তবে কি দেশের লোকসংখ্যার এক বিরাট অংশ সন্ত্রাসী, অপরাধী?

ড. সা’দত হুসাইন

ড. সা’দত হুসাইন
ড. সা’দত হুসাইন। ফাইল ছবি

পত্রিকা খুললেই বাংলাদেশের গঞ্জ-গ্রামে, ইউনিয়নে, উপজেলা, জেলা কিংবা বিভাগীয় সদরে খুন-ধষর্েণর খবর চোখে পড়ে। আরেকটু নজর দিয়ে পড়লে দেখা যায়, প্রায় সব এলাকায় বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অনেক জায়গায় এদের জমকালো বিচিত্র নাম রয়েছে। যেমন—ফাইভ স্টার, সেভেন স্টার, আজরাইল, বন্ড, টারজান, ইবলিশ কিংবা ০০৭ ইত্যাদি। ব্যক্তির নামেও ছোট ছোট সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে উঠেছে। যে নামেই পরিচিতি হোক না কেন, সন্ত্রাসী গ্রুপ এলাকায় নানারূপ অত্যাচার-অনাচার, জোর-জুলুম, অপরাধ চালায়। মানুষকে অতিষ্ঠ করে তোলে। গুম, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ছিনতাইয়ের মতো জঘন্যতম অপরাধ ছাড়াও বখাটেপনার মাধ্যমে সাধারণত এরা পাড়া-মহল্লায় অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। এরা মুরব্বিদের সঙ্গে বেয়াদবি করে, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে, নিরীহ লোককে গালমন্দ করে, অকারণে হুমকি-ধমকি দেয়। মানুষের হাঁস-মুরগি, বাগানের ফলমূল জোর করে নিয়ে যায়, পুকুরে বিষ ঢেলে মাছ মেরে ফেলে, সতেজ গাছপালা কেটে ফেলে। কেউ প্রতিবাদ করলে বা বাধা দিলে তাকে নানাভাবে হেনস্তা করে।

বাংলাদেশে ৬৪ জেলা, ৪৯২টি উপজেলা এবং চার হাজার ৫৫৪টি ইউনিয়ন রয়েছে। গ্রামের সংখ্যা ৮০ থেকে ৮৫ হাজার। পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের সর্বত্র বখাটে, সন্ত্রাসী-অপরাধী এবং ধর্ষকদের যে দলবদ্ধ তাণ্ডব দেখছি, তাতে অনুমান করা অমূলক হবে না যে দেশে এদের সংখ্যা কয়েক লাখ হবে। দলবদ্ধ অপরাধীমুক্ত কোনো জেলা-উপজেলা আছে বলে মনে হয় না। বেশ কয়েক বছর আগে অপরাধ ও অপরাধীর সংখ্যার ভিত্তিতে জেলাগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাতে অন্তত এমন কয়েকটি জেলা চিহ্নিত হয়েছিল, যেখানে অপরাধ নেই বললেই চলে। এখন পত্রিকায় রিপোর্ট থেকে প্রতীয়মান হয় যে সেসব জেলাও আর অপরাধীশূন্য নয়। বখাটে ও অপরাধীরা সেখানে দলবদ্ধ হয়ে ঘুরে বেড়ায়, এলাকার বাসিন্দাদের ওপর নানারূপ অত্যাচার চালায়, সুযোগ পেলে খুন, গুম, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ করতে পিছপা হয় না। জেলা সদর, উপজেলা এবং ইউনিয়নের একেকটি অংশ এদের কর্তৃত্বাধীনে থাকে।

স্বাধীনতা-পূর্বকালে, আমরা যখন স্কুল-কলেজে পড়তাম, তখন কোনো কোনো জেলায় দু-একটি ডাকাতদলের নাম শোনা যেত। তবে দলের চেয়ে ব্যক্তি ডাকাতের নামই বেশি উচ্চারিত হতো। এসব ডাকাত ছিল পরিপক্ব তরুণ অথবা প্রৌঢ়ত্বে পা দেওয়া শক্তিমান পুরুষ। ডাকাতির পরিধি ছিল গ্রাম এলাকা, নদী, খাল, ঝিল-বিল, ঝোপঝাড় বা বনভূমিবেষ্টিত দুর্গম এলাকা। শহরে, জনপদে কদাচ তারা হানা দিত। সব জেলায় কুখ্যাত ডাকাত ছিল না। সারা দেশে দুর্ধর্ষ ডাকাতের সংখ্যা শতাধিক ছিল কি না সন্দেহ রয়েছে। শহরে তরুণ সন্ত্রাসীরা ছিল সংখ্যায় একেবারে সীমিত। এরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করত, কোর্ট-কাছারিতে গ্রাম থেকে আসা মামলার বাদী, আসামি, সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের প্রতিপক্ষ পার্টি থেকে কিছু টাকা-পয়সা আদায় করত। শহরের সাধারণ বাসিন্দাদের সঙ্গে এদের সংযোগ ছিল না বললেই চলে। পারিবারিক প্রতিপত্তি, সামাজিক অবস্থান, সুঠাম গড়ন কিংবা বলিষ্ঠ চলন-বলনের জন্য শহরের সাধারণ মানুষ এদের একটু সমীহ করত। সাধারণ মানুষকে হেনস্তা করা, তাদের ওপর শক্তি প্রয়োগ, মুরব্বিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা বা ছিনতাই করে মানুষের টাকা-পয়সা নিয়ে যাওয়ার ঘটনা আমাদের কানে আসেনি। পত্রপত্রিকায় এরূপ ঘটনা খুব একটা দেখা যেত না। চোর-ডাকাতরা নেহাত অপাঙেক্তয় হিসেবে সমাজে, জনপদে গাঢাকা দিয়ে জীবন কাটাত। রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক সংগঠনে তাদের অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে।

রাজধানীতে সন্ত্রাসী গ্রুপ ছিল মূলত বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক (কলেজ)। এদের পেছনে রাজনৈতিক শক্তি ছিল। সরকার সমর্থিত, বিশেষ করে গভর্নর মোনেম খাঁর আশ্রয়ে লালিত ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন (এনএসএফ) কিছু গুণ্ডা প্রকৃতির ছাত্রদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাত। অতিরিক্ত প্রশ্রয় পেয়ে এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকায়ও তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করেছিল। সে সময় সন্ত্রাসীদের একটা সোপান-বিন্যস্ত কাঠামো ছিল। রাজধানীর, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসীরা দেশের সন্ত্রাসীকুলের শিরোমণি হিসেবে বিবেচিত হতো। তাদের তুলনায় মফস্বলের সন্ত্রাসীরা নিজেদের ছোট মাপের সন্ত্রাসী মনে করত। ঢাকার সন্ত্রাসীদের তুলনায় বড় ধরনের কর্মকাণ্ডে তারা সাধারণত লিপ্ত হতো না। খুন, গুম, ধর্ষণের ঘটনা অতীব সীমিত ছিল। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তখন মূলত হুমকি-ধমকি, দাপুটেপনা জাহির, বড়জোর শারীরিক হেনস্তা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

গত কয়েক বছরে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও প্রসারের ফলে সন্ত্রাসের চরিত্র ও সন্ত্রাসীদলের ব্যাপক কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সংঘটিত সন্ত্রাসের প্রক্রিয়া-পদ্ধতি টেলিভিশন, কম্পিউটার ও মোবাইলের মাধ্যমে প্রত্যন্ত গ্রামের লোকজন জেনে যাচ্ছে। অপরাধী গ্রুপ তার কায়দা-কানুন রপ্ত করতে উৎসাহিত হচ্ছে। তারা এ ব্যাপারে রাজধানীর কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের দিকে তাকাতে চাচ্ছে না। সন্ত্রাসের নতুন টেকনিক নিজেরাই প্রয়োগ করে বসছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, আজকাল ঢাকার সন্ত্রাসীরা শীর্ষ অবস্থানে অধিষ্ঠিত থেকে দেশে সন্ত্রাসী অঙ্গনের নেতৃত্ব দিচ্ছে না। আগের মতো তাদের নাম শোনা যায় না। এখনো যাদের নাম শোনা যায়, এরা দশ-পনেরো বছর আগের শীর্ষসন্ত্রাসী। তাদের বদলে এখন গ্রামে গ্রামে, জেলায় জেলায়, নগরে-শহরে, দেশের সর্বত্র সন্ত্রাসী দল জেগে উঠেছে। এসব দলের বেশির ভাগ সদস্যই বালক, কিশোর এবং অল্প বয়সী তরুণ। ‘কিশোর গ্যাং’ হিসেবে এরা সমধিক পরিচিত। এদের সংখ্যা বিশ্বাসযোগ্যভাবে নিরূপণ করা হয়নি। নিরূপণ করা অত্যাবশ্যক। গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে হিসাব করে এগোলে এ সংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদের সঙ্গে এবং পেছনে বড়রাও রয়েছে। তারা নানাভাবে এদের সাহায্য-সমর্থন দিয়ে থাকে।

শুধু চট্টগ্রাম এলাকায়ই কয়েক ডজন ‘কিশোর গ্যাং’ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে। তাদের পেছনে রয়েছে ‘রাজনৈতিক বড় ভাই’। এদের অপকর্মের বর্ণনা পড়লে গা শিউরে ওঠে। নিচে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের উদ্ধৃতির মাধ্যমে এদের অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরা হলো—

“বরগুনার ‘নয়ন বন্ড’ পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর সারা দেশেই প্রশ্ন উঠেছিল, যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে নয়ন বন্ডদের তৈরি করছে, তাদের কি কিছুই হবে না? আর চট্টগ্রাম পুলিশ বলছে, রাজনৈতিক বড়ভাইদের আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে নগরব্যাপী অসংখ্য কিশোর অপরাধী তৈরি হচ্ছে। তুচ্ছ ঘটনায় খুনাখুনি, প্রকাশ্যে রাস্তায় গুলি করে বা ঘরে ঢুকে ছুরি মেরে খুন করতে তাদের হাত কাঁপছে না।

পুলিশের হিসাবে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৮ জুলাই পর্যন্ত ১৮ মাসে ৩২টি গুরুতর অপরাধের ঘটনায় কিশোররা জড়িত। এর মধ্যে খুনের ঘটনা রয়েছে ২২টি।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে নগরের পাহাড়তলী থানার সাগরিকা এলাকায় মোবারক হোসেন নামের একজনকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে তারই বন্ধু দুই কিশোরকে আইনের আওতায় নিয়েছে পুলিশ। পাহাড়তলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মইনুর রহমান এক দৈনিককে বলেন, নিহত ও গ্রেপ্তার তিন কিশোর-তরুণই ভবঘুরে। ‘গ্যাং’ বানিয়ে তারা বিভিন্ন অপরাধ করত। একটি ছিনতাইয়ের বাটোয়ারা নিয়ে নিহত মোবারকের সঙ্গে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে মোবারক কিশোরকে চড় মারে। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে চড় খাওয়া কিশোরটি তার আর বন্ধুদের খবর দেয়। এরপর তারা সবাই মিলে মোবারককে বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

ওসি মইনুর রহমান আরো বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত কিশোররা জানিয়েছে, রাজনৈতিক পরিচয়ধারী ‘বড় ভাই’রা তাদের দেখভাল করে থাকেন।

পুলিশ সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম নগরের অলিগলিতে এ রকম অর্ধশত ‘কিশোর গ্যাং’ রয়েছে। প্রতিটিতে ১৫ থেকে ২৫ জন করে সদস্য রয়েছে। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানের পাশাপাশি নিম্নবিত্তদের সন্তানরা রয়েছে গ্যাংয়ে। রাজনৈতিক বড়ভাইদের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে মারপিট, পাড়া-মহল্লায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাসহ ছোটখাটো অপরাধ করে হাত পাকাচ্ছে এরা। পুলিশের কাছে ও আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে একাধিক কিশোর বড়ভাইদের কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়ার কথাও জানিয়েছে। এ জন্য পুলিশ রাত ৮টার পর স্কুলপড়ুয়া ছেলেরা কারণ ছাড়া বাইরে থাকলে ধরে ধরে অভিভাবকের জিম্মায় দিচ্ছে। নগরে কিশোরদের নিয়ন্ত্রণে—এ রকম অর্ধশত জায়গা পুলিশের বিশেষ নজরদারিতে রয়েছে।

গত ১০ মে নগরের মুরাদপুরে মুদি দোকানি মোস্তাক আহমেদকে (৩৫) ছুরিকাঘাতে খুন করে একদল কিশোর। নিজের কিশোর ছেলের সঙ্গে আড্ডায় আরেক দল কিশোরের ঝগড়া থামাতে গেলে খুন হন তিনি। ওই ঘটনার চার দিনের মাথায় ১৪ মে নগরের ডবলমুরিং থানার হাজীপাড়ায় রিকশাচালক রাজু আহমেদকে ঘরে ঢুকে ছুরি মেরে হত্যার অভিযোগে কিশোরসহ সাতজনকে আইনের আওতায় নেয় পুলিশ।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘কিশোরদের আশ্রয়দাতা বড়ভাইদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার অভিযান চলছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে বাকলিয়ার এক বড়ভাই গত এপ্রিলে নিহত হয়েছেন।’

কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, রাজনীতিবিদরা এসব বালক-কিশোর সন্ত্রাসীকে গড়ে তুলেছেন। বিশ্লেষণটি সর্বাংশে সত্য নয়। এ কথা ঠিক যে বেপরোয়া সন্ত্রাসী ও বখাটে হয়ে ওঠার পর রাজনীতিবিদরা এদের ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার প্রয়াস পান। কিন্তু আসলে ছোট বয়স থেকে মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যদের আশকারা পেয়ে এরা বেয়াদব, বেয়াড়া এবং জুলুমবাজ হয়ে ওঠে। প্রথমে এরা ভাই-বোনদের ওপর অত্যাচার-জুলুম চালায়। তারপর নিকটাত্মীয়-স্বজন এবং পাড়া-পড়শিদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। একটু বড় হলে এরা শক্তি প্রয়োগ করতে চায় এবং কখনো কখনো তা করে বসে। মা-বাবা ইচ্ছা করলে এ সময়ও শক্ত হাতে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। কিন্তু তাঁরা তা করেন না। উল্টো ওই ছোট বাচ্চাকে তাঁরা ভয় পেতে শুরু করেন। এ সুযোগে পারিবারিক পর্যায়ে তাদের অত্যাচার-জুলুম আরো বেড়ে যায়। মাঝেমধ্যে পাড়া-মহল্লার নিরীহ লোককেও এ অত্যাচার-জুলুমের ভুক্তভোগী হতে হয়। স্কুল, কলেজ ও এলাকায় এদের জোর-জুলুম ও অপকর্মের কথা ছড়িয়ে পড়ে। পাতিনেতা এবং ছোটখাটো রাজনীতিবিদরা তখন এদের ব্যবহার করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও উৎসাহে এরা পর্যায়ক্রমে জঘন্যতম অপরাধে লিপ্ত হয়। যদি পারিবারিক পর্যায়ে যথাযথ আদর, সোহাগ, শাসনে থেকে এরা সুবোধ-সভ্য কিশোর-কিশোরী হিসেবে গড়ে উঠত, তাহলে রাজনীতিবিদরা এদের অপকর্মে ব্যবহারের কথা চিন্তা করতেন না। এরা বখাটে-সন্ত্রাসী হয়ে গেছে—এ কথা জেনে রাজনীতিবিদরা এদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছেন এবং এদের জঘন্য অপরাধের দিকে ঠেলে দিয়েছেন।

বয়সের কথা বিবেচনা করে অনেক সময় মুরব্বিরা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, এমনকি কোর্ট-কাছারি অল্পবয়সী বখাটে, সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের ব্যাপারে নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। এদের নামমাত্র শাস্তি দেয় অথবা সংশোধনকেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়। বর্তমান আইনের বিধানে এর থেকে বেশি করার বিশেষ অবকাশ নেই। বিভিন্ন আইনে শিশু-কিশোরের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা সামাজিক সমর্থনের জন্য উপযোগী হলেও অপরাধোত্তর ছাড় প্রদান বা নমনীয়তা প্রদর্শনের জন্য যথোপযোগী নয়। পুষ্টিমান এবং পরিচর্যা উন্নত হওয়ার কারণে আজকাল তেরো-চৌদ্দ বছরের কিশোর গায়ে-গতরে বেশ বড়সড় হয়। এরা যেকোনো অপরাধ করার সক্ষমতা রাখে। অনেকেই রীতিমতো খুন, গুম, ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। আগের দিনে বখাটেপনা বলতে ছোটখাটো দুষ্টুমি, বালিকা-কিশোরীদের প্রতি তির্যক মন্তব্য ছুড়ে মারা কিংবা পাড়া-পড়শিদের বোকা বানানোর কৌশল প্রয়োগ করাকে বোঝানো হতো। সময় পরিবর্তিত হয়েছে। এখন বখাটেপনা অনেক নোংরা পর্যায়ে নেমে গেছে। এখন তা মুরব্বিদের হেনস্তা করা, বালিকা-কিশোরীদের শ্লীলতাহানি, এমনকি যৌন নিপীড়ন, সমবয়সীদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ, গুম-খুনের সীমানায় পৌঁছে গেছে।

বখাটেপনা, দলবদ্ধ অপরাধ সংঘটন, মাদক সেবন, অভিভাবক বা পাড়া-মহল্লার লোকজন থেকে কৌশলে কিংবা জোরপূর্বক অর্থ আদায়কে কোনোভাবে খাটো অপরাধ বলে বিবেচনা করা যায় না। বখাটেপনা প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন কিংবা সংশ্লিষ্ট আইনে নতুন ধারা সংযোজনের মাধ্যমে এই মারাত্মক প্রবণতাকে ঠেকাতে হবে। অপরাধ সংঘটনের একেবারে প্রথম দিকে যদি এই প্রবণতাকে বিনষ্ট করা যায়, তবে ভবিষ্যতে তা মহীরুহে রূপান্তরিত হবে না। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সব শাখার বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, এটি একটি জাতীয় সমস্যা। দল-মত, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নির্বিশেষে সবার সহযোগিতা, সমর্থন ও সৎ উপদেশের মিলন ঘটিয়ে এই কঠিন সমস্যা সমাধানের জন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। জাতিকে রক্ষা করার জন্য এ ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার বিকল্প নেই।

লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে