দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এক লাখ ৪৩ হাজার ৭২৭ মেট্রিক টন কয়লা লোপাটের ঘটনায় করা মামলায় বড় পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির সাবেক সাত ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (এমডি) ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক সামছুল আলম গতকাল দিনাজপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে অভিযোগপত্রটি জমা দেন।
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য গণমাধ্যমকে আজ রোববার এসব তথ্য জানান।
তদন্তে আসামিদের বিরুদ্ধে ২৪৩ কোটি ২৮ লাখ ৮২ হাজার ৫০১ টাকা মূল্যের এক লাখ ৪৩ হাজার ৭২৭ মেট্রিক টন কয়লা আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে।
প্রণব কুমার বলেন, তদন্তে এজাহারভুক্ত ১৯ আসামির মধ্যে পাঁচজনের অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় তাদের অভিযোগপত্রে রাখা হয়নি। ঘটনার সঙ্গে নতুন করে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়ায় মামলায় আরও নয়জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এক লাখ ৪৩ হাজার ৭২৭ মেট্রিক টন কয়লা লোপাটকে সিস্টেম লসের ঘাটতি বলে দাবি করেছিল কোম্পানি। কিন্তু দুদকের তদন্তে প্রমাণ মেলে যে কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণেই খনির কয়লা কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে।
অভিযোগপত্রে যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেন, প্রতিষ্ঠানটির সাবেক সাত এমডি মো. মাহবুবুর রহমান, মো. আবদুল আজিজ খান, প্রকৌশলী খুরশীদুল হাসান, প্রকৌশলী কামরুজ্জামান, মো. আমিনুজ্জামান, প্রকৌশলী এস এম নুরুল আওরঙ্গজেব ও প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহাম্মদ; সাবেক জিএম (প্রশাসন) মো. শরিফুল আলম ও আবুল কাসেম প্রধানীয়া, সাবেক জিএম (মাইন অপারেশন) আবু তাহের মো. নুর-উজ-জামান চৌধুরী, ব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) মাসুদুর রহমান হাওলাদার, ব্যবস্থাপক (মেনটেন্যান্স) মো. আরিফুর রহমান, ব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) সৈয়দ ইমান হাসান, উপব্যবস্থাপক (কোল হ্যান্ডলিং ম্যানেজমেন্ট) মুহাম্মদ খলিলুর রহমান, উপব্যবস্থাপক (মেনটেন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন) মো. মোর্শেদুজ্জামান, উপব্যবস্থাপক প্রোডাকশন ম্যানেজমেন্ট মো. হাবিবুর রহমান, উপব্যবস্থাপক (মাইন ডেভেলপমেন্ট) মো. জাহেদুর রহমান, সহকারী ব্যবস্থাপক (ভেন্টিলেশন ম্যানেজমেন্ট) সত্যেন্দ্র নাথ বর্মন, সহকারী ব্যবস্থাপক (পিএম) মো. মনিরুজ্জামান, ব্যবস্থাপক (কোল হ্যান্ডলিং ম্যানেজমেন্ট ) মো. শোয়েবুর রহমান, উপমহাব্যবস্থাপক (স্টোর ডিপার্টমেন্ট) এ কে এম খালেদুল ইসলাম, ব্যবস্থাপক (প্রোডাকশন ম্যানেজমেন্ট) অশোক কুমার হালদার এবং উপমহাব্যবস্থাপক (মাইন প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) মো. জোবায়ের আলী।
বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের কয়লা উপাদান, বিক্রি, কোম্পানির নিজস্ব ব্যবহার এবং মজুতের মাসওয়ারি বিবরণ পর্যালোচনা করে দুদক দেখেছে, উৎপাদনের শুরুতে অল্প পরিসরে কয়লা স্থানীয় ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে।
তবে ২০০৬ সালের জানুয়ারি থেকে নিয়মিতভাবে স্থানীয় ক্রেতাদের কাছে বিক্রি শুরু হয়। দুদক বলছে, বিসিএমসিএলের কোল ইয়ার্ড ও সারফেস সাইলো সীমানাপ্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত। বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহের সময় সারফেস সাইলোর কনভেয়ার বেল্টের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। সেখানে কয়লা কম-বেশি হওয়ার সুযোগ নেই।
বড়পুকুরিয়া খনির কয়লা চুরির ঘটনা কর্তৃপক্ষের প্রথম নজরে আসে গত বছরের জুনে। যখন বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কাছে কয়লা সরবরাহে ঘাটতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে। দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বড়পুকুরিয়ার খনি থেকেই কয়লা সরবরাহ করা হয়। সেখানে এক লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা গায়েব হয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠার পরই বিষয়টি আলোচনায় আসে।
তদন্ত শেষে এজাহারে সাবেক এমডি প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহমেদসহ ১৯ জনের নাম আসে। তালিকায় অন্যদের মধ্যে ছিলেন সাময়িক বরখাস্তকৃত বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির মহাব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) নূর-উজ-জামান চৌধুরী, কোম্পানি সচিব ও মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আবুল কাশেম প্রধানিয়া, মহাব্যবস্থাপক নূর-উজ-জামান চৌধুরী, উপ-মহাব্যবস্থাপক (স্টোর) এ কে এম খালেদুল ইসলামসহ ব্যবস্থাপক, উপ-ব্যবস্থাপক ও সহকারী ব্যবস্থাপক পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
এর আগে খনি কর্তৃপক্ষের দায়ের করা মামলায় ওই ১৯ আসামির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে এক লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ টন কয়লা খোলা বাজারে বিক্রি করে ২৩০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।
পরে দুদকের তদন্তে আরও কিছু নতুন নাম যুক্ত হয়। ২০০৫ সাল থেকে ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই পর্যন্ত ৯ জন এমডি দায়িত্ব পালন করেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন গোলাম মোস্তফা, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মাহবুবুর রহমান, আবদুল আজিজ খান, প্রকৌশলী খুরশীদুল হাসান, প্রকৌশলী কামরুজ্জামান, মো. আমিনুজ্জামান, প্রকৌশলী এস এম নুরুল আওরঙ্গজেব ও প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহমেদ। এদের মধ্যে সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মোস্তফা মারা গেছেন। আর এজাহারে অন্তর্ভঅুক্ত হননি গোলাম মোস্তফা ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
যেভাবে জানাজানি হয় ঘটনা
কয়লা চুরির ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের প্রথম টনক নড়ে গত বছরের জুনে। বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কাছে কয়লা সরবরাহে ঘাটতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে।
যন্ত্রপাতি স্থানান্তর করতে জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে খনির উৎপাদন কিছুদিন বন্ধ থাকবে- এ খবর পাওয়ার পর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। জুলাই মাসে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট বন্ধ করে দেয়া হয়।
এরপর জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। জুলাইয়ের মাঝামাঝি তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ হয়। এতে দেখা যায়, ২০০৫ সাল থেকে বড়পুকুরিয়া খনির কয়লা উৎপাদন এবং সরবরাহের হিসাবের মধ্যে বড় ধরনের গরমিল রয়েছে।
- রুশ সুন্দরী-মালয়েশিয়ার রাজার বিচ্ছেদ নিয়ে নাটকীয়তা
- আইসিসির স্থগিতাদেশের কারণে বাংলাদেশ সফরে আসছে না জিম্বাবুয়ে
কাগজে-কলমে গরমিলের পরিমাণ ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ টন। তখনই ফাঁস হয়, ১৪ বছর ধরে খনি থেকে কয়লা চুরি হয়েছে। খনি কর্তৃপক্ষের মামলায়ও অভিযোগ করা হয়, ২০০৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই পর্যন্ত ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ টন কয়লা চুরি হয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ২৩০ কোটি টাকা।