রাজধানী ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে ব্যাপক হারে

ডেস্ক রিপোর্ট

ডেঙ্গু
ফাইল ছবি

দেশজুড়ে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বেড়েই চলেছে। ৬৪ জেলাতেই বাড়ছে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। রাজধানীর পাশাপাশি সারাদেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এখন ডেঙ্গু রোগীর ভিড়। রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

সব ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট এবং সামর্থ্যের সবটুকু ব্যয় করেও সরকারি হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করতে পারছে না। হাসপাতালগুলোতে ব্যবস্থাপনা সংকট প্রকট। বিশেষ করে ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ, রক্তের ব্যাগ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও অভিজ্ঞ জনবল সংকট থাকায় ভুল চিকিৎসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঢাকার মতো চিকিৎসা সেবা মফস্বলে হবে না। ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগীদের শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে রাস্তায় মারা যাচ্ছেন রোগী। বাংলাদেশের বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো ঢাকা কেন্দ্রীক হওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকার বাইরে কিছু সংখ্যক সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিশেষায়িত চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলেও তা একেবারেই সীমিত।

এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় পাঁচজন নারী খেলোয়াড়, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হকসহ ১৬৮৭ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মালিহা মাহফুজ অন্নি নামে এক অন্তঃসত্ত্বা নারী, সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী রাইয়ান সরকারসহ তিন জন মারা গেছেন।

মালিহা মাহফুজ অন্নি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল মারা যান। ১০ দিন আগে জ্বর নিয়ে মালিহা রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। পরীক্ষায় তাঁর ডেঙ্গু ধরা পড়ে। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাকে নিয়ে আসা হয় বিএসএমএমইউতে। সেখানে তাকে আইসিইউতে রাখা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। শুক্রবার ভোরে তিনি মারা যান।

সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল এন্ড কলেজের ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী রাইয়ান সরকার (১৪) শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। তার বাবার নাম আব্দুল মমিন সরকার। তিনি এসিআই কনজুমার প্রোডাক্টের জোনাল ম্যানেজার। রাইয়ানের ছোট বোন মালিহা সরকারও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিত্সাধীন।

এছাড়া নোয়াখালীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ডেঙ্গু আক্রান্ত যুবক মোশাররফ হোসেন রাজুর (৩০) মৃত্যু হয়েছে। তিনি সদর উপজেলার ২ নং দাদপুর ইউনিয়নের হুগলী গ্রামের আবদুল গনি মাস্টার বাড়ির আবুল কাশেমের ছেলে।

এদিকে বাংলাদেশের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কলকাতার একটি বিশেষজ্ঞ দল ঢাকায় আসার কথা থাকলেও আপাতত সেটা হচ্ছে না। দুই দেশের প্রোটোকল জটিলতায় এখন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মতবিনিময়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম চেয়েছিলেন কলকাতা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে একটি মতবিনিময় করতে। তাদের অভিজ্ঞতা জানতে। সেই অনুযায়ী আজ শনিবার বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টায় একটি ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময় করা হবে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের সর্বাত্মক চিকিত্সা সেবা দেওয়া হচ্ছে। রাজধানীসহ সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় সাতটি প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি ৬১ লাখ পিস ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিটস আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তিনটি হাসপাতালকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে আর্মি হাসপাতালের সাহায্য নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা সেবা যাতে ব্যাহত না হয়, জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১০০ জন, মিটফোর্ট হাসপাতালে ৬০ জন এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ও মহাখালী শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউটে বাড়তি ৩০ জন নার্সকে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এই দুটি ইনস্টিটিউটে প্রায় ১ হাজার ডেঙ্গু রোগীকে ভর্তি করা সম্ভব হবে। এছাড়া মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আরো তিনশ’/চারশ’ রোগীকে ভর্তি করা সম্ভব হবে বলে মন্ত্রী জানান।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে রোগীদের চাপ বেশি থাকায় অনেক রোগী ভর্তি হতে না পারায় এখন ঢাকার বাইরে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এ কারণে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু রোগী। কিন্তু মফম্বলে ঢাকার মতো চিকিৎসা সেবা হবে না। তাই ডেঙ্গু রোগীদের হাসপাতাল ত্যাগ না করে ঢাকায় থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

এদিকে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ডেঙ্গু রোগ শনাক্তকরণের রি-এজেন্ট। রি-এজেন্টের সংকট দেখিয়ে ঢাকার বাইরের কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ইতোমধ্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়েছে। চট্টগ্রামেও বন্ধ রয়েছে।

এছাড়া বরিশালের হাসপাতালগুলোতে রোগ পরীক্ষার হিড়িক পড়ায় ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিটস (এনএস-১) সংকট দেখা দিয়েছে। শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রক্তের এ পরীক্ষাটি বন্ধ রয়েছে।

গতকাল ঢাকা শিশু হাসপাতালে জরুরি বিভাগের সামনে গিয়ে দেখা যায়, রোগী নিয়ে স্বজনদের লম্বা সারি। শিশুদের প্রায় সবাই জ্বরে আক্রান্ত। কোনো শিশু জ্বরে কাতরাচ্ছে। কেউ কাঁদছে। অসুস্থ শিশুদের নিয়ে জরুরি বিভাগের সামনে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পরও চিকিত্সকদের দেখা না পেয়ে অভিভাবকরা অস্থির হয়ে পড়ছেন। অনেকেই করছেন হট্টগোল। অবস্থার প্রেক্ষিতে সেখানে দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের বেগ পেতে হচ্ছে।

অভিভাবকরা বলেন, শুক্রবার হওয়ায় সব হাসপাতালেই চিকিত্সকের সংখ্যা কম। অনেক হাসপাতালে চিকিত্সক না পেয়ে তারা শিশু হাসপাতালে এসেছেন। কিন্তু শিশু হাসপাতালে জরুরি বিভাগ ছাড়া চিকিত্সা দেওয়া হচ্ছে না। যেখানে শিশু হাসপাতালে আরো জরুরি বিভাগ খোলা দরকার ছিল সেখানে মাত্র একটি খোলা রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেল্থ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৬৮৭ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯৯৬ জন। এ নিয়ে বাংলাদেশে চলতি বছরে ২১ হাজার ২৩৫ জন রোগী বিভিন্ন সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৪ হাজার ৬৩৯ জন রোগী সুস্থ হয়েছেন ও বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন ৬ হাজার ৫৮২ জন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকা শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) ১২৩ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ৩৫ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতাল ৩৩ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ১১৮ জন ভর্তি হয়েছেন।

এছাড়া হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৩৫ জন, বারডেম হাসপাতালে ১৭ জন, বিএসএমএমইউতে ২৯ জন, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ১৯ জন, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৬৪ জন, পিলখানা বিজিবি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৫৬ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৯২ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, ঢাকা শহরের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে নতুনভাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ৩৭০ জন রোগী।

গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা জেলায় ৫৪ জন, গাজীপুরে ৩ জন, মুন্সিগঞ্জে ৬ জন, কিশোরগঞ্জে ২৬ জন, নারায়ণগঞ্জে ৬ জন, গোপালগঞ্জে ৩ জন, মাদারীপুরে ১১ জন, মানিকগঞ্জে ১৭ জন, নরসিংদীতে ১০ জন, রাজবাড়ীতে ১০ জন, শরীয়তপুরে ৮ জন, টাঙ্গাইলে ১৬ জন, ফরিদপুরে ৩ জন, গাজীপুরে শহীদ তাজউদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৭ জন, ময়মনসিংহে ২ জন, জামালপুরে ৫ জন, শেরপুরে ৪ জন, নেত্রকোনায় ৫ জন, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৬২ জন, চট্টগ্রামে ১২ জন, ফেনীতে ২৩ জন, কুমিল্লায় ৫ জন, চাঁদপুরে ২১ জন, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় ৮ জন, নোয়াখালীতে ১৫ জন, কক্সবাজারে ৩ জন, লক্ষ্মীপুরে ১০ জন, খাগড়াছড়িতে ১ জন, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২১ জন, খুলনায় ১৫ জন, কুষ্টিয়ায় ১১ জন, মাগুরায় ৭ জন, নড়াইলে ৭ জন, যশোরে ১৯ জন, ঝিনাইদহে ৮ জন, বাগেরহাটে ২ জন, সাতক্ষীরায় ৫ জন, চুয়াডাঙ্গায় ৪ জন, মেহেরপুরে ১ জন, খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১২ জন, বগুড়ায় ২৫ জন, পাবনায় ৫ জন, সিরাজগঞ্জে ২৪ জন, নওগাঁয় ৬ জন, চাপাইনবাবগঞ্জে ৭ জন, নাটোরে ১ জন, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৯ জন, লালমনিরহাটে ২ জন, গাইবান্ধায় ৪ জন, নীলফামারীতে ৭ জন, দিনাজপুরে ৪ জন, পঞ্চগড়ে ১ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে ১ জন, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৯ জন, বরিশালে ৭ জন, পটুয়াখালীতে ৬ জন, ভোলায় ৫ জন, পিরোজপুরে ৬ জন, ঝালকাঠিতে ২ জন, বরগুনায় ৫ জন, বরিশাল শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৪৬ জন, সিলেটে ৭ জন, মৌলভীবাজারে ২ জন, সিলেটে ওসমানি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে