উর্দ্ধতনরা অধস্তনদের ডেকে আনতে বললেই রীতিমত বেঁধে আনে

মোহাম্মদ বশির উদ্দীন

মোহাম্মদ বশির উদ্দীন
মোহাম্মদ বশির উদ্দীন

মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটের ‘ভিআইপির অপেক্ষায় ছাড়েনি ফেরি, অ্যাম্বুলেন্সেই প্রাণ গেল স্কুলছাত্রের’ শিরোনামের সংবাদটি নজরে আসল। এদেশের সমস্যা কি জানেন ভাই? সমস্যা হল উর্দ্ধতনরা অধস্তনদের ধরে আনতে বললেই বেঁধে আনেনা শুধু, ডেকে আনতে বললেই রীতিমত বেঁধে আনে।

আমি যতদূর জানি (যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে) যুগ্মসচিব থেকে উপরের সরকারি মানুষজন ভিআইপি সুবিধা পান। পাওয়া উচিত কি উচিত না সে বিতর্ক কেউ আপাতত করবেন না। কারণ আমি এ লেখায় সেদিকে যাবনা। আমি অন্যদিকে যাচ্ছি। জেলা প্রশাসক একটি বার্তা দিয়েছেন ভিআইপি পারাপারের, এ বার্তা তিনি দিতেই পারেন, দিয়ে অন্যায় করেননি। ততক্ষণে সেখানে একটি গুরতর আহত রোগী বহনকারী এ্যাম্বুলেন্স চলে আসে। ইমার্জেন্সী বিবেচনায় নিয়ে ঘাটে দায়িত্বরত সবচেয়ে সিনিয়র কর্মকর্তা বা কর্মচারির উচিত ছিল রোগী বহনকারী এ্যাম্বুলেন্সটি পারাপারের ব্যবস্থা নেয়া। প্রয়োজনে তিনি তাঁর সিনিয়রের দ্বারস্থ হতে পারতেন। আরও প্রয়োজনে জেলা প্রশাসককে মৃত্যুপথযাত্রী স্কুল ছাত্রের শারীরিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে ফিরতি মেসেজ দিতে পারতেন।’

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতনা, ঘাটে কর্মরত কারও চাকরি চলে যেতনা কস্মিনকালেও। চাকরি যাওয়া এত সহজ না। এমনকি কোন হয়রানিও হতনা কেউ। আরেকটি বিষয় হল ঘাটে কর্মরত কেউই জেলা প্রশাসকের অধীনস্ত না। এবং জেলা প্রশাসককে বা ভিআইপিকে স্কুল ছাত্রের অবস্থার বর্ণনা দিয়ে কৈফিয়ত দিলে জেলা প্রশাসক বা ভিআইপি কেউই মাইন্ড করতো বলে আমার মনে হয়না। জেলা প্রশাসকও একজন মানুষ, ভিআইপি যুগ্মসচিবও মানুষ। সরকারি কর্মকর্তাগণ এত অমানুষ হয়ে যাননি যে জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে থাকা গুরতর আহত একটি স্কুল ছাত্রের এ্যাম্বুলেন্স জেনেশুনে আটকে রাখতে বলবেন।

ঐ যে বললাম, ধরে আনতে বললেই বেঁধে আনেনা শুধু, ডেকে আনতে বললেই বেঁধে নিয়ে আসে। আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের একটি বড় সমস্যা হল নিজস্ব জাজমেন্ট খাটাতে না চাওয়া। নিজের ক্ষমতা, নিজের বিচারবুদ্ধি, নিজের ডিসক্রিশন বলে একটা কথা আছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজের ক্ষমতা, বিবেক খাটিয়ে জনস্বার্থে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেবার প্রচলন কমে যাওয়া সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের অদক্ষতার একটি বড় কারণ।

ট্রাফিকে কাজ করার সময় দেখেছি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য রোড ক্লিয়ারেন্স নেবার আগ থেকেই কেউ কেউ সব বন্ধ করার জন্য তড়িগড়ি করত। আমি এখানে নিজের ডিসক্রিশন খাটাতাম ব্যাপকভাবে। আবারও বলছি আমি প্রয়োজন হলেই নিজস্ব ডিসক্রিশন খাটাতে বিন্দুমাত্র পিছপা হতাম না। আমি ফিল্ডে আছি। বাস্তবতা আমি জানি। সুতরাং রওয়ানা দেবার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত বিভিন্ন দিক থেকে অবস্থা বুঝে সিগন্যাল ছাড়ার নির্দেশ দিতাম। যত পারা যায় বিভিন্ন দিক থেকে গাড়ী টানতাম। এভাবে সিগন্যালের ম্যাক্সিমাম ও অপটিমাম ব্যবহার করতে গিয়ে যদি কদাচিৎ একটু সমস্যা অর্থাৎ ভিভিআইপির মোটরকেডের নিরাপদ দুরত্বের মধ্যে পাবলিক গাড়ী পড়ে যাবার সামান্যতম সম্ভাবনা তৈরি হলেই মহামান্য রাষ্ট্রপতি বা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মোটরকেডকে খানিকটা স্লো আসতে বলতাম। আলহামদুলিল্লাহ এতে আমার কোনদিন কোন সমস্যা হয়নি। বিজয়সরণির মত ব্যস্ততম মোড়েও আমি এভাবে অপটিমাইজেশন করেছি।

সমস্যা হল অনেকেই ফিল্ডের বাস্তবতাটা সিনিয়রের কানে দিতে চাই না। কেউ সিনিয়রের আদেশ নিষেধের উপরে আইনসঙ্গতভাবে নিজের ডিসক্রিশন খাটাতে চাইনা। আইনে সরলবিশ্বাস বা গুড ফেইথ কেন আছে তাহলে? জনস্বার্থে গুড ফেইথের ব্যবহার করার সাহস না থাকলে কেমনে হবে? উর্দ্ধতনের নির্দেশের অপেক্ষা করলে তো সবকিছুর জন্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপর নির্ভর করতে হবে। দেশ তো তাহলে অচল হয়ে যাবে।

লেখক, মোহাম্মদ বশির উদ্দীন, এডিশনাল ডেপুটি কমিশনার, ডিএমপি, ঢাকা।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে