চলতি বছরের শুরু থেকেই রাজধানীতে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী বাড়ছিল। তবে বর্ষা মৌসুমের আগে প্রকোপ বেড়েছে এ রোগের। জানুয়ারি থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত ৬৬২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এরমধ্যে মে মাসে ১৫৩ জন এবং জুনের ১৯ তারিখ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৩৭০ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস সেন্টার সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস সেন্টারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম সাধারণত শুরু হয় জুন থেকে। চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। মূলত বর্ষাকালের শুরুতে এই মৌসুমের শুরু। কেননা ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী এডিস মশা সাধারণত শহরাঞ্চলের পরিবেশে জমাট পরিষ্কার পানিতে জন্মায়। আর বর্ষাকালে থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় পানি জমে থাকে বিভিন্ন জায়গায়।
বৃষ্টিতে জমা টবের পানি, ছাদে জমা পানি, ডাবের খোসা বা এরকম অন্যান্য জিনিসের ওপর জমা পানি সর্বোপরি গৃহস্থালির আশপাশে মোটামুটি পরিষ্কার স্থানে জমে থাকা পানিতে জন্মায় বা ডোবা-নালা বা ড্রেনে জমে থাকা নোংরা পানিতে এডিস মশা জন্মায় না। এ কারণে এই সময়কালকেই ডেঙ্গুর মৌসুম বলা হয়। সেজন্য এসব পানি জমতে না দেওয়া বা সাবধানতা অবলম্বন করে বেঁচে থাকাটা এই মৌসুমে জরুরি।
এ বিষয়ে ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির বিশেষজ্ঞ মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে মশার প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে হয়। এটা নিরীক্ষণ করতে হয় যে, মশাটা আসলে কোনো প্রজাতির বা তার স্বভাব কী ধরনের? এজন্য আলাদা লোক থাকে যারা সারা শরীর ঢেকে পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ খোলা রেখে মশাকে বসতে দেয়। এরপর মশাকে আটকে পরীক্ষাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হয় এটি এডিস মশা কিনা। মোটামুটি দেখা যাচ্ছে জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে এই মশার প্রকোপ বেড়েছে। আর ঘরের আশপাশেই এ ধরনের মশা ঘরে জন্মায়। নোংরা স্থানে জন্মায় না। তাছাড়া জুন থেকে এই মশার প্রজনন ঋতু শুরু হয়। আর মশা নির্ধারণের এই প্রক্রিয়া সারাবছর চলতে থাকে। কেননা ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতিতে মশা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে।
তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ২০১৭ সাল থেকে নিয়মিতভাবে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় বছরে তিনবার এডিস মশার জরিপ কার্যক্রম চালানো হয়। ০৩-১২ মার্চ চালানো জরিপে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বেশ কিছু এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব পরিমাপে ব্যবহৃত সূচকের মাত্রা বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। মেঝেতে জমানো পানি, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিক ড্রাম, প্লাস্টিক বালতি, পানির চৌবাচ্চা, ফুলের টব ইত্যাদিতে এডিস মশার বংশবিস্তার বেশি পরিলক্ষিত হয়। যা দুই সিটি করপোরেশনকে অবহিত করে সেসব এলাকাসহ অন্যান্য এলাকায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস সেন্টারের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় বা বুধবারে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে মোট ৪৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর আগের দিন মঙ্গলবার ৩১ জন ভর্তি হয়েছিলেন। এ বছরের জানুয়ারি থেকে বুধবার পর্যন্ত ৬৬২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
এর মধ্যে ৫৪২ জন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ফেরত গেছেন। এছাড়া এখনো বিভিন্ন হাসপাতালে ১১৮ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তবে প্রাণ হারিয়েছেন দু’জন। এর মধ্যে রাজধানীর বিআরবি হাসপাতালে ৫৩ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৯ এপ্রিল মারা যান। আজগর আলী হাসপাতালে গত ২৯ এপ্রিল মারা যান ৩২ বছর বয়সী এক যুবক।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, ইতোমধ্যে দ্রুত ডেঙ্গু রোগ শনাক্তকরণের বিশেষ সরঞ্জাম বিতরণ করা হয়েছে ঢাকার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এডিস মশা শনাক্তকরণে জরিপ কার্যক্রম এবং লার্ভিসাইড ও এডালটিসাইড ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকেই সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে পরিচালক বরাবর ন্যাশনাল ডেঙ্গু গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া ও নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠানোর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া করা হয়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের সুষ্ঠু চিকিৎসার ব্যপারে সব সরকারি মেডিক্যাল হাসপাতাল এবং প্রধান বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎকদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জটিল রোগীর ব্যবস্থাপনা যেন ডেঙ্গু ন্যাশনাল গাইডলাইন অনুযায়ী হয় সে ব্যাপারে আইসিইউ প্রধানদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসদের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। ডাক্তার-নার্সদের ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
তিনি বলেন, চলতি বছরের মার্চে এডিস মশাবাহিত রোগ (ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা) নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে উপদেষ্টা করে সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ৩০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চ পর্যায়ের টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়েছে।