান ও তাঁর প্রথম স্ত্রী সোহেলিয়া আনারের আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ কোটি টাকারও বেশি সম্পদের খোঁজ পায় দুদক। মিজানুরের নামে ৪৬ লাখ ৩২ হাজার ১৯১ টাকা এবং স্ত্রীর নামে ৭২ লাখ ৯০ হাজার ৯৫২ টাকার অসংগতিপূর্ণ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের খোঁজ পাওয়ার কথা দুদকের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়।

তদন্ত শুরু হওয়ার এক বছরের মাথায় দুদক পরিচালকের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার এই অভিযোগ পাওয়া গেল।

মিজানুর রহমান বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রথমে তদন্ত করছিলেন দুদকের উপপরিচালক ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী। পরে তদন্তের দায়িত্ব নেন পরিচালক এনামুল বাসির। তিনি ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তাঁর কাছে ২৮ বছরের বেতনের রসিদ ও জাতিসংঘ মিশন থেকে আয়ের কাগজপত্র চান। মিজানুর দুদক কার্যালয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে সব কাগজপত্র দিয়ে আসেন। এনামুল বাসির তাঁকে একটি টিঅ্যান্ডটি নম্বর দিয়ে কথা বলতে বলেন।

মিজানুর ফোন করলে এনামুল বাসির তাঁর সঙ্গে রমনা পার্কে দেখা করতে বলেন। মিজানুর ১১ জানুয়ারি দেখা করতে যান। এনামুল তাঁকে বলেন, তাঁর ফাইলে যে কাগজপত্র আছে, তাতে মিজানুরকে ধরার কোনো উপায় নেই। কিন্তু টাকাপয়সা ছাড়া তিনি মিজানুরের পক্ষে প্রতিবেদন দিতে পারবেন না। তিনি শুরুতে ৫০ লাখ টাকা দাবি করেন। একপর্যায়ে ৪০ লাখ টাকায় রফা হয়।

মিজানুর বলেন, ‘আমি তাঁকে করজোড়ে বলি, আপনি আমার ভাই। আপনার হাত ধরি-পা ধরি, আপনি আমাকে ইয়ে করেন। এরপর ১৫ জানুয়ারি রমনা পার্কে গিয়ে তাঁকে ২৫ লাখ টাকা দিই।’ তাঁর গাড়িচালক ও সরকারি দেহরক্ষী ব্যক্তিগত গাড়িতে করে টাকাসহ এনামুলকে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সামনে তাঁর বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসেন বলে দাবি করেন মিজানুর।

তারাপর বাকি টাকার জন্য চাপ দিতে শুরু করলে তিনি আবারও রমনায় ৩০ জানুয়ারি দেখা করতে যান এনামুল বাসিরের সঙ্গে। দিন সাতেক পর তিনি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের রমনা পার্ক-সংলগ্ন ফটকের কাছে দুদক পরিচালককে ১৫ লাখ টাকা দেন।

ঘুষের টাকা দেওয়ার পর মিজানুর তদন্ত প্রতিবেদন তাঁর পক্ষে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে শুরু করেন। ২ জুন এনামুল বাসির তাঁর সঙ্গে পুলিশ প্লাজায় মিজানুরের স্ত্রীর দোকানে দেখা করতে গিয়ে জানান, কাজটা তিনি করতে পারেননি।

এনামুল বাসির গতকাল গণমাধ্যমকে বলেছেন, মিজানুরের স্ত্রীর বিরুদ্ধেও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ছিল। তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে তিনি দোকানে গিয়েছিলেন।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ঘুষ দেওয়া-নেওয়া দুটোই অপরাধ। এ পরিস্থিতিতে দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। অভিযোগ সত্যি হলে উভয়ের বিরুদ্ধে মামলা হতে হবে এবং তদন্তকালীন আইন অনুযায়ী তাঁদের সাময়িক বরখাস্ত করতে হবে। তাঁর মতে, এ ধরনের ঘটনায় দুদকের ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষুণ্ন হয়। তাই দুদকের স্বার্থেই দ্রুত ও কার্যকর তদন্ত হওয়া খুবই জরুরি।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে